প্রবন্ধ : বিশ্বভারতী ও বাংলাদেশ ভবনের সোনালী ইতিহাস

প্রবন্ধ : বিশ্বভারতী ও বাংলাদেশ ভবনের সোনালী ইতিহাস

বিশ্বভারতী ও বাংলাদেশ ভবনের সোনালী ইতিহাস
ডঃ সুবীর মণ্ডল

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে শান্তিনিকেতনের অবারিত প্রান্তরে ২০ বিঘা জমি ক্রয় করে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন মাত্র দুই বছর। কালের প্রবাহে শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ সমার্থক হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ও তাঁর শিল্পভাবনা, জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার ধারাবাহিকতায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিদ্যালয়, পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতন আজ বাঙালির অহঙ্কারের অংশ।শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতায় যুক্ত হয়েছে নান্দনিক এক বাংলাদেশ। শান্তিনিকেতনে পূর্বপল্লীর এক সময়ের খোলা মাঠে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ ভবন।

সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য এক মহামিলন ক্ষেত্র বিশ্বভারতী। রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতনের এই বিশ্বভারতী এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে রয়েছে শিশু শ্রেণী থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষালাভের ব্যবস্থা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে, যেখানে বিশ্বের সব প্রান্তের ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়ার সুযোগ পাবেন। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কবিগুরুর মনে এই স্বপ্ন উঁকি দেয়। ১৯১৬ সালের ১১ অক্টোবর কবিগুরু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছেলে রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে। ওখানে সর্বজাতির মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।’ কবিগুরু বিদেশ থেকে ফেরেন ১৯১৭ সালের ১৭ মার্চ। তারপর ১৯১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণীর সামনে কবিগুরু আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতীকে জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। বিশ্বভারতী সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে সোসাইটির হাতে তুলে দেন জমি, বাড়ি, নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ এবং তাঁর সব গ্রন্থের স্বত্ব। এরপর ধীরেধীরে বিশ্বভারতী জুড়ে গড়েওঠে শ্রীনিকেতন, কলাভবন, সংগতভবন, শিক্ষাভবন, চীনাভবন, হিন্দিভবন ইত্যাদি। তারপর ১৯৫১ সালে ভারতীয় সংসদের আইনবলে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করছেন প্রায় সাত হাজার ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে অনেক বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীও রয়েছেন।

বিশ্বভারতীর পাঠক্রম বর্ণময়। বিশ্বভারতীতে শিশু শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত রয়েছে পড়ার ব্যবস্থা। রয়েছে এখানে শিশুদের পড়াশোনার জন্য আনন্দ পাঠশালা আর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনার জন্য রয়েছে পাঠভবন। এ ছাড়া রয়েছে কলেজ অব হিউম্যানিটিজের জন্য বিদ্যাভবন, কলেজ অব সায়েন্সের জন্য শিক্ষাভবন, কলেজ অব ফাইন আর্টসের জন্য কলাভবন, কলেজ অব মিউজিকের জন্য সংগীতভবন, টিচার্স ট্রেনিংয়ের জন্য রয়েছে বিনয়ভবন, কৃষিবিদ্যার জন্য রয়েছে পল্লীশিক্ষাভবন, আর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের জন্য রয়েছে শিক্ষাচর্চা ভবন। এখানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ানো হয় বাংলা মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি মাধ্যমে।

পাঠভবনে ভর্তি হতে পারে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় সংবাদপত্রে। পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে হোস্টেল। বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরাও এখানে ভর্তি হতে পারেন। ক্লাস হয় এখনো সেই গুরুকুলের ধাঁচে বিভিন্ন গাছের তলে। তবে বর্ষা নামলে শ্রেণীকক্ষে ক্লাস হয়। বিদ্যাভবন
বিদ্যাভবনে পড়ানো হয়

বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, হিন্দি ওড়িয়া, অর্থনীতি ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও গণিতে তিন বছরের বিএ অনার্স কোর্স। আরও পড়ানো হয় চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি, তিব্বতি ভাষা, জাপানি ও পার্শিয়ান ভাষার বিএ অনার্সের চার বছরের কোর্স। সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে দুই বছরের এমএ পড়ার সুযোগও এখানে রয়েছেএখানে জার্মান, ইতালীয়,রুশ, চীনা,তিব্বতি, ফরাসি, অহমিয়া, মারাঠি,তামিল, সাঁওতালি, ওড়িয়া, হিন্দি, আরবি, ফার্সি, বাংলা, উর্দু ও জাপানি ভাষাশিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঐতিহাসিক বাংলাদেশ ভবন তৈরির মূল কুশীলব। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সফরকালে তিনি এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে সময় তিনি শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন প্রতিষ্ঠার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। পরবর্তীকালে ২০১১ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর তাঁর আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেন। সেখানেও এ বিষয়টি নিয়ে ঐকমত্য হয় এবং যৌথ প্রতিবেদনে শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে ধারণাপত্র তৈরি, পূর্বপলল্গীতে স্থান নির্বাচন, ভবনের ডিজাইন প্রস্তুত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভবন নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে।

৪৪০০০ বর্গফুট আয়তনের এই দ্বিতল ভবন। প্রথম তলার আয়তন ২৮০০ বর্গফুট, দ্বিতীয় তলার আয়তন ১৬০০০ বর্গফুট, তার ভেতরে ১৩০০ বর্গফুটের একটি সুবিন্যস্ত লাইব্রেরি, ফ্যাকাল্টি রুম, ক্যাফে ও ৩০০০ বর্গফুটের জাদুঘর রয়েছে। সামনে আছে পোর্চ ও প্রশস্ত লন। বঙ্গবন্ধু ও কবিগুরুর ম্যুরাল নির্মাণের পরিকল্পনাও এখানে রয়েছে। সব মিলিয়ে শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন স্থাপত্য উৎকর্ষের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে শান্তিনিকেতনের নৈসর্গিক পরিবেশে। এর পাশেই রয়েছে ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার।

বাংলাদেশ ভবন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত একটি অসাধারণ সৃজনকর্ম। শান্তিনিকেতনের এক টুকরো বাংলাদেশ যেন বাংলাদেশ ভবন। বাংলাদেশ ভবন গড়া হয়েছে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লির ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার আর শান্তিনিকেতন দূরদর্শন কেন্দ্রের কাছে। এই ভবন নির্মাণের জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল ২ বিঘা জমি। বর্তমানে জমির পরিমাণ ৮ বিঘে।আর এই জমিতেই বাংলাদেশ সরকার এই ভবন নির্মাণের জন্য দিয়েছিল আনুমানিক ৩৫ কোটি টাকা।বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশের শিল্পকলা, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের মেলবন্ধন অটুট রাখা এবং শিক্ষা বিষয়ক অধ্যয়ন ও গবেষণা করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ও অর্থায়নে এই ভবনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

মে ২০১৮ ভারতীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করা হয়।বাংলাদেশের অর্থায়নে নির্মিত ৪১০০ বর্গ মিটারের বাংলাদেশ ভবনে রয়েছে দুটি সেমিনার হল, একটি গ্রন্থাগার, একটি জাদুঘর, একটি শিক্ষা কেন্দ্র, একটি ক্যাফেটারিয়া এবং ৪৫৩ আসন বিশিষ্ট একটি অত্যাধুনিক মিলনায়তন। বেশ কয়েক বার শান্তিনিকেতনে গেছি। শান্তিনিকেতন থেকে বেশ কিছু দূরে আমার কর্মস্হল। ওখানে বেশ কয়েক জন বন্ধু আছে।আমার এক আত্মীয় ওখানকার রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। ফলে বাংলাদেশ ভবন ঘুরে দেখেছিলাম খুব সহজেই। এই ভবনের সোনালী ইতিহাস খোঁজার একটা তাগিদ অনুভব করতাম। সেই কারণেই বহুবার গিয়েছি শান্তিনিকেতনে ।বাংলাদেশ ভবন দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি , শুধু তাই নয় এর অসাধারণ স্হাপত্যশৈলী দেখে বিস্মিত হলাম। বহু সময় নিয়ে সমস্ত ভবন ঘুুরে ঘুরে দেখেছি। বাংলাদেশ ভবনের গ্রন্থাগারটি এক কথায় অনন্য ও অসাধারণ।ঐতিহ্যমণ্ডিত এক ঐতিহাসিক স্মারক ভবন হয়ে উঠবে আগামী প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের ও গবেষকদের কাছে। দুু দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে এক আকাশ অহংকার এই ভবন। এই ভবনটি আমার কাছে মনে হয়েছে শান্তিনিকেতনে এক টুকরো বাংলাদেশ।

গ্রন্থাগার জুড়ে রয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পর্কিত বহু গ্রন্থ। দুই দেশের শিক্ষার্থীদের ও গবেষকদের কাছে এই ভবনের গুরুত্ব অসাধারণ। জাদুঘরটি ৪টি জোনে বিভক্ত। শুরু হয়েছে উয়ারি বটেশ্বরে প্রাপ্ত ২৫০০ হাজার বছর পুরনো সভ্যতার নিদর্শন দিয়ে। শেষে রয়েছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। মাঝের অনেকটা সময় জুড়ে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন রয়েছে, তেমনই আছে অতি দুর্লভ কিছু ছবি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত নানা প্রত্ন নিদর্শনের অনুকৃতি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে উয়ারি বটেশ্বরে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শন যেমন আছে, তেমনই আছে ৬ষ্ঠ-৭ম শতকের পোড়ামাটির কাজ, ১৬শ শতকের নক্সাখচিত ইট প্রভৃতি। রয়েছে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ের নানা নিদর্শন, দেবদেবীদের মূর্তি। কোনটা পোড়ামাটির, কোনটি ধাতব। মাঝখানে সুলতানি এবং ব্রিটিশ শাসনামলও এসেছে জাদুঘরটিতে রাখা নানা প্যানেলে। ঢাকার জাতীয় জাদুঘর থেকে আনা বেশ কিছু মুদ্রাও রয়েছে।১৮.০৯.১৮ তারিখে বাংলাদেশ ভবন সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়।

এই বাংলাদেশ ভবন বিশ্বভারতী এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। এটি বিশ্বভারতীর অন্যতম আন্তর্জাতিক ভবন। প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প সুষমাময় কারুকাজ , নকশায় তৈরি ১৭০ -এরও বেশি আসবাবপত্র আছে এই ভবনে, তাছাড়া বাংলাদেশ প্রকাশনার ছ’হাজারের বেশি বই , সে দেশে বসবাসের সময় কবির ব্যবহূত নানা জিনিস , তাঁকে নিয়ে পড়শি দেশের প্রকাশিত ডাকটিকিট -সহ আরও অনেক কিছু৷ সে সব নিয়ে বিশ্বভারতীতে তৈরি হয়েছে ‘বাংলাদেশ ভবন ’৷যাবতীয় জিনিসপত্র তো বটেই , এ কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২৫ কোটি টাকাও বরাদ্দ করে৷ ৷ নান্দনিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব শিল্প-সংস্কৃতির ভাণ্ডার ভবনটি। একটি গ্রন্থাগার , আন্তর্জাতিক মানের সংগ্রহশালা , অত্যাধুনিক সভাগৃহ এবং সংস্কৃতি অঙ্গন — এ নিয়েই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ভবন৷ বাংলাদেশের একঝাঁক নামজাদা স্থপতি এহসান খান , গ্রাফিক ডিজাইনার তারিক সুজাত , শিল্পী প্রবাল সাহা -সহ একঝাঁক বিশেষজ্ঞ দল এক বছর ধরে এই ভবন তৈরির কাজ করেছে৷

গ্রন্থাগার তৈরির তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ মাকসুদুর রহমান৷ সেখানে যে ছ’হাজারেরও বেশি বইয়ের সম্ভার এসেছে , তার বড় অংশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সে দেশের বিশিষ্ট লেখকদের গবেষণা , নজরুল , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তাদের স্বাধীনতায় ভারতের অবদান , বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমান্ত আত্মজীবনী , কারাগারের দিনলিপি , ইত্যাদি রাখা আছে সেখানে৷ আমার মতে ও ভাবনায় ভবনের অন্য আকর্ষণ সংগ্রহশালা৷ আগামী প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। সেটিরও কেন্দ্রে মূলত রবীন্দ্রনাথ৷ তারিক সুজাত এক মাস ধরে সাজানোর কাজ করছেন ৷ তাঁর কথায় , ‘শিলাইদহ , পাতিসর , সাজাদপুরে থাকার সময় কবির ব্যবহূত নানা জিনিস রাখা হয়েছে এই সংগ্রহশালায়৷

এ ছাড়া , শিলাইদহের কুঠি -সহ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত নানা স্থান এবং সেগুলির ভিডিয়ো থাকবে৷ ’ দ্বিতীয় একটি প্যানেলে থাকবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঢাকা সরকারের প্রকাশিত সব ডাক টিকিট , কবির জন্ম সার্ধশতবর্ষে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক প্রকাশিত রুপোর মুদ্রা ইত্যাদি৷ এ ছাড়া ময়নাপুর , পাহাড়পুরের মতো জায়গা থেকে পাওয়া বৌদ্ধ যুগের বেশ কিছু নির্দশন রাখা হবে অন্য একটি প্যানেলে৷ শিল্পী প্রবাল সাহা বক্তব্য অত্যন্ত প্রানিধানযোগ্য, ‘থাকবে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নানা ছবি , নকশি কাঁথা , নকশি পাটি ইত্যাদি৷ ’

বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব জামদানি শাড়ি , পদ্মা চপলা নৌকোর রেপ্লিকা , একতারা ইত্যাদি থাকবে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের এই নবতম সংযোজনের সংগ্রহশালায়৷ স্থপতি এহসান খানের বক্তব্য , ‘ভবন নির্মাণ থেকে প্রদর্শনী , সবেতেই বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন বলে আমার নিজস্ব অভিমত ৷ তাই সেখানকার আসবাবপত্র পর্যন্ত আনা হয়েছে৷ ’সংগ্রহশালার পাশের ঘরেই মোদী -হাসিনার ‘হাই প্রোফাইল ’ বৈঠক হওয়ার হয়েছিল ৷ সেখানেও রাখা হচ্ছে বাংলাদেশের আসবাবপত্র ,
একটি পর্যায় শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে। তারপরের বিভাগ শুরু হয়েছে ৫২-র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক যে বিভাগ, তার আগে ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গটি এ কারণে রাখা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূচনা তো সেই ৫২-তেই,” ।

বর্তমান সময়ে এই ভবনের গুরুত্ব:

বাংলাদেশ ভবনের মূল আকর্ষণ গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালাটিতে মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সেই দেশের লোকশিল্প, প্রত্নতত্ত্বের বিবরণ। এই ভাবেই এক টুকরো বাংলাদেশ উঠে এসেছে শান্তিনিকেতনের বুকে। এ ছাড়াও, ভবনের ভিতরে যে গ্রন্থাগারটি রয়েছে সেখান থেকে বই ইস্যু করা না গেলেও বইগুলি সেখানে বসে পড়ার ব্যবস্থা করেছেন কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, বাংলাদেশ বিষয়ক প্রভূত পরিমাণ বই রয়েছে যা বাংলাদেশ সম্পর্কে চর্চায় খুব জরুরি। আগামী দিনে যাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে চর্চা করবেন, সেখানকার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক ইতিহাস জানতে চাইবেন, তাঁদের জন্য এই গ্রন্থাগার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই মনে করছেন সবাই। ভবনের ভিতরে ৪৫৩ আসনের একটি প্রেক্ষাগৃহ, ৩৫০টি আসনের সেমিনার হল তৈরি হয়েছে। প্রেক্ষাগৃহে সুস্থ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে এবং সেমিনার হলে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। তবে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিষয়কে বাদ রেখে। বিশ্বভারতী সূত্রে জানা গেছে, সাপ্তাহিক ছুটি এবং কেন্দ্রের ছুটিগুলি ছাড়া সব দিনই এই ভবন খোলা থাকবে সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত। তবে প্রতিদিন দুপুরে দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজন বিরতির জন্য ওই সময়ে সংগ্রহশালাটি বন্ধ থাকে।

বাংলাদেশ ভবনের জমির পরিমাণ বর্তমানে ৮ বিঘা। তার ওপর এই চমৎকার ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে আধুনিক স্থাপত্য এবং শান্তিনিকেতন ও বাংলার প্রকৃতির ঐকতান ফুটে উঠেছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীগণ চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি ও আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিফলন যেন এ ভবনে থাকে। সেভাবেই ভবনের নকশা করা হয়েছে। ভবনের সামনের অংশে বাংলার চৌচালা ঘরের আবহ তৈরি করা

বাংলাদেশ ভবন আজ সবার জন্য উন্মুক্ত। গবেষকদের ও পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়েছে এই ভবনে। দুই বাংলার শিক্ষার্থীদের ভাবনা এই রকম ‘‘পড়াশোনার জন্য আমরা অনেক দিন ধরেই শান্তিনিকেতনে আছি। দু’দেশের মধ্যে কোনও দিন কোনও পার্থক্য পাইনি। তবুও বাংলাদেশের একটি অংশ পেয়ে খুব ভাল লাগছে।’’

শেষকথা:
‘ হে পদ্মা আমার, তোমায় দেখা শত শতবার/ একদিন জনহীন তোমার পুলিশের,/ গোধূলির শুভ লগ্নে হেমন্তের দিনে,/ সাক্ষী করি পশ্চিমের সূূর্য অস্তমান / তোমারে সপিঁয়াছিনু আমার এই পরাণ’। এই শিলাইদহ, পদ্মা, পূর্ব বাংলার কথা বর্তমান বাংলাদেশকে বাদ দিলে যেন ভাবাই যায় না রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব আর বিচিত্র সৃষ্টিকর্মের কথা। বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, শান্তিনিকেতন আর বিশ্বভারতীর এক উজ্জ্বল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সময়ের হাত ধরেই বাংলাদেশ ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক সুুুুদৃঢ করার সরকারী প্রচেষ্টার গৌরবময় ফসল শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন স্হাপন। দুুই বাংলার বাঙালির প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার পর রবীন্দ্রনাথের চর্চা যেভাবেই হয়েছে ও হচ্ছে ,বর্তমান বাংলাদেশের রবীন্দ্র চর্চা তার চেয়েও বহুব্যাপ্ত। বাংলাদেশের হৃদয় জুড়েই কবি গুরুর উজ্জ্বল উপস্থিতি আজও চিরভাস্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা- মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। পশ্চিমবাংলার মতো পূর্ববাংলার বাঙালি জীবনে সমস্ত সংকটেই রবীন্দ্রনাথের কাছে বাড়়িয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগ্রত করেছিল। প্রবল দেশপ্রেমে বাঙালির প্রতি ভালোবাসায় দুই বাংলা এক হয়েছিল।

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এই গান পাকিস্তানের সৈন্যদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস এনে দিয়েছিল বাংলাদেশের অগণিত মানুষকে।রবীন্দ্রনাথের কবিতা,লেখা,বাঙালির প্রতিবাদী চেতনাকে জাগ্রত করেছিল।রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের আশ্রয় দিয়েছিল। বাংলাদেশের গায়ক, লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপক প্রমুখ ব্যক্তিরা শান্তিনিকেতনে আশ্রয় পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় আতশবাজির অনুষ্ঠানে বিশেষ বিষয় ছিল বাংলাদেশ। উনিশশো বাহাত্তরের সমাবর্তনে স্বাধীনতা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর আবু সৈয়দ চৌধুরী সস্ত্রীক এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। দীর্ঘদিন পূর্ববাংলার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সম্পর্ক ছিল সুুুুদৃঢ ও অমলিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে সেই সম্পর্ক আরও সুুুুদৃঢ ও সুগভীর হলো।বাকিটা ইতিহাস। সময়ের হাত ধরেই ১৯৯৯ সালের ২৮ শে জানুয়ারী বিশেষ সমাবর্তনে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনাকে ‘দেশিকোত্তম’ প্রদান করে বিশ্বভারতী।
বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের আসা- যাওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই চলেছে। বর্তমান বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত গায়িকাদের অধিকাংশই বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের ছাত্র-ছাত্রী।বাংলাদেশের সনজিতা খাতুন,রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা,লিলি ইসলাম বিশ্বভারতীর সঙ্গে বাংলাদেশের সেতু বন্ধনের কাজ আজও করে চলেছেন। বর্তমানে বিশ্বভারতীর বিদেশী ছাাত্র-ছাত্রীদে মধ্যে সিংহভাগ বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রী। চৌদ্দ বছর বয়সে কবির যে সম্পর্ক স্হহাপ হয়েছিল শিলাইদহ, পাতিসরে সেটি ব্রক্ষচর্য বিদ্যালয়, বিশ্বভারতী হয়ে পূর্ণতা পেল শান্তিনিকেতনের বাংলাদেশ ভবন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের মাননীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য শ্রীসুশান্ত দত্ত্গুপ্তের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত হয় Memorandam of Understanding। বাংলাদেশ ভবনের জমির ভার নিল ভারত সরকার ও ভবন নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করলেন বাংলাদেশ সরকার।২০১৮-র ২৫ শে,মে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন ঘটে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীগণের উপস্থিতিতে। দুই দেশের সম্পর্কের সেতু বন্ধনে এই ভবনের অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বভারতীর সম্পর্ক শুধু পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নয়, তার থেকেও বেশি এই অমলিন সম্পর্ক, ঐতিহাসিক ও আত্মিক।

তথ্যসূত্র– আনন্দবাজার পত্রিকারআর্কাইভ, রবীন্দ্রনাথ জীবনী, প্রথম খণ্ড, প্রশান্ত কুমার পাল, প্রথম আলো পত্রিকা,ব্যক্তিগত ঋণ-কামাল চৌধুরী, সবুজ কলি সেন(বিষয় বাংলাদেশ, বলাকা সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা,২০১৯, হিন্দুস্তান টাইমস,