অণুগল্প

অণুগল্প

।।অণুগল্প।।
এ কে এম আব্দুল্লাহ

সময়ের শ্যাওলা

আজকাল মনে হয় চাঁদ যেন বৃদ্ধ হয়ে গেছে। ধার করা আলোর ঋণের বোঝায়— হারিয়ে গেছে তার অরিজিন্যাল মাধুর্য। ভাবতে ভাবতে রাতের কিছু ভাঙা প্রহরে ভর করে— সেই বৃদ্ধ চাঁদ থেকে ঝরে পড়া কয়েক টুকরো জোছনাদানা পকেটে ভরে আবুল হাঁটতে থাকে বনগাঁয়ের দিকে।

বনগাঁয়ের বাদশাহ বাড়ির বারান্দায় যখন পৌঁছে তখন ভোর ছুঁই ছুঁই। বারান্দার স্মৃতি বোঝাই সিলিং এ লটকে থাকা সকেট থেকে বৃদ্ধ চাঁদের মতো আজও চল্লিশ পাওয়ার বাল্ব থেকে ঝরছে আলো। আর যেখানে দেয়ালের ফাঁকফোকরে বেরিয়ে আসতো বিদ্যুৎ ঝলকানি— এখন সেখানে বংশবিস্তার করেছে সময়ের শ্যাওলা। আবুল পুরোনো চোখ খুলে চার দিকে একবার ভালো করে দেখে নেয় ফের।

ঘরের ভেতরে দু’একজন পুরোনো পরিচিতজন আছেন। হয়তো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন।আবুল হাতের ঘড়ি একবার দেখে নিয়ে বারান্দায় রাখা ভাঙা ছোটো একটি টুল টেনে বসে পড়ে। রাতের শেষপ্রহর এখন কাউকে ডাকা সমীচিন হবে না ভাবতে ভাবতে রং উঠা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।

কিছুক্ষণ পর— বাতাসের কান বেয়ে ভেসে আসে বহুযুগ পরিচিত ফজরের আজান ধ্বনি।আবুল উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে টুকরো টুকরো জোছনাদানা ছুঁড়ে দিয়ে পুরোনো লেবুগাছের বাগানে— হাঁটতে থাকে পুরোনো পুকুরের ভাঙা পারের দিকে। আর সদ্যসময়ের ঠোঁট ভেঙে আবুলের মুখ থেকে অস্ফুটো শব্দে বেরিয়ে আসে— আহা ! আসলে এই পুকুরপারের মতোই আমাদের মানুষজীবন। একদিন আমাদের জীবনেরও পার ভেঙে যায়— আর দৃষ্টির ফাঁকে জন্ম নেয় সময়ের শ্যাওলা।

পুকুর ঘাটের ভাঙা পাথরে দাঁড়িয়ে সূর্যের ঠোঁটে চুমো দিয়ে আবুল— নিজেকে প্রশ্ন করে আমি কি সত্যিই মানুষ, নাকি চাঁদ ?
এরপর ভাবনার একচিলতে চিকন হাসি ঠোঁটে নিয়ে আবুল— চাঁদের মতো জন্মঋণের বোঝা পকেটে ভরে হাঁটতে থাকে ফের নির্দিষ্ট পাতানো পথে।

অন্ধকারের শেকড়

স্টেশনের পাশে পড়ে থাকা অকেজো বগির কাছে— প্রতিদিনই সকালে তার সাথে দেখা হয়। আমি তখন হেঁটে পার হই রেললাইন। বোবার মতো তার সাথে কথাও হয়। মায়ের স্তনের শুকনোবোঁটা চুষতে চুষতে বাঁকা চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়। কখনও আধপুড়া ঘাসে শুয়ে থাকে। অনিচ্ছায় চাটে সূর্যরস।পাশেই, মা-লোহার হাতুড়ি দিয়ে একমনে ভেঙে যায় জীবনের দীর্ঘহাড্ডি।

বিকেলের ছাদ থেকে যখন চুইয়ে চুইয়ে পড়ে হলদেরং— আমি সেই রং চেটে চেটে ফিরি বাড়ি। আর আমার রাতের পাতে— যখন পিউর বাসমতি ভাতের পাশে রাখি মাছের মাথা ; সেখান থেকে সে বেরিয়ে আসে নীরবে। তার হাতে চিক চিক করে মৃতসূর্য।

এরপর আমি বহুজাতিক কৌশলে মুখ ঘুরিয়ে মাখাতে থাকি ভাত আর মাছ। সেও আমার দিকে ঘুরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে— ফোঁটা ফোঁটা মসলামাখানো ঝোল…

মোমেনা

ড্রয়িংরুমে টেলিফোন বেজেই চলেছে। মোমেনা রিসিভারের পাশেই বসা। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। মাঝে মাঝে ওড়না দিয়ে মুখ পরিষ্কার করছে মোমেনা। ফোন ধরার কোনো আগ্রহ আর নেই।
ল্যান্ড-লাইনে তেমন ফোনকল আসে না। আজকাল সবাই মোবাইল ব্যাবহার করে। মোমেনাও। ল্যান্ড-লাইনটা শুধু রাখা হয়েছে মোমেনার মায়ের জন্য। মা মোবাইল ব্যাবহার করতে পারেন না।আসলে তখন মোবাইল এভাবে বাজারে আসেনি। সেই থেকেই এভাবেই অভ্যস্ত হয়েছেন। এখন তো অনেক বয়সও হয়েছে। সেই বহু বছর পূর্বে মোমেনা মাকে তার বাসার ল্যান্ড-লাইন নাম্বারটা ডায়াল করানো শিখিয়েছিল, সেই থেকেই প্রতিদিন দুবার রুটিন মতো মা,মোমেনাকে ফোন করেন।বিশেষ করে সকাল এগারোটায় একবার আর রাত আটটায় শোবার আগে। মোমেনা এই ফোন কলের জন্য অভ্যস্ত। মোমেনার মা মোমেনার বাসায় বছর দুই পর ঘন্টাখানেকের জন্য আসেন, কিন্তু মোমেনার আশপাশের সবাইকে জানেন যদিও কোনোদিন চোখে দেখেননি। মার সাথে ফোনে সব গল্প করে মোমেনা। আরা তা শোনে মার মুখস্ত হয়ে গেছে অমুকের মা কি করল, অমুকের মা কি রান্না করছে ইত্যাদি।

অনেকক্ষণ ফোন বেজে কেটে গেলো। মোমেনা ফোন না ধরেই চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। চোখে ভেসে উঠে মায়ের মুখ। মাত্র দুসাপ্তাহ হলো মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। এখনও চারপাশে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ আতঙ্ক। হাসপাতালের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসাবে করোনাভাইরাসেরই কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত্যুর সময় মায়ের পাশে থাকতে পারেনি। সেই কষ্ট মোমেনাকে আরও ভেঙে দেয়। করোনার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। অনেক অনুরোধ করেছে। তখনও মায়ের মুখে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিলো। সেইফটি রিজন বলে ঢুকতে দেয়া-ই হলো না। অবশেষে মায়ের লাশ গোসল করানোর পর ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে ঝাপসা চোখে মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখে মোমেনা।

এখনও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। ল্যান্ড-লাইনে কল এলেই মায়ের ফোনকল মনে করে ধরতে যায় মোমেনা। কেউ কেউ মোবাইলে না পেলে কিংবা অফিসিয়াল ফোন বাসার ফোনে আসে। ফোনের রিং বেজে উঠলেই মোমেনা মায়ের ফোন মনে করে ধরতে যায়। পরক্ষণেই মনে পড়ে মায়ের মৃত্যুর কথা। ভেসে উঠে মায়ের সেই চিরচেনা মুখ। আর সময়ের আঁচলে মুখ গুঁজে মোমেনার দুচোখ বেয়ে নামতে থাকে জল।