গল্প: দাগের দামে

গল্প: দাগের দামে

দাগের দামে
দীলতাজ রহমান

জেসমিনের সাথে কবিরুলের বিয়ের বছর দুই পরই তাদের সংসার ভাঙে। বাগেরহাট জেলার একই গ্রামে পাশাপাশি না হলেও কাছাকাছি দুজনের বাড়ি। গরীব পরিবারের মেয়ে জেসমিন বেশ কয়েকটা ভাইবোনের সংসারে কষ্টেশিষ্টে এসএসসিটা টেনেটুনে পাশ করেছিল। বিয়েও হয়েছিল তেমন এক পরিবারে কলেজের খাতায় নাম লেখানো এক ছেলের সাথে। কিন্তু সে পাত্র কবিরুল যতটা না অভাবে কলেজ মুখো হয়নি, তার চেয়ে তার বখে যাওয়া স্বভাবে সে কলেজ ছেড়েছিলো। তবে জেসমিনদের থেকে কবিরুলদের পারিবারিক কিছুটা অবস্থা ভালো। মানে বিঘে দুইয়েক জমি কবিরুলদের বেশি। দেখতেও কবিরুল জেসমিনের চেয়ে ভালো। তাই জেসমিনের নীরিহ বাবা সহজেই কবিরুলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়। আর কবিরুলের বাবা ভেবেছিলো, একটা শান্তশিষ্ট কর্মঠ মেয়ে পেলে ছেলে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে ছেলে ঘর মুখো হবে। তাই রূপের থেকে পাত্রীর গুণের দিকেই বাবার বেশি নজর ছিলো।
নিজের সংসার হওয়ার পর কবিরুল বুঝলো, ওই বিঘে চারেক জমির ফসল আর বাজারের ভেতর বাপের ছোট্ট একটা দোকানের আয়ে সংসার চলছে না। গ্রামে কিছু করার যোগ্যতা কবিরুলের নেই। তার ওপর বাপের ওই ক’বিঘে জমিতে যতই মনোযোগ দিয়ে আবাদ করুক সেই ফসলে এতগুলো মানুষের প্রয়োজন মিটবে না। তারও ওপর আবার কবিরুলের বেশ ঠাটবাটে থাকার অভ্যাস। সে তাই জেসমিনকে বললো, গ্রামে থেকে আমার কিছু হবে না। তারচেয়ে আমরা ঢাকা গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করি!
: কিন্তু প্রথমেই গিয়ে উঠবো কোথায়? এভাবে যেতে গেলে বেশ কিছু টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া লাগে! আর তুমি কি কাজ করতে পারো, তা জানো? খালি তোমার স্কুলের সার্টিফিকেট দিয়ে কিছু হবে না! কারিগরি বিদ্যা শেখো!
: তাহলে আমি যাই আগে। আমানুল্লাহ ভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়। পরে তোমাকে নিয়ে যাবো!
কবিরুল সত্যিই বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় তার মামাতো ভাই আমানুল্লাহ বাসায় উঠেছিলো। মামাতো ভাই ড্রাইভার। বড়লোলোকের গাড়ি চালায়। সেই কবিরুলকে বললো, তুমি ড্রাইভিং শেখো। তাতে বেকার থাকতে হবে না’। মেট্রিক পাশের সার্টিফিকেট আমারও আছে। পিয়ন-চাপরাশির চাকরির থেকে ড্রাইভিং শিখে রাখা অনেক ভালো। রাস্তায় জ্যাম থাক আর যা-ই থাক, ঢাকা শহরে মানুষের গাড়ি কেনা কখনো বন্ধ হবে না।
মামাতো ভাইয়ের কথায় কবিরুল রাজি হয়ে গেলো। এবং ড্রাইভিং শিখতে যে টাকা লাগে তাও সেই ড্রাইভার ভাই-ই তাকে দীর্ঘ মেয়াদে ধার দিলো। তারপর ভাই বুদ্ধি দিলো, তুমি ড্রাইভিং শিখতে থাকো আর জেসমিনকেও নিয়ে আসো, সে তোমার ভাবির সাথে গার্মেন্টসে কাজ করবে।
: জেসমিন পারবে তো? গেরস্ত ঘরের মেয়ে…।
: গেরস্ত ঘরের মেয়েরাই সব পারে। এটা অনেকের জানা নেই। কারণ তাদের সামর্থের ওপর তাদের আস্থা আছে! শহরের মেয়েরা কলসটা পুকুরে ডুবিয়ে ভরে সে কলস কাঁখে তুলতে পারবে মনে করেছো?
: কেন?
: ওরা ওই সিনেমা-নাটকে নায়িকাকে কলস কাঁখে দেখে আনন্দ পায়। কিন্তু ওটার জন্য যে হিম্মত লাগে, তাও তারা জানে না!
: এমন করে তো ভাবি নাই ভাই! তাহলে তো গেরস্ত’র মেয়ে কেন? ছেলেদেরও সবকিছু বেশি পারা উচিৎ?
: অবশ্যই! এই যে এ যাতৎ যতখানে চাকরি করলাম, বেশির ভাগ স্যারেরই পরিচয় তেমন মজবুত না। ওই গ্রামের সাধারণ কি তার থেকে নিম্নমানের পরিবার থেকে আসা! সেই মানুষগুলোই, বাপ সচিব ছিলো, মন্ত্রী ছিলো এমন সব মানুষের, আতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়!
: তো তোমার যে স্যার অতি নিম্ন পরিবার থেকে আসা, তারা তোমাকে বলে, তাদের ব্যাকগ্রাউণ্ড?
: ধুর! আত্মীয়-স্বজন, মা-বাপ, তার ওপর আচার-ব্যবহারে বোঝা যায় না, কয় পুরুষের অভিজাত! আমাদের মা-বাবা যদি ছোটবেলা থেকে আরেকটু ভালো করে আশা-ভরসা দিয়ে মানুষ করতো, আজ আমরাই এই শহরে নিজের গাড়ি চড়তাম! পরিবার তো খারাপ ছিলো না তোমার-আমার কারোই! কিন্তু চোখে কোনো স্বপ্ন ছিলো না আমাদের।
: ঠিকই বলছো। আমাদের মা-বাবা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কিছু নীতি-নৈতিকতা ছাড়া আর কিছু শেখায় নাই। তেমন একজন স্যারও স্কুলে ছিলো না, যে একটা লক্ষ্য স্থির করে দেয়!
: এখন আমি আর তোমার ভাবি চাকরি করি। কিছু টাকা বাড়িতে দিই। তোমার ভাবিও দেয়। তারও তো মা-বাবা অভাবি। আর যা থাকে ছেলেমেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শেখাতে যায়। আমার আশা, আমার ছেলেমেয়ের একটা ভালো অবস্থা যেন আমি দেখে যেতে পারি!
: কিন্তু ড্রাইভারদের যে মানুষ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলে? আমি এইজন্য এটা শিখতে আগ্রহী না ভাই!
: সে কথা তোমার এতক্ষণে মনে পড়লো?
: আগে তো দেখিনাই! তোমার এখানে এসে তোমার সাথে এখানে-ওখানে গিয়ে টের পেলাম!
: তুমি যদি মানুষ ভালো হও, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে সে সাধ্য কারো নাই! কিন্তু তোমোকে প্রমাণ করতে হবে, যে তুমি আসলে ভালো মানুষ। মানুষের সমীহ পেতে মুখোশ এঁটে থাকবে, ওই মুখোশের ফাঁক দিয়ে আসল মুখ বেরিয়ে পড়ে!
: শোনো ভাই, গ্রামে গিয়ে হাতে কাদা লাগিয়ে চাষবাস আমার দ্বারা সম্ভব না। তাই শহরে রোজগারের পথ, আমার জন্য এটাই যদি উপযুক্ত হয়, কাজ শেখাও। কিন্তু তুমিই চাকরি ঠিক করে দিও।
: সেটা তোমার বলতে হবে না! আর তোমার ভাবির থেকে জেসমিনের লেখাপড়া বেশি। সে নিশ্চয় আরো ভালো কাজ পাবে! তাই তুমি কাজ শিখতে শিখতে ও রোজগারে নামুক! কারণ ড্রাইভিং শেখার পর লাইসেন্স পেতে সময় লাগে।
০০০০
যাত্রাবাড়ি ব্রিজের কাছে কবিরুলের মামাতো ভাইয়ের বাসা। আগে তারা তাদের দশ এবং বারো বছরের দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে এক রুমের এক বাসাতে থাকতো। কবিরুল জেসমিনকে নিয়ে আসার আগেই তারা সেই একই বাড়ির অন্যপাশে পাশাপাশি দুটো রুম নেয় এবং জেসমিনকে কবিরুলের মামাতো ভাই আমানুল্লাহ’র স্ত্রী সাজেদা তার সাথে গার্মেন্টসে চাকরি ঠিক করে দেয়। কবিরুল তখনো ড্রিইভিং শিখছে। কিন্তু জেসমিনের চাকরি হয়ে গেলে ক্রমে সে টের পায় হাঁড়ভাঙা খাটুনি ধকল। তবু বাসা ভাড়া দিয়ে দু’জনের চলার মতো টাকা রোজগার করছে সে, তাতেই তার আনন্দ। গ্রামের গেরস্তবাড়ির মেয়ে, গেরস্তবাড়ির বউ জেসমিন প্রায় বস্তির মতো ভিড় না হলেও যাত্রাবাড়ি এসে একই বাউণ্ডারির ভেতরে অনেকের বাসকরা, সেখানকার পায়খানা-গোসলখানা থেকে রান্নাঘর সবখানে সে সমঝে চলে। প্রায় পনেরটি পরিবার একবাড়িতে থাকে। অথচ তার স্বাতন্ত্র্যবোধের জন্য সবাই তাকে ভিন্নচোখে দেখে।
০০০০০
কবিরুলের চাকরি হতে হতে জেসমিন নিজের বেতনের টাকা দিয়ে প্রতিমাসে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে থাকে। এর ভেতর টের পায় তার পেটে বাচ্চা। শরীর খারাপ লাগে তাও সে ছুটি নেয় না। ছুটি নিলো একেবারে যখন তার বাচ্চার জন্মের সময় আসন্ন হলো। আর সেই উপলক্ষে জেসমিনের মাও এলো মেয়ের সেবা করতে। কিন্তু শেষ সময়ে যখন ডাক্তার বাচ্চার নড়াচড়া টের পাচ্ছিলেন না, আল্ট্রাসনো করে দেখা গেলো পেটে দুটো ছেলে। তাদের অবস্থা ভালো না। প্রসূতিকে হাসপাতালে আনতে দেরি হয়ে গেছে। আগে তারা স্থানীয় ধাত্রী দিয়ে ঘরেই বাচ্চা প্রসব করানোর চেষ্টা করেছিলো। তারপর অবস্থা বিপজ্জনক হলে হাসপাতালে গিয়েছিলো। ডাক্তার সিজার করে বাচ্চা বের করলেও বাঁচেনি দুটি বাচ্চার একটিও। জেসমিনের মা শুরু থেকে মেয়েকে বলেছিলো, মা হওয়ার জন্য মেয়েদের মানসিক প্রস্তুতিটাই আসল। ঘনঘন ডাক্তারের কাছে যেও না। গেলেই একটা না একটা গলদ বের করে ওষুধ খাওয়াবে। জেসমিনেরও তাই মনে হয়। সে তো হরহামেশা শুনে আসছে, এ দেশে যত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরে, তার চেয়ে বেশি মানুষ ভুল চিকিৎসায় মরে। আর সত্যিকথা জেসমিন আগে কোনো অসুবিধা টের পায়নি!
যাত্রাবাড়ি কবরস্থানে বাচ্চা দুটিকে কবর দেয়া হয়। শোক এবং পরিশ্রমের ধকলে জেসমিনের শরীর সারছিলো না। তারওপর অপারেশন করা পেট। এদিকে জেসমিনের মাও তার গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগি, সর্বোপরি স্কুল পড়ুয়া তিনটি ছেলেমেয়ের সংসার রেখে আর দূরে থাকতে পারছিলো না। তাই পেটের ক্ষত শুকিয়ে গেলে জেসমিনকে বাড়িতে নিয়ে গেলো জেসমিনের মা। যদিও জেসমিন কবিরুলকে রেখে যেতে চায়নি। কিন্তু কবিরুলের ততোদিনে চাকরির বয়স ছয়মাস। বিআরটি’এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে কবিরুলকে আমানুল্লাহ ড্রাইভিং শিখিয়ে আবার নিজে তার চালানো গাড়িতে গোপনে গোপনে হাত পাকিয়েছে নিজে পাশে থেকে। তখন আমানুল্লাহ উপদেশ হিসাবে বলেছে, দেখো, তোমার জন্য আমি এই অনিয়মটা করলাম। মালিক টের পেলে আমার চাকরি থাকবে না। বদনামও হবে! তারপরও তোমার উপকার হোক। ড্রাইভিং পেশা মাথা ঠাণ্ডা রেখে করার কাজ। আল্লাহ’র ওপর ভরসা রেখে পথে নামবে। মনে করবে আমার হাতে কয়েকটি মানুষের জীবন। ড্রাইভারের আচরণ যদি সন্দেহজনক হয়, তার সাথে ভ্রমণ করেও আনন্দ নেই। তাই যার গাড়ি চালাবে, তাদের একজন নিজেকে মনে করলেই হবে না। তাদেরকে সেটা বোঝাতে হবে। এটা মনে রেখো সারাজীবন! তাহলে কিছুতেই তোমার এ কাজটাকে ছোট মনে হবে না! আর চাকরি হারাও হতে হবে না। ভালো ড্রাইভিং জেনেও বহু ড্রাইভার চরিত্র দোষে বেকার।

জেসমিন তার মার সাথে যেতে না চাইলেও জাহেদা জেসমিনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠালো। বললো, তুই বাড়িতে গিয়ে শরীর ঠিক করে আয়। এই চাকরি তো গেছেই, ফিরে এলে নতুন চাকরিতে জয়েন করবি। তোর এমনিতে গার্মেন্টস বদল করার দরকার ছিলো। তুই আমার পরে কাজ করতে গিয়ে আমার থেকে অনেক বেশি কাজ শিখেছিস। তাই পুরনো অফিস বেতন যা বাড়াবে, নতুন অফিস তার থেকে বেশি বেতন দিয়ে লুফে নেবে। কাজ জানা মানুষের কদর সবখানে আছে!
: গার্মেন্টসে চাকরি করি এটা বলতেই তো লজ্জা পাই। এর ভেতর যদি ভালো কিছু করতে না পারি!
: ঠিক তাই। তুই বাড়ি গিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আয়। আর যতদিন না আসবি, কবিরুল আমাদের ঘরে খাবে। ওর কোনো অসুবিধা হবে না।
কিন্তু জেসমিন বাড়ি যাওয়ার কতদিন পরই শুনতে পায়, জাহেদার এক বোন এসেছে জাহেদার কাছে থাকতে। জাহেদা তাকে তার সাথে প্রতিদিন গার্মেন্টসে নিয়ে যায়। তার মানে তার চাকরি হয়েছে। কিন্তু বোনটা নাকি মাত্রই ডিভোর্স হয়েছে। তাকে সবাই দেখছে কবিরুলের সাথে দহররম-মহররম করতে। জাহেদার বোনের সাথে প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তাকে প্রায়ই কবিরুলের ঘরে দেখা যায়। আর এইসব টাটকা খবর ওই বাড়িরই কেউ তাকে ফোনে জানায়। জেসমিন মায়ের সাথে বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত ঢাকায় আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলো। মা-বাবা তাকে ধমকে ধামকে নিবৃত্ত করতো। সেই জেসমিন আর ঢাকায় আসতে চায় না। শরীর শুকাতে থাকে। মন ভাঙতে থাকে। কবিরুলকে সে আর ফোন দেয় না। কবিরুলই নিয়ম করে ফোন দেয়। কিন্তু জেসমিন টের পায় কবিরুলের কথা এখন আলগা কথার ফুলঝুরি। কোনো উত্তাপ নেই। নিয়ম রক্ষার তাগিদেই ফোন করে। তার কথায় এখন জেসমিনকে কাছে পাওয়ার থেকে সে জেসমিনকে ঢাকায় যেতে জোর না দিয়ে বলে, আমার তো চাকরিই হইছেই। তুমি দেশে আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকো। আমি তোমার জন্য টাকা পাঠাবো।
জাহেদার বোনের সাথে কবিরুলের সম্পর্ক, তারা যে বাড়িতে ছিলো সেখানে তা রটে গেলে এখন তারা অন্যত্র বাসা নিয়েছে, তাও কবিরুল বলেনি জেসমিনকে। আর জেসমিনও সেসব জানে বলে তাকে ঘুণাক্ষরে জানায়নি।
০০০
একবার রোজগারে নামা মানুষ কি আর অকর্মণ্য হয়ে ঘরে থাকতে পারে! জেসমিনেরও শরীরের ক্ষত সারলে মনের ক্ষরণ সে চেপে রেখে আগের বাসায় এসে একাই উঠলো। সে ভাবলো সে চাকরি করে একা থাকবে। সে শুনেছে কবিরুল জাহেদার বোনকে বিয়ে করেছে। সে যদি বিয়ে নাও করে, শুধু যেটুকু তার সত্য মনে হয়েছে, সেটুকুর জন্যই সে কবিরুলের সাথে আর না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। একটাও নয়, দুই দুইটা সন্তানের শোক ভুলে, তার অসুস্থতা ভুলে কবিরুল আরেকটি মেয়ের সাথে আলগা পিরিতি মজেছে এটাই তার কাছে বড় ঘেন্নার ঠেকে। সে যত টাকা বেতন পায়, তার থেকে বেশি জেসমিন পেয়েছে। প্রায় বছরখানেকের চাকরিতে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে নতুন চাকরিতে ঢুকলে আরো বেশি বেতন পাবে সে বিশ্বাস তার আছে! শহরে গিয়ে বারোরকমের মানুষের সাথে মিশে কবিরুলের আসল চেহারা বেরিয়ে গেছে। আর জেসমিন প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে মোহর না হোক খুচরো পয়সার মতো জমিয়েছে।
জেসমিন যখন জানলো কবিরুল বিয়ে করে ফেলেছে। যারা সংবাদটি তার কানে তুলেছিলো, তারাই বলেছিলো ওর বিরুদ্ধে মামলা করতে। জেসমিন কিছুই বলেনি। সে ফিরে এসেই নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। বেশি বেতনেই ঢুকেছে। কিন্তু এবার শরীরের দিকে যত্ন নিতে সে ওভারটাইম না করে বাড়ির ছেলেমেয়েদের ডেকে ডেকে পড়ায়। এটাই ছিলো তার নেশা। বাড়িতেও তাই করতো। কবিরুলের সাথে বিয়ের চেয়ে তার আগ্রহ ছিলো আরো লেখাপড়া করে গ্রামের স্কুলে মাস্টারী করবে। কিন্তু কবিরুলের বাবার নজরে পড়ে তার সাধ বালির বাঁধের মতো ভেঙে গেলো।
০০০
জেসমিনের ঢাকা ছুটে আসার আরেক কারণ ছিলো তার ছেলেদের কবর দেখা। ঢাকায় থাকলে মাঝে মাঝে সে ছেলেদের কবর দেখতে পারবে, এই টানই তাকে সব ভুলিয়ে টেনে এনেছে। ঢাকা এসেই তার ছেলেদের যে লোক গোসল করিয়ে কবর দিয়েছিলো, প্রথমে তার সাথে গিয়ে কবর দুটি দেখে এসেছিলো। তারপর থেকে সে প্রায়ই একে ওকে নিয়ে যায়। সেখানে বসে সে ছেলেদের জন্য একবেলা করে কেঁদে বুক ভাসিয়ে আসে। তার এই কান্নার সাথে হয়ত তার আরো সব বেদনা যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু পবিত্র এই বেদনার সাথে সে আর কোনো বেদনা, আর কোনো মুখ মিলাতে চায় না। ছেলেদের সে দেখেনি। তারা জীবিত জন্মেছিলো কিনা, সেটা ছিলো শুধু সন্দেহ। না হলে হয়তো একসাথে চাপামাটি দেয়া জায়েজ ছিলো। তবু ওই সন্দেহের জন্য দুটো কবর তো হয়েছে! স্বামী-সংসার কেড়ে নিয়ে আল্লাহ ওই বেদনাটুকুই হয়ত তার জন্য বরাদ্দ করেছিলো। নাহলে প্রায় অর্থ-সম্বলহীন জেনেও কবিরুলের বাবা তাদের সুগঠিত পরিবারটি দেখে একোবারে কেড়ে নেয়ার মতোই তাকে তার ছেলের বউ নিয়েছিলো। আরো দুটি ছেলের বউয়ের থেকে জেসমিনকেই তারা বেশি ভালো জানতো। গ্রামে কবিরুলদের জোর বেশি। কিন্তু নগরে এসে সে টের পেয়েছে, এখানে আইন-কানুন, থানা-পুলিসের বিষয়টি সবার মুখস্ত। সবাই এখানে একচেটিয়াভাবে বলেছিলো, কবিরুলের নামে থানায় অভিযোগ করতে। কিন্তু জেসমিন গলা দিয়ে বের হয়ে আসা খাদ্যবস্তু মুখে তোলার মতো কবিরুলকে তার জীবনে জায়গা দিতে চায় না বলে সে ওসব ভাবনা মাথায় জায়গা দেয়নি!
জেসমিন শিমুল-পলাশ নামে কবর দুটোরই নাম রাখে। তার নিজের নামও তো ফুলেরই নাম! জেসমিন যখন কবরের কাছে যায়, কবরস্থানের মানুষ বলে দেইখা লন, এ কবর তো এতদিন থাকার কথা না। কোনায় বইলা পইড়া আছে।
জেসমিন জানে শহরে কবরগুলোর কী পরিণতি হয়! কিন্তু তার সে কথা মনে আসেনি। সে ভেবেছিল, জনম জনম সে শোকের আগুন পোহাতে এখানে আসবে!
এর ভেতর একদিন জেসমিনের কান্না আকুল সময়ে দেখলো কবিরুল তার সামনে দাঁড়ানো। সে হতভম্ব হয়ে বললো, তুমি এখানে?
: আমি তো মাঝে মাঝে আসি।
জেসমিনের মনে পড়লো এই শোকের ভাগ তো কবিরুলেরও সমান। জেসমিন কান্না ভুলে সেদিনের মতো সেখান থেকে চলে যেতে পা বাড়ালে কবিরুল ডাক দিলো, জেসমিন!
কারো বোধহয় এতো সাধ্য থাকে না, তুচ্ছ হলেও এমন অভাজনের ডাকে ফিরে না তাকানোর। জেসমিন তাই ফিরে তাকালে কবিরুল বললো, মাফ করে দে জেসমিন! আমাকে মাফ করে দে! কী দিয়ে হয়ে গেলো আমি বুঝিনি! জাহেদা ভাবি তার ডিভোর্সী বোনটাকে আমাকে সুকৌশলে গছিয়েছে! এজন্য আমানুল্লাহ ভাইও তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে…। একসাথে দুইটা সংসার নষ্ট করছে সে!
জেসমিন রাগী চোখে কবিরুলের দিকে তাকিয়ে যেন আগুনের একঝলক হলকা তার প্রাণে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর আবার সামনের দিকে হনহন করে হাঁটা শুরু করলে। কবিরুল দৌড়ে তার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তার দিকে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। বললো, দোষ করলে আল্লাহও তো মাফ করে!
: আমি তো আল্লাহ নই! আমার ক্ষুদ্রতাকে কেউ প্রভাবিত করুক তা আমি চাই না!
কবিরুল যেন পাগল হয়ে যায়। সে জেসমিনের পা চেপে ধরে। আর আশপাশে চলাচল করা অনেকেই এই দৃশ্য দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ে। এতে জেসমিন খুব বিব্রত হয়। তবু কবিরুল বলে, এই যে আমি আমাদের ছেলে দুইটার কবর ছুঁয়ে শপথ করে এইখান থেকে তোর সাথে চলে যাবো। আর কোথাও ফিরে তাকাবো না! তুই যা বলবি, তাই শুনবো!
কবিরুলের প্রতি কেন জেসমিনের রাগ পড়ে যায়, তা সে বোঝে না। কবিরুল কোনোদিনই তাকে তুই তুই করে বলেনি, এখন তাও বলছে! তবু সে ধীরকণ্ঠে বলে, সন্তান হারানোর মতো সংসার ভাঙার যাতনা কি, দুটোই আমি একসাথে বুঝেছি। অতএব আমার যত কষ্টই হোক, আমি আর কারো আশার সংসার ভাঙতে পারবো না!
জেসমিনের কথায় কবিরুলের হাত শিথিল হয়ে যায় জেসমিনের পা থেকে। যেন সে জেসমিনকে চলে যাওয়ার অধিকার দেয়। কারণ ওই মুহূর্তে জেসমিনকে তার দেবী মনে হয়। কারণ সে তো কেবল হিংসা-দ্বেষ-মায়া-মমতা, সাধারণ ক্ষমা-ঘেন্নার মানুষ দেখে আসছে। এমন দেবীকে সে পেয়েছিলো, এটা ভেবেই সে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সে সেইভাবেই সেইখানে অসংলগ্ন হয়ে বসে থাকে। আর জেসমিন দীপ্ত পায়ে হেঁটে চলে যায়। একবারও পিছনে ফিরে তাকায় না!
এই গল্পটি এখানেই শেষ হলে ছোট গল্পের সংজ্ঞা রক্ষা হতো। কিন্তু বাস্তবতা কখনো কল্পনার চেয়ে ভয়ঙ্কর। যে বৃদ্ধ তোরাব আলী মৌলবি জেসমিন-কবিরুলের ছেলেদের গোসল করিয়ে ক’জনকে সাথে নিয়ে কবর দিয়েছিলো। জেসমিন যে ক’দিন কবরস্থানে গিয়েছে, সেই বৃদ্ধের স্ত্রী’কেই সে বেশির ভাগ সময়ে তার সাথে করে নিয়ে গেছে। শেষদিনও তোরাব আলীর স্ত্রী-ই সাথে ছিলো। তাই সে যখন দেখলো কবিরুল জেসমিনের পা চেপে ধরেছিলো, কিন্তু জেসমিন টলেনি। এটাই সে বাড়িতে এসে রটিয়ে দিয়েছে, ‘কী পাষাণ্ড বেডি লো! বেডা মানুষ ভুল করতেই পারে। আর পুরুষ মানুষ চারটে পর্যন্ত বিয়া করতেই পারে! পাও ধইরা যহন মাফ চাইছে, আর কি থাহে! বেডায় তো কইছেই পরের বউ ছাইড়া দিবো…।’ তোরাব আলীর স্ত্রী’র কথায় বাড়ির মানুষ দুইভাগ হয়ে যায়! একভাগ জেসমিনের কাঠিন্যকে বাহবা দিতে লাগলো, আর আরেক ভাগ, স্বামী পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার পরও জেসমিন মাফ না করায় তাকে নরকের কীট মনে করতে লাগলো। তোরাব আলীর স্ত্রী’ এ কথাও বলতে বাদ রাখেনি, যে জেসমিন বলেছে, সংসার ভাঙার বেদনা আমি বুঝেছি। আর কারো আশার সংসার আমি ভাঙতে চাই না…।’ এমন নগদ প্রাপ্তি হাত পেতে না নেয়ায় সবাই তাকে হদ্দ বোকাই মনে করতে লাগলো। বলতে লাগলো, ‘বেডির মাথায় গণ্ডগুল আছে!’

আমানুল্লাহর সাথে কবিরুল আবার নতুন বাসায় গেছে। কিন্ত জেসমিনকে সবাই ভালবাসতো বলে সে পুরনো বাড়িতেই এসে উঠেছিলো। সে ডেকে ডেকে বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিঃস্বার্থভাবে লেখাপড়া শেখাতো বলে সবাই তাকে খুব ভালবাসতো। দেখা যেতো দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর তার রান্না করেই খেতে হতো না। পল্লাপাল্লি করে সবাই তাকে যারযার রান্না হলেই দিয়ে যেতো ওই ছেলেমেয়ে পড়ানোর জন্য। জেসমিন একা থাকতো বলে অনেক মেয়েই এসে তার কাথে থাকতে চাইতো। সব ক্ষয়েরই পূরণ আছে মনে করে জেসমিন। সে মনে করেছিলো, সে এভাবেই মানুষের ভালবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠছিলো। কিন্তু তোরাব আলীর স্ত্রী তার মন বিক্ষিপ্ত করে তুললো। তাকে নিয়ে দলাদলিও তার ভালো লাগছিলো না। এইসব মানুষের মুখে বারবার তার নাম উচ্চারিত হোক, তাও সে চায়নি। কিন্তু সে বুঝে গেছে, দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষই একচোখা! এরা না পারে নিজেরা ভালো থাকতে। না অন্যকে ভালো থাকতে দেয়। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথটা যখন সে চিনে গেছে, তারওপর সে এএসসি পাশ। শুধু অক্ষরজ্ঞান সম্বলিত নয়, শিক্ষিত বলতে যে অংশকে বোঝায়, সে সেই অংশের হিসাবের ভেতরে। অতএব বাড়িতে ফিরে বাবা-মার বোঝা হয়ে আরেকটা বিয়ের ভারে তাদেরকে আর ফেলতে চায় না সে। জেসমিন ভাবে, সে এবার কোনো মহিলা হোস্টেলে গিয়ে উঠবে। কবিরুল তার কাছে ফিরে এসেছিলো, আর অবহেলা দিয়ে সে তাকে এড়িয়ে আসতে পেরেছে, এতে তার মনে অনেকটাই জোর সঞ্চয় হয়েছে। ক্ষয় হয়েছে গ্লানি। অতএব তার আকাশ এখন স্বচ্ছ। কারো পাকানো ধুম্রকুণ্ডলি তাকে অন্ধকার করে রাখতে পারবে না আর!
০০০০০
বাড়িতে তার আরো দুটি বোন আর একটি ভাই আছে। বাবা বর্গাচাষী বলতে যা বোঝায়, অনেকটা তাই। নিজেদের জমিজমা সামান্যই। ভাইটি সবার ছোট হলেও সে লেখাপড়ার সাথে সাথে বাবাকেও সহযোগিতা করে। বোন দুটোর একটা বিয়ে হয়ে গেলো কিছুদিন আগে। আরেকটা স্কুলে পড়ে। তার নিজের কাছে এনে রাখবার মতো অবস্থা কারো নয়। তবে বাবা না চাইলেও জেসমিন প্রতিমাসে কিছু কিছু টাকা তাকে বাড়িতে পাঠায়।
হোস্টেলে যাদের সাথে জেসমিন থাকে, এখানেও সবাই তাকে ভালবাসে। একই সাথে ক’জন মানুষ থাকলে সবার কথা সবারই জানা হয়ে যায়। জেসমিনের স্বপ্ন এমন কিছু কাজ শেখা এবং তা শুরু করতে তার যে পরিমাণ টাকা লাগে সেটাই অর্জন করতে সে উঠেপড়ে লাগলো। তার একমাত্র স্বপ্ন, জীবনে যে শিক্ষা সে পেয়েছে, সুখের জন্য সে আর কারো ওপর নির্ভর করবে না এবং গ্রামের মানুষকে দেখিয়ে দেবে স্বামীর নিগৃহীত হয়ে সে থেমে যায়নি। কারণ গ্রামের মানুষকে সাধারণ মানুষ যত সাধারণ ও সরল মনে করে, আসলে তারা তা নয়। তাদের বেশির ভাগই কুঁচুটে। যার জোর আছে, বিশেষ করে জনবল, তারা, মানে গ্রামের একচেটিয়া মানুষ তাদের দিকে থাকে। আর অর্থবল ও বাহুবল সমান থাকলে তারাই পুরো গ্রাম অনাচারে জব্দ করে রাখে। তাই কোনো অন্যায় না করেও কবিরুলদের কাছে তার বাবাও কোনঠাসা হয়ে আছে।
একটি গাছের ঝরাপাতা যেমন তলায় পড়ে, মাটিতে মিশে বছর বছর গাছটিকে আরো টেকসই করে তোলে, সে তো ওই গ্রামেরই মেয়ে। মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও অবক্ষয় সমানভাবেই দেখে বড় হয়েছে। তাই ভালো কাজের ভালো ফলকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা তার নেই। প্রকৃতির ভেতর বেড়ে ওঠা, গড়পরতা মানুষের থেকে তার শেখার কিছু নেই! সে ওইরকম বৃক্ষ হবে। নিজের ধংসস্তূপের ভেতর থেকে সে আবার জন্মানোর মতো করে একজীবনের ভেতর বহুজীবনের সাধ নেবে!
০০০০০
হোস্টেলে থাকার বয়স দুই বছর পার হয়ে গেছে। ছোটবোনটাকে ঢাকা এনে কলেজে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলো জেসমিন। কিন্তু তার জীবনের দিকে তাকিয়ে তার মা-বাবা রাজি হয়নি। তাই তাকে পাত্রস্থ করা হয়েছে। কিন্তু জেসমিন বোঝাতে চেষ্টা করেছে, সে ভালো আছে এবং একটি মেয়ের বিয়ের থেকে জরুরী তাকে রোজগার শেখানো। পরের ভাত খেয়ে কখনো আত্মপক্ষ সমর্থন ধোপে টেকে না। তাই নিজের ইচ্ছে- মতামত কখনো কোনো কাজে লাগে না। কলুর বলদের মতো ঘানি ঘুরিয়ে তেলটা অন্যের জন্য তুলতে হয়। কারণ শরিসাই যে অন্যের! তাই যে কোনো কিছুর উৎপাদণই তাকে আগে শিখতে হবে।’ কিন্তু নিজের মা-বাবাকেও এত বলেও তার কাজ হয়নি। বরং কবিরুলের কাছে ফিরে না যাওয়ায় তারাও ক্ষুন্ন। দশকাঠা জায়গার ভেতর পনেরটা পরিবারে ভেতর জেসমিন টিকতে পারেনি, দুর্মুখ দলের জন্য। কারণ ওদের সবটুকু চেষ্টাই নিজের ভালোর থেকে অন্যের ক্ষতির দিকে নিয়োজিত।
তাই জেসমিনের মা-বাবারও রোষ কবিরুলের থেকে তার দিকেই বেশি। এত আঘাত-অপমানের পরও নিজের মা-বাবার না বোঝাটা তাকে বেশি পীড়িত করে। তবু দমে না জেসমিন। হোস্টেলে থেকে যারা কাজ করেও লেখাপড়া করে, তাদের সাথে সে পরিকল্পনা করে, ইদানীং তারও ইচ্ছে আছে এই বেশি বয়সে কলেজে ভর্তি হওয়ার। সে বোঝে, এটা আরো দু’বছর আগে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো করতো!
০০০
একদিন মায়াবিবি গার্মেন্টসএর মালিকের বাড়ি থেকে ডাক আসে জেসমিনের। সে ভেবেছিলো তার মতো আরো কয়েকজনকে ডেকেছে। বরাবরই মালিকের বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে যেমন বেছে বেছে ক’জনকে ডেকে নেন মালিকের স্ত্রী সাবরিনা খান। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত সবাইকে রেখে, সবার সাথে প্যাকেটে প্রচুর খাবার দিয়ে, যে যেখানে থাকে ড্রাইভার তাদের সবাইকে নামিয়ে দিয়ে আসে। জেসমিন প্রথমদিন খাবার নিতে অস্বীকার করেছিলো। বলছিলো, আমি তো হোস্টেলে থাকি। আমার কে খাবে?
মালিকের স্ত্রী বলেছিলেন, যারা তোমার পাশে থাকে, তাদের নিয়ে খাবে। যখন যে কাছে থাকে সে-ই আপন…।’ জেসমিনের ভালো লেগে যায় কথাটি। জেসমিন বুঝেছে, বই পড়ে যা জানা যায়, সব সময় তা ঠিক নয়, ভালোমন্দ মিলিয়ে মানুষের কাছেই থাকে আসল শিক্ষা। তবু লেখাপড়া জানা তার মতো আরো ক’জনকে সাবরিনা খান এরকম বাসায় কাজের জন্য ডাকলে, ছল-ছুতোয় এদের ভেতর থেকে কেউ কেউ এড়িয়ে যায়! কিন্তু জেসমিন আগ্রহ নিয়েই যায়। কারণ একটা বড় পরিবারে ঢুকে তাদের জীবন যাপন, সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের আচরণ দেখতে। জেসমিনের নিজেরও একটু কথা বলার অভ্যাস। সে একদিন মালিকের স্ত্রী’কে সুযোগ পেয়ে বলেছিলো, ‘আন্টি, গার্মেন্টস’এর উঁচু পদগুলোয় বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত সব মানুষ সেটা সবাই ঠিকই জানেন। তাদের বেতনটাও উচ্চ। কিন্তু এই সাধারণ শ্রমিকের ভেতরও কিন্তু অনেক ভালো পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু তাদের সবার সাথে, জিনিসপত্র চুরি করতে পারে, এমন সব সন্দেহজনক মানুষের মতোই ব্যাবহার করা হয়। তাই আমাদের কাছে এ চাকরিটি সম্মানের হয়ে ওঠেনি। অথচ এর থেকে কম বেতন পেয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মানুষগুলো তাদের কাজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ব করে। স্যার তো অনেক আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকেন। স্যারকে বলবেন, পদস্থরা যেন আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন।
মালকিন আশ্বস্ত করলেন, জেসমিনকে। তিনি বললেন, তোমাদের চেয়াম্যান স্যার সেটা অফিসে তোমাদের চলাফেরা লক্ষ্য করেন বলেই আমার সাথে তোমাদের কথা বলেন । আর দেখো না, আমারও তো ওই মেয়ে একটাই ছিলো। মুনমুন। দেড়বছর হয় মারা গেছে। তোমরা তো জানোই। এখন এই বাচ্চা দুটো আঁকড়ে আছি। আমরা মারা গেলে এদের কী হবে, সেই চিন্তায় মেয়ের শোকও করতে পারি না। সৎমাকে কোনোখানে দেখি না স্বামীর আগের স্ত্রী’র ছেলেমেয়েকে ভালবাসতে। এই ভয়েই আমাদের সব সুখ-শান্তি নষ্ট। জামাই সম্পর্কে ভাগ্নে। তাই তো এখনো আমাদের আগলে আছে।’
ঠিকই আন্টি। দেখেন, মা না থাকলে গরীবের ঘরে জন্ম নেয়া শিশুদেরও বিড়ম্বনা কম না। কিন্তু তারা যে সংগ্রামের ভেতর মানুষ হয়, ওতেই তাদের অন্তদৃর্ষ্টি খুলে যায়। কিন্তু বদ্ধ জায়গায় বেশি আগলে মানুষ করা ছেলেমেয়ে মানসিকভাবে সহজেই কাতর করা হয়। আর সেই সুযোগই সুবিধাবাদী মানুষেরা কাজে লাগায়। তাই তাদের জন্য চিন্তা আরো বেশি।
: ঠিকই বলছো। এই যে তোমাদের আংকেলের এই পর্যন্ত আসতে, আমিই তো তার একমাত্র সহযাত্রী। কম কষ্ট সইনি আমরা। তাই সবসময় চিন্তা এটুকু যেন গুছিয়ে তাদের জন্য রেখে যেতে পারি।
: আন্টি আপনার শ্বাশুড়ি বলেছেন, গরিবের একটা যেমন-তেমন লেখাপড়া করা মেয়ে আপনাদের জামাইয়ের জন্য দেখতে। আমি এলেই উনি আমাকে প্রশ্ন করেন, যে পেলাম কি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন আপনার কাছে, আপনারা যেনতেন বিয়ে দিতে চাইলেই আপনাদের জামাই করবেন কি না! আর এটা কেন দাদীআম্মা ভাবছেন, যেনতেন কম লেখাপড়া করা মেয়ে আপনার নাতিদের নিজের সন্তানের মতো দেখবে!
: আমার শাশুড়ি মনে করেন গরীবের ঘরের একটা মেয়ে আনলে সে নিজে ভালো খেতে-পরতে পারবে সেই জন্য বাধ্য হয়ে ছেলেমেয়ে দুটিকে আপন করে নেবে!
: আন্টি, এটা আমার মনে হয় এইসব বাচ্চা মানে মাতৃহীন ছেলেমেয়ের জন্য, সাধারণ ঘরের থেকে আরো ভালো, আরো লেখাপড়া জানা মেয়ে আনতে হয়। যার অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান ভাববার বোধ আছে। উদারতা আছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য হই, যে ভুলটা গ্রামের মূর্খ মানুষগুলো করে, সেই ভুলটাই শহরের খোলা চোখের মানুষগুলোও করে!
: তুমি মেয়ে এতবড় সত্যিকথাটা কী করে বুঝলে?
: আপনি জীবনে কি কম দেখেছেন, যাদের মা নেই, বাবাকে আবার বিয়ে করতে হয়েছে! আবার দাদি মারা গেলে দাদা নিচু ঘরের এক মেয়ে এনেছিলেন। যত্ন করে আমার বাবা আর ফুপু তাদের দুইভাইবোনকে মানুষ করবে। আমার বাবাকে এত নাকি জ্বালিয়েছে তার সৎমা, বাবা এখনো কেঁদে ফেলেন, সেসব বলতে গিয়ে।
০০০০
একদিন ছুটির দিনে মালিকের বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে জেসমিনের ভালোই লাগে। মনে করে, যাক, আন্টিকে তার ঘরবাড়ি গুছিয়ে দেয়ার সাথে সাথে একটা পরিবারের সাথে কাটিয়ে আসা যাবে। পুরনো পত্রিকাগুলোর ওপর খুব লোভ থাকে জেসমিনের। সেদিওও জেসমিন আলাদা রকম সেজে রওনা হলো। আর সে সাজ দেখে ওর রুমমেট ক’জন রে রে করে উঠলো। বললো, ‘তোকে দেখে মনে হচ্ছে ইউনিভার্টিতে যাচ্ছিস! একজন আবার তার ভ্যানিটি ব্যাগটা টেনে দেখে বললো, কোনখান থেকে কিনেছিস? অনেক দাম? আরেকজন বললো, তোর এবারের চুল ছাঁটা ভালো হয়েছে।
জেসমিন সবার কথার জুৎসই উত্তর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।
: কোথায় যাচ্ছিস, বলে গেলি না ‘ বলে উঠলো একজন।
: বহূদূর, মায়াবিবি গার্মেন্ট’এর মালিকের বাসায়।
: নিশ্চয় অনুষ্ঠান আছে। বেশি করে খাবার আনবি কিন্তু! বলবি আমরা একরুমে ছয়জন থাকি!
জেসমিন হেসে বললো, বলবো, আমরা একরুমে ছয়জন থাকি, তার ওপর আমাদের রুমের প্রতিবেশীও আছে!
০০০০
অনেকদিন পর জেসমিন তার গামেন্টস’এর মালিকের বাসায় রওনা হয়েছে। অনেকদিন যাওয়া-আসার সূত্রে তার মনে হলো, কিছু নিই ওদের জন্য। কিন্তু বাচ্চাদের তো ওরা যা তা খাবার খাওয়াবে না। তাদের খাবার কোথায় পাওয়া যায়, তাও সে জানে না। আর ওদের দরকারও নেই অন্য কিছুর।
জীবনে এই প্রথম জেসমিন ফুলের দোকানে গিয়ে এক তোড়া রজনীগন্ধা কিনলো। তারপর মালিকের বাসায় পৌঁছে দেখলো বাড়িতে কোনো আয়োজনের লেশমাত্র আভাস নেই। সে দরজা ঠেলে ঢুকেই মায়া গার্মেন্টসএর মালিকের মা বৃদ্ধা কিন্তু চলনে বলনে কাজে কথায় ঋজু মায়াবিবিকেই সামনে পেয়ে গেলো। তার হাতেই ফুলের তোড়া তাকেই ধরিয়ে দিয়ে বললো, দাদীআম্মা, এটা আপনার জন্য!
আশির মতো বয়স হলেও মায়াবিবি নূব্জ হয়ে যাননি। কথা বলেন টানটান। জেসমিন দেখেছে, বৃদ্ধা সবসময় বই পড়েন। টেলিভিশন দেখেন। খবরের কাগজ পড়েন। বাড়িতে কেউ এলে আগবাড়িয়ে কথা বলতে যান। তবে হাসি-তামাশার বাহুল্য কথা নয়। যার জন্য তিনি কোনো কিছুতেই খেই হারান না।
অন্যান্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বয়সের সাথে এত খাপছাড়া কথা বলেন, অন্যের ওপর সিদ্ধান্ত চাপান, শেষে তাদেরকে মিথ্যে প্রবোধ দিতে হয় ছেলেমেয়েকে। মায়াবিবিই তার পুরনো পত্রিকাগুলো যখন জেসমিনকে বেছে বেছে দেন। পড়ে শেষ হয়নি এমন একখানা পেলেও টেনে ধরেন। আর তাতেই বোঝা যায় তিনি কতটা সতর্ক এখনো। জেসমিন প্রতিবারই পুরনো পত্রিকাগলো গুছিয়ে নিয়ে হোস্টেলের যে চায়, তাকেই পড়তে দেয়। অনেকে খুঁজে নেয়। আবার ক’জন একত্র হলে সেসব পাঠ প্রতিক্রিয়া নিয়ে উৎসব মুখর আলোচনা হয়। আর এতেই জেসমিনের অনাবিল আনন্দ।
০০০০০
ফুলের তোড়াটি মায়াবিবিকে হাতে তুলে দিতে দিতে জেসমিন বললো, জীবনে প্রথম ফুল কিনলাম দাদীআম্মা আপনার জন্য। আপনি নিশ্চয় এমন অনেক তোড়া পেয়েছেন। কিন্তু আমি আর কাউকে দিইনি। … কিন্তু বাড়িতে তো কোনো অনুষ্ঠান নেই! তাহলে আসতে বলছেন কেন?
: অনুষ্ঠান যেন হয়, সে জন্যই আসতে বলা! আসুক বউমা। সেই গুছিয়ে তোমাকে বলবে! চা খাবে?
: জেসমিনের মনে হলো, বৃদ্ধা আজ একটু কদর করছে ওকে। হাত ধরে পাশে বসালেন। তারপর চা খাওয়ার কথাও জানতে চাইছেন! জেসমিন আলতো করে বললো, আচ্ছা…।
মালিকের স্ত্রী’কে জেসমিন কখনো ম্যাডাম বলে। কখনো আন্টি এবং যে ক’জন বাড়িতে আসে তার ভেতর জেসমিনকেই তিনি স্বতন্ত্র চোখে দেখেন, এটা সে বুঝতে পারে! কারণ, তাকে নিয়েই আলমারি খুলে সব গোছগাছ করেন। আর বলেন, জানো, এগুলো আগে আমার মেয়ে করতো। আর বউকালে করে দিতেন ওই শাশুড়ি। আমি তো তার একটাই ছেলের বউ। ছেলে অবশ্য আরেকটা আছে, কিন্তু তিনি বিয়ে করেননি। ওয়েস্ট জার্মানী থাকেন। বিজ্ঞানী।’
কিন্তু মায়াবিবির আচরণে আজ জেসমিনের কেমন যেন লাগছে। কী বলবেন তিনি জেসমিনকে? তাদের হিসেবের বাইরের জেসমিনের মতো তুচ্ছ একটা মেয়েকে কী বলতে পারেন অভিজাত এলাকার এই অট্টালিকার মালকিন!
জেসমিনের চা শেষ হওয়ার আগেই সাবরিনা খান বেডরুমের ভারী পর্দা ঠেলে তার শাশুড়ি ও জেসমিনের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এলেন। জেসমিনের মনে হচ্ছিলো মালিক সাজ্জাদ খান ও তাদের জামাতা পার্থ চৌধুরী বাসায়ই আছেন। রুমগুলো বড় বড়। মাঝখানে লিভিং স্পেসও বিশাল। তার এপাশে ড্রয়িংরুম। তাই বাড়ির কেউ জানান না দিতে চাইলে তার অস্তিত্ব কোনো আগন্তুকের স্পষ্ট করে টের পাওয়ার কথা নয়। আর জেসমিনের সে ধৃষ্টতা প্রকাশের কোনো প্রয়োজনও নেই!
সাবরিনা খানকে আসতে দেখে জেসমিন উঠে দাঁড়ালো। সাবরিনা খান কাছে এসে জেসমিনকে কাঁধ ছুঁয়ে বসতে বলে, নিজে বসতে বসতে বললেন, বাবুর্চি শুধু চা দিয়েছে? আমি তোমার অপেক্ষা করছিলাম। তাই অস্থির হয়ে মনে হচ্ছিলো, মেয়েটা এমন দুপুর করছে কেন?
জেসমিন ভেতরে ভেতরে টলে যায়। তবু স্বাভাবিক স্বরে বললো, বাড়িতে তো কোনো অনুষ্ঠান নেই ম্যাডাম, তাহলে আসতে বলছেন কেন? তবে আমার দেরি হয়েছে রাস্তার জ্যামে। রাতেও যদি জানতাম এখানে আসতে হবে, তো তাড়াতাড়ি উঠে পড়তাম!
সাবরিনা খান বললেন, যা হোক, শোনো। আমরা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের জামাতা পার্থ’র সাথে তোমাকে বিয়ে দেবো। তুমি আমাদের মেয়ের মতোই থাকবে আমাদের কাছে। এটা আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি! আমরাই তোমাকে গড়েপিটে নেবো!
জেসমিন সটান উঠে দাঁড়ালো। তারপর একটু সরে গিয়ে বললো, ম্যাডাম, আগুনকে বশ মানিয়ে তবেই মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখেছে। ওই বশ মানানোর কাজটা কিন্তু মানুষের দ্বারা দুই’এক যুগে সম্ভব হয়নি! বহু শতাব্দী লেগেছে। অথচ পৃথিবীর বয়স কোটি কোটি বছর! আমাকে নিয়ে আপনারা সবাই মিলে যদি এরকম একটি পরিকল্পনা করেই থাকেন, আগেই বলি, কতটুকু জানেন আপনারা আমাকে?
সাবরিনা খান বললেন, আমরা সব জানি! তোমার হোস্টেলে প্রথমে খবর নেয়া হয়েছে, তারপর আমাদের পক্ষ থেকে বিশ্বস্ত কেউ একজন কৌশলে তোমার থেকে ঠিকানা নিয়ে, তোমাদের বাড়িরও ধারে কাছে গিয়ে তোমাদের সব জেনে আসছে। গরিব গেরস্ত তোমার বাবা…।
জেসমিন সাবরিনা খানের কথা শেষ হওয়ার আগে আবার বলে উঠলো, একটি মেয়েকে বউ করে আনতে বেশি ভাবতে হয় না। কিন্তু তিনটি ভূমিকায় যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন, তাকে বাড়িতে ডেকে এনেছেন ড্রাইভার দিয়ে ফোন করে! আমার বাবা গরিব, নীরিহ গেরস্ত আর আমি তার মেয়ে, এটা তার সামাজিক পরিচয়। আমার বাবা কৃষক সেটা আমার একধরণের গর্ব। কারণ তার সাফল্য বড় না হলেও দেশের প্রতিক্ষেত্রে যত দুর্নীতি, তাতে তার কোনো ভূমিকা অন্তত নেই। কিন্তু আমার একটা নীরব লড়াই আছে। সে লড়াইকে অব্যাহত রাখতে যেটুকু সাহস আমার অর্জিত হয়েছে, তা যে কারো একটি ডিগ্রীর থেকে কম নয়। তবু আপনাদেরকে আমার তরফ থেকে অনেক ধন্যবাদ! আপনাদের সবার বুঝেশুনে নেয়া সিদ্ধান্ত, মানে প্রস্তাবটি আমার বাবাকে জানালে তিনি নিশ্চয় লুফে নিতেন। কিন্তু আমি পারলাম না! আপনারা আমার কোনো বেয়াদবি নেবেন না প্লিজ!’ বলে জেসমিন নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। বেরিয়ে যেতে যেতে তার কানে গেল, মায়াবিবি বলছেন, ‘তোমরা বুঝেশুনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছো, মেয়েটা রাজি হোক, না হোক, তার আসার জন্য তুমি নিজে ফোন করতে পারতে। বা আমাকে ওর নাম্বার দিতে…!
০০০০০
বিকেল নাগাদ জেসমিন হোস্টেলে ফিরলো উদ্ভ্রন্তোর মতো। একটি শিল্পপতি পরিবার তাকে নিয়ে এতোটা ভাবছে। তা সে যে কারণেই হোক। এটা যেমন তার জন্য একটি ধাক্কা, তেমনি ড্রাইভার দিয়ে ফোন করানো, তাকে আনতে গাড়ি না পাঠানো, আর সেইখানে সেই বিয়ে নামক অসম্মানের টোপ গিললে মানুষ জানবে জেসমিন নামক এক গার্মেন্টসশ্রমিকের একেবারে রাজ কপাল…।’ বেগম মানে দুঃখহীনা, অথচ সেই বেগমদের অলংকারের জৌলুশে সাধারণ নারীর কাছে ওই পদটি খুব লোভনীয়। কিন্তু পাথরের নিচে চাপা পড়া ঘাসের মতো সে কিছুতেই কারো বেগম হয়ে বাঁচতে চায় না!
জেসমিনকে ওভাবে ধপাস করে বিছানায় পড়তে দেখে রুমে যে ক’জন ছিলো, একজনের সাথে আরেকজন স্বর মিলিয়ে বলতে লাগলো, পথে কেউ তোকে ধর্ষণ করেনি তো? আর তুই মায়াবিবি গার্মেন্টস’র মালিক’র বাড়ি থেকে আসলি, খাবার কই? আজ অনুষ্ঠান ছিলো না? তাহলে তোকে যেতে বললো কেন? এই জেসমিন, এই…।’
জেসমিন একেকজনের ঠেলাধাক্কায় আর পড়ে থাকতে পারলো না। সে উঠে বসলো। বললো, চাকরিটা ছেড়ে দেবো!
: চাকরি ছাড়বি ক্যান?
: এই যে বাসায় ডাকাডাকি!
: সম্মান দিয়ে ডাকলে তো কোনো অসুবিধা নেই। প্রয়োজন ছাড়া কে কাকে ডাকে বল! তখনি সেই মানুষ দূরের হয়, যখন যার কাছ থেকে কারো প্রয়োজন ফুরায়!
: সে বটে! অন্যখানে প্রয়োজন তৈরি করে নিতে হবে। এখানে আর নয়। আমাকে একটু ঘুমোতে দে তোরা! খুব ধকল গেলো বাসে! এত দূরের পথ…।’
০০০০
পার্থ মায়াবিবি গার্মেন্টস’এর মালিকের দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে। মেয়ে মুনমুনের লেখাপড়ায় অত আগ্রহ ছিলো না বলে মাত্র অনার্স পড়া কালীন, নীরিহ প্রকৃতির মা-বাবার বেশ কয়েকটি সন্তানের ভেতর উচ্চশিক্ষিত এই ভাগ্নের সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে নাতি-নাতনিকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে দিন কাটাচ্ছিলো সাজ্জাদ খানের পরিবারটি। কিন্তু মেয়ে মুনমুন তার ত্রিশ বছর বয়সের আগেই ক্যানসারে মারা যায়। আপন মামা না হলেও আজো পার্থ সাজ্জাদ খান ও সাবরিনা খানকে মামা-মামীমা বলেই সম্বোধন করে এবং স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও শ্বশুরের সব দায়-দায়িত্ব উত্তরাধিকারীর মতো বিশ্বস্ততার সাথে সে-ই পালন করে আসছে। সাজ্জাদ খানের কাজ হচ্ছে অফিসে গিয়ে নিজের চেয়ারখানাতে বসা এবং শুধু জামাইয়ের কাজ তদারকি করা। আর জামাই তদারকি করে পুরোটা।
খুব সহজভাবেই পার্থের সাথে সাবরিনা খান জেসমিনের পুরো বিষয়টি আলাপ করেছিলো। পার্থ বলেছিলো, স্ত্রী বলতে যে ছিলো, সে তো অকালে চলেই গেছে। তবু ঘরে একজন শক্ত-সমর্থ কারো নেত্রীত্বের দরকার বাচ্চা দুটোকে বড় করতে। তাই বুঝেশুনে আপনারা যা করবেন আমি তাতে রাজি!
কিন্তু জেসমিন ওভাবে কাটাকাটা কথা বলে চলে যাওয়ায় সাবরিনা খান খুব হতাশ হলেন। নিজের স্বামীকে বলতে পারলেও পার্থকে কী বোঝাবেন, নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছিলো সাবরিনার। কিন্তু বোকামিটা হলো কোথায় তা-ই তিনি বুঝতে পারছিলেন না। তাদেরই প্রতিষ্ঠানের সামান্য একজন কর্মীকে ড্রাইভারকে দিয়ে ফোন করানোটা দোষের কি হলো তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।
দুপুরে পার্থ তার ছেলেমেয়েসহ খেতে বসে বললেন, কিছুক্ষণ আগে কে এসেছিলো মামীমা?
সাবরিনা খান মুখ খোলার আগে মায়াবিবি বললেন, ওই সেই মেয়েটা। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয়নি বুঝলে পার্থ! তোমার মামীমা ওই মেয়েটিকে একটা প্রস্তাব দেবেন বলেই যদি মনেই করে থাকেন, তাহলে তাকে নিজে ফোন করা উচিৎ ছিলো। দেখো এই ছোট বিষয়টি কিন্তু আমাদের কারো মাথায় ঢোকেনি!
: আসলে মামীমা, দু’চারবার দেখে কাউকে চেনা যায় না। বাদ দেন। আসলে আমারও মন সায় দেয় না। আমার মনেহয় মুন সবসময়ই আমার সাথে আছে!
: দাদুভাই, দু’চারবার দেখে চেনা যায় না, এটা ঠিকাছে। তবে কাউকে কাউকে দু’চারবার দেখে চেনা শেষ হয়েও যায় না। মেয়েটা যা যেভাবে বলে গেল, আমি তো সেই তখন থেকে ভাবছি!
সজ্জাদ খান তার মায়ের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী শিক্ষা দিয়ে গেলো মা আপনাদেরকে একটি সাধারণ মেয়ে!
: সাবরিনা যখন শুরু করেছে, আমরা তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবো…।’ মেয়েটি বলে উঠলো ‘পৃথিবীর বয়স কোটি কোটি বছর। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ চেষ্টা করে আগুনকে আয়ত্ত্বে এনে এনে তার ব্যবহার শিখে মানুষ সভ্য হয়েছে।’ তারমানে ও মেয়েকে তোমাদের শেখানোর মতো কিছু নেই! আর কেমন করে আরো বলে গেলো, যাকে তিনতিনটি ভূমিকায় কল্পনা করেছেন! কিন্তু আমরা কিন্তু হিসেব করিনি এভাবে!
: ওটা গরীবের স্বভাব মা! বড়লোকের সবকিছু বাঁকা করে দেখে!
: সে তো দেখবেই! কিন্তু তার এই বিচক্ষণতা তার প্রতি আমার আস্তা বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু!
: আমি মা আর এর ভেতর নেই! আমি একটু রাগই হয়েছি! সাবরিনা খান বললেন।
: আচ্ছা, তুমি যা-ই বলতে, মেয়েটা সব মাথা নত করে মেনে নিলে তোমার ভালো লাগতো? তা কিন্তু লাগতো না। আমাদের তো একটা মানুষ দরকার। কাদামাটির দলা নয়, তাই না? সময়ের সাথে শাসন-বারণেরও ধরণ পাল্টেছে। খালি ঘরে ছেলেমেয়েরটা মানবে, অন্যেরটা মানবে না, তাহলে ভুল করবে! কাজের মানুষের সাথেই আমরা যে দাপট নিয়ে কথা বলতাম, তোমাদের সময়ে এসে তোমরাই তাদের ধমক খাও! তবু কি রাগ করে তাদের বাদ দিয়ে চলতে পারো?’ মায়াবিবি বললেন।
: আচ্ছা, যা করবেন, আপনি করলেই তো হলো। আমি এর ভেতর নেই মা!
: এর ভেতর নেই মানে? মেয়েটিকে কিন্তু আগে তোমাদের মেয়ে বানাতে হবে। তারপর সে পার্থর স্ত্রী এবং তার ছেলেমেয়ের মা হয়ে উঠতে পারে! তবে আমি সাহায্য করবো তোমাকে!
সেদিন খাবার টেবিলে ওই পর্যন্ত কথা হয়ে রইলো। এরপর সবাই ভুলে গেলেও পার্থ একটু কৌতূহল বোধ করছিলো। মেয়েটি তাদের গার্মেন্টেসে কাজ করে। ইদানীং নাকি কাটিং মাস্টারও হয়েছে এবং দ্রুতই নাকি সে এই পর্যায়ে এসেছে। আরো কিছুদিন যাওয়ার পর পার্থ তার অফিস সহকারীকে বললো জেসমিনকে ডেকে আনতে। সহকারী ফিরে এসে বললো, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তবে পাওনা টাকা এখনো নিতে আসেননি!
পার্থ তার কৌতূহল দমন করতে না পেরে, সহকারীকে আবার ডেকে বললো, ওর পুরো নাম এবং ফোন নাম্বারসহ কোথায় থাকে ডিটেইলস ওর কোনো কলিগের থেকে নিয়ে এসো।
জেসমিনের ফোন নাম্বার পেয়ে পার্থ চোধুরী তখনি ফোন করে ফেললেন। সরাসরিই বললেন, আমি পার্থ চৌধুরী। মায়াবিবি গার্মেন্টস’এর …।’
: চিনেছি স্যার!
এই দুটি শব্দের ভেতরই পার্থ মেপে ফেলে জেসমিনকে। বাহানা করার সুযোগ পায় না। বাহানা করার তা অভ্যাস নেই। তবু সে ঋজুকণ্ঠে বললো, আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তবু বলছি, আপনি কি একটু আসবেন অফিসে? মানে আমার সাথে দেখা করবেন।
: আসছি স্যার!
: কতক্ষণ লাগবে?
: ঘন্টাখানেক!
: আচ্ছা। আসেন!
ফোনের লাইন কেটে পার্থ ভাবলো, এ আমি কী করলাম! একটু আগেও তো ভাবিনি আমি এই কাণ্ড ঘটিয়ে ফেরবো! আর এটা প্রকাশ হয়ে পড়লে মামা-মামীমা, দাদীআম্মা কী ভাববেন! তারা কি ভাবব্বেন না, মুনমুন মারা যাওয়ার দেড় বছর না যেতেই আমি বিয়ে করতে পাগল হয়েছি! কিন্তু এটাও তো ঠিক, মুনমুনের স্থানে বাচ্চাদের একজন মায়ের দরকার। মামীমা দেখছেন দুজনকে। দুজনের জন্য দু’জন আয়া আছে, আর সেটাই ভয় তাদের আচরণগুলো ওদের ভেতরে ক্রমশ ঢুকে পড়ছে। তারা গোপনে ওদের শারীরীক না হোক, মানসিক নির্যাতন করে কি না, ছেলেমেয়ের বিষয় ভেবে পার্থ নিজেও কাজে মন বসাতে পারে না! তবে এখন ওই অদেখা যুবতী না তরুণী, কী ভাববে জেসমিনকে, পার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। তবে ডাকার পরে কলটি ও যেভাবে এক্সেপ্ট করেছে, তাতেই সে বুঝতে পারলো, এ নারী অপরিণামদর্শী বা দাম্ভিক নয়। তার পরিমিতি বোধ আছে। তার যা নিয়েই অহংকার থাক, তাতে তার সীমারেখা জানা আছে। ওটুকু যার থাকে তাকে গণ্য করা যায়! আর দাদিআম্মা আর মামীমা নিজেই যখন পছন্দ করেছেন,এখন সে ভুল করলেও এইখানে বড় রক্ষে।
০০০০০
ঘন্টাখানেকের বেশিই লাগলো জেসমিনের আসতে। পার্থ চোখ তুলে তাকিয়েই বুঝলো একে সে আগেও দেখেছে। কিন্তু কী এমন বৈশিষ্টের জন্য সে একেবারে বাড়ির সবার নজরে পড়ে গেলো, এবার তার কৌতূহল গড়ালো সেদিকে। সে জেসমিনকে বসতে বলে বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলো। তারপর সহকারিকে বললো, দু’কাপ চা দিয়ে যাও।’ বলে জেসমিনের দিকে তাকিয়ে অনুমতি নিলো, চা খান তো?
জেসমিন নিচের দিকে চেয়ে মাথাটা মৃদু কাত করলো। এতে পার্থর আরো ভালো লাগলো। ভালো লাগলো এজন্যে যে এটা সমপর্যায়ের মানুষের আচরণ। দুজন মানুষের ভেতর যে ব্যবধান, তা ঘোচাতেই অনেক সম্পর্ক অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যায়। যদিও জেসমিনকে ডেকেছিলো জাস্ট কৌতূহলে! মুনমুন মারা যাওয়ার পর ইদানীং রেখেঢেকে বিয়ের কথা উঠলেও আজ পর্যন্ত কারো মুখোমুখি হওয়া দূরে থাক, সাম্ভাব্য কারো নামও উচ্চারিত হয়নি বাড়ির কারো মুখে। তবে ক’দিন হলো জোরেসোরে ঘটক লাগিয়ে রাখা হয়েছে।
চা খেতে খেতে পার্থ ভাবছিলো, দাদিআম্মা ঠিকই বুঝেছেন, ও মেয়েকে কিছুই শেখাতে হবে না!
চা শেষ হয়ে গেছে। পার্থ বলে উঠলো, চাকরি ছাড়লেন কেন?
কোনো কিছু না ভেবে জেসমিন অকপটে কিছুটা হাসিতে বললো, নিজের চেয়ে চাকরিটাকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। যদিও কাটিংএর কাজটা আমি খুব চ্যালেঞ্জ নিয়ে শিখেছিলাম…। খুব কম মেয়েই আছে কাটিংমাস্টার হিসাবে।
পার্থ বুঝতে পারে না জেসমিনের বয়স কত! তবে যেভাবে সে কথা বলে অতটা প্রাজ্ঞ হওয়ার মতো বয়স তার হয়নি! বয়স বোঝার জন্যই পার্থ বললো, আপনার এসএসসি…।
: ২০০০. সেকেণ্ড ডিভিশন। আমাদের গ্রামের স্কুল …।’
পার্থ মনে মনে হিসেব করে পঁচিশ/ ছাব্বিশ হতে পারে বয়স। পারপর প্রশ্ন করে: তাহলে কোন সেন্সে বলছেন, চাকরিটা ছোট মনে হচ্ছে?
: আমি আসলে ঠিক এটাই বলতে চাইছি না!
: বলেন, আমি কিছু মনে করবো না! আপনার স-ব তথ্য মামীমা সংগ্রহ করে নিজে জেনে আমার অনুমতি নিয়ে তারপর আপনাকে ডেকেছিলেন। আমি অবশ্য সে জন্য আপনাকে ডাকিনি! এরজন্য আপনি চাকরিটা ছাড়লেন, তাই কেমন একটা কৌতূহল হলো!
: ওই যে বললেন, আন্টি আমার সব তথ্য জেনেছেন। যে যার যা জানে, সে তার মতো করে জানে। আসল সত্য থেকে কম জানা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি বেশি জানাও!
: তা ঠিক!
: কেউ যখন কারো সম্পর্কে অন্য কারো কাছে কিছু জানতে চায়, সে তো তাই বলবে, তার সাথে তার যেমন সম্পর্ক!
: তাও ঠিক।
: তবে তা নিয়েও আমার মাথা ব্যথা নয়!
: তবে?
: বিশাল একটা অফার আমাকে দেয়া হয়েছে। যার একটির ভেতর তিনটি ভূমিকা। এই প্রস্তাবটিই তো আমার জন্য শতজনমের পুণ্যের ফলের চেয়ে বেশি!
: তাহলে আপত্তি কোথায়?
: আমি দুটি মৃত সন্তান প্রসব করেছিলাম। তাও পেট কেটে বের করতে হয়েছে। সেই দাগ ছাড়া আমার বিবাহিত জীবনের আর সব চিহ্ন মুছে গেছে। সব বেদনাকে ওভারকাম করতে পারলেও নিজের সন্তানদের মা ডাক শোনার তৃষ্ণাটা কিছুতেই বুঝি কোনো নারীর প্রাণ থেকে যায় না!
: এটা জানতাম না তো?
: সে জন্যই বললাম, কারো সম্পর্কে খুঁটে খুঁটে তথ্য সংগ্রহ করা মানে তাকে জানা নয়!
: যা আপনি বললেন, আমার তাতে আপত্তি নেই।’ বলেই পার্থ ভাবলো, সে বুঝি নিজের অজান্তে, নিজের থেকেই অগ্রসর হচ্ছে! শেষে না আমাকে গায়েপড়া শুধু নয়, পানিতে পড়া, বিপদগ্রস্তও ভাবতে পারে।
: আপনি যদি বলেন, আমি আপনার ছেলেমেয়ের এমনিই সেবা করে নিজের মনের তৃষ্ণা মিটাবো। এর জন্য বিনিময়ে কিছুই চাই না! তবে সামাজিক অবস্থানগত যে দূরত্ব আমাদের দু’জনের, তা দেখেও, এবং এরকম একটি সম্পর্ক রেজিষ্ট্রী করা আমার প্রতি আপনার দৃষ্টির ভাষা সব সময় মনে করিয়ে দেবে, আমি এর যোগ্য ছিলাম না। কেউ আমাকে কৃপা করেছে, তখন নিজেকে ডানা ভাঙা পাখির মতোই মনে হবে। তারচেয়ে আমার এই ওড়ার ডানা দুটিই থাক! মনে থাক ওড়ার অবিরাম বাসনা!
খুব অল্পকথায় অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন। আসলেও তো ভেবেছিলাম, যা বললেন, ওইরকমই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্যকেউ কেড়ে নিলে, বা নিতে জানলে তার থেকে কোনো অধিকারই সরিয়ে রাখা যায় না!
: আজ উঠি?
: খুব তাড়া?
: না। তবে ঠিক হচ্ছে কি না। যা বলছি, তা বলবার জন্য জরুরী ছিল কি না!
: খুব জরুরী ছিলো। না হলে রাতে ঘুমের ব্যাঘাত হতো!
পার্থর কথা শুনে একটু হাসলো জেসমিন।
পার্থ বললো, এখন বোধহয় আমি আপনাকে বেশ কিছুটা বুঝতে পেরেছি। তাই আমার তরফ থেকে অসুবিধা হবে না। যদি আপনি রাজি থাকেন। আরেকটা কথা বলি, আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে থাকি তাদের কাছে থাকার জন্য নয়। তাদেরকে আগলে রাখার জন্যই। আমার মা’ও কিন্তু আমেরিকা থাকেন। তবে মামা-মামীমা খুবই ভালমানুষ। আপনাকে তারা খুবই ভালবাসবেন সে গ্যারান্টিও আমি আপনাকে দিতে পারি এবং আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি, আপনি ওনাদের বাকি জীবন মেয়ে হয়েই থাকতে পারবেন! সে যোগ্যতা আপনারও আছে।
: কী আশ্চর্য, দেখেন স্বামী মারা গেলে স্ত্রী যখন বিয়ে করেন, বা স্ত্রী মারা গেলে স্বামী বিয়ে করেন, আশপাশের সব মানুষ বাজে মন্তব্য করতে থাকেন। যে জৈবিক তাড়নায় থাকতে না পেরে বিয়ে করে ফেলেছে। বা একজনকে ধরে এনেছে। বেশির ভাগ সময় এমনি হয় এসব ক্ষেত্রে মন্তব্যের ভাষা। কিন্তু আসল সত্যটা দেখেন?
: কী?
: একমাত্র মেয়ের বিপত্নীক স্বামীকে বিয়ে দিতে মেয়ের মা-বাবাই মরিয়া! অথচ এই সমাজের খালি নিম্নশ্রেণির মানুষ নয়, সবখানে, সবস্তরে তারা ভুল সব বিষয় নিয়ে বাদানুবাদ করে। নিজের ভুল মতবাদ জোরালো ভাবে অন্যের ওপর চাপায়। কেউ কেউ কারো কারো আস্ত জীবন নষ্ট করে দেয়। অথচ কখনো অন্যের কষ্টটাকে কেউ নিজের কষ্ট বলে ভাবতে পারে না!
: ঠিক!
: রাত হলো। এখন উঠি?
: আমি যদি পৌঁছে দিই!
: সেটা আমার জন্য সুখের হবে না! কারণ আমার পথ আপনার পথের উল্টোদিকে!
: তাতে আপনার অ-সুখের তো কারণ দেখি না!
: নিজের সুখের জন্য, সুবিধার জন্য অন্য কাউকে কষ্ট দিতে হয় না।
: কেউ যদি অন্যের জন্য কষ্ট করে সুখ পায়?
: সেই মানুষই তো সমাজে বেশি থাকা উচিৎ ছিলো। তাহলে কারো ঘর ভাঙতো না। একই ঘরে বসবাস করেও কেউ কারো কাছে পরবাসী হয়ে থাকতো না!
: আজ রাত দশটায় আমার একটা ভার্চুয়াল মিটিং ছিলো। আজ না হলে আগামী সপ্তাহে আয়োজন করতে হবে। তবু চলেন আমি এগিয়ে দিয়ে আসি!
গাড়িতে তারা দুজন ছাড়াও আরো একজন ছিলো, ড্রাইভার। তারা বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না! গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে জেসমিন শুধু কর্মজীবি মহিলা হোস্টেল বলতেই, পার্থ বললো, আপনি হোস্টেলে থাকেন জানতাম না তো!
: সেজন্যই তো বললাম, কারো সম্পর্কে অনেক জানা মানেই সব জানা নয়। দেখবেন বেশির ভাগই ভুল। আর নিগূঢ় সত্য যা, তার কিছুই জানে না!’
তারপর আবার দীর্ঘ সময় কারো সাথে কারো কথা নেই। হোস্টেলের কাছে গাড়ি থামাতেই ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে যায় জেসমিন। কিন্তু নেমেই হেঁটে চলে যায় না। গাড়ি চলতে চলতে পার্থ খেয়াল করে, জেসমিনের ভেতর অতি রঞ্জিত কিছু নেই। তবে ভব্যতা জ্ঞান পুরোই আছে।
গল্পটি এখানেও শেষ হতে পারতো। কিন্তু পাঠকের জন্য অপেক্ষা করছে এর থেকে বিস্ময়কর কিছু। সে পর্যন্ত আমরা অরেকটু এগোই!
০০০০০
মায়াবিবি তার ছেলে সাজ্জাদ খানকে ডেকে বললেন, জেসমিনের বাবার বাড়ির জন্য ওকে কিছু টাকা দিয়ে পার্থসহ পাঠাও। সেটাই শোভন। জেসমিন ওদের বাবার বাড়িতে একখানা ভালো ঘর আর ওদের পুকুরে একটা শান বাঁধানো ঘাটলা করার টাকা দিয়ে আসুক। একসময় তো তোমার নাতি-নাতনি যেতে চাইবে। সেটা খারাপ না। কোনো বাড়িতে ঢোকার সম্ভাবনাও মানুষের জন্য কল্যাণের সূত্র। অন্যের মেয়েকে নিজের মেয়ে করেছো, সেটা ঠিকাছে। তবে তার মা-বাবার সাথে যোগাযোগ রাখলে একটা আত্মীয়তার সূত্র বজায় থাকলে তার থেকেও একটা প্রশান্তি তোমাদের শেষ জীবনে আসবে।
জেসমিনকে কিছু বলতে হলো না, সবার কথা জেনে নিয়ে সাবরিনা খান প্রচুর কেনাকাটা করে সবচেয়ে বড় গাড়িতে করে তিনি জেসমিন ও পার্থকে জেসমিনদের বাড়ি পাঠালেন। জেসমিন তার মা-বাবাকে জানায়নি তার বিয়ের কথা। শুধু যাওয়ার দিনক্ষণ যখন ঠিক হয়েছে, তখন বলেছে আমি অমুকদিন আসবো। তোমরা বাড়িঘর পরিস্কার রেখো। ঘরে ক’দিনের ভালো খাবারের জোগাড় রেখো। আমার সাথে আমার অফিসের ক’জন কলিগ আসবে।
জেসমিন, পার্থর গাড়ি যখন ফেরিতে। পদ্মার মাঝামাঝি প্রায়। জেসমিনের চোখ মানুষের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা একলোকের মুখে আটকে গেলো। কার মতো লাগছে লোকটাকে সে মনে করতে পারছে না, নাকি মনে করতে চাইছে না! কিন্তু মনে যখন করতে পারলো, তার মনে পড়লো, একদিন ছোট ভাইটি ফোন করে বলেছিলো, কবিরুল ভাই গাড়ি এক্সিডেন্ট করে পঙ্গু হয়ে গেছে। তোমার ডিভোর্স দেয়া সে নাকি সহ্য করতে পারেনি! জেসমিন তাকে ধমকে থামিয়ে দিয়েছে। সে আর শুনতে চায়নি! মা-বাবারও সাহস ছিলো না, ওই নাম তার কাছে উচ্চারণ করে। সে পরিচিত এলাকা ছেড়েছে। ফোনের নাম্বার পর্যন্ত পাল্টে ফেলেছে ওই নামটি না শোনার জন্য। তারপরও জেসমিন নিজের অজান্তে কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টেনে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত, ব্যাগে তার নিজের যা কিছু টাকা ছিলো, তার সবই ওই সাহায্যপ্রার্থী মানুষটির হাতে গুজে দিয়ে আবার এত দ্রুত ফিরে এলো, যে তার নিঃশ্বাসের শব্দে সে নিজেই বিব্রত হলো।
জেসমিন গাড়িতে ফিরে এসে ঠিক হয়ে বসার পর পার্থ জানতে চাইলো, তুমি এত ক্ষিপ্র বেগে গেলে কেন? আর ওভাবে ফিরেই বা এলে কেন? খুব অস্বাভাবিক লাগলো দেখতে!
: আমার কিছু টাকা ছিলো। তাই ওই পঙ্গু লোকটাকে দিলাম। ওটা আমার তরফ থেকে তোমাকে পাওয়ার সদকা দিলাম!’ আর মনে মনে জেসমিন বললো, ও-ই তো আমাকে এতকিছু পাইয়ে দিলো!
জেসমিন এভাবে দৌড়ে কাউকে সাহায্য করে এলো, তাতে পার্থর যতটা না অস্বাভাবিক লেগেছে, তারচেয়ে বেশি অস্বাভাবিক লাগছে জেসমিনের হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া। কারণ সে অনেকদিন পর এভাবে বাড়ি গিয়ে সবাইকে চমকে দেবে, সেই চমকের আগাম জের হিাসাবে সে নিজেই চমকাচ্ছিলো আর বলছিলো, আমার ছেলেমেয়ে দুটিকে রেখে এই দুদিন আমার দূরে থাকতে ভাল লাগবে না। কিন্তু তাদের থাকার ব্যাবস্থা করে গেলে আর পদ্মাসেতু হয়ে গেলে আমরা প্রতিমাসে একবার করে ওদেরকে বেড়াতে আনতে পারবো। ওদেরকে আমি নিজে ধরে বুকের নিচে হাত দিয়ে সাঁতার শিখাবো! বড়শি দিয়ে মাছ ধরে কত আনন্দ পাবে ওরা। এসব ভাবতেই আমার খুব ভালো লাগছে! ভাবতে ভালো লাগছে আমার মা-বাবা তোমাকে পেয়ে কত খুশি হবে!
এখন মুহূর্তে মেঘে ছেয়ে গেলো জেসমিনের উদ্ভাসিত সেই মুখ। পার্থর নিজেরও খুব বেশি কথা বলার অভ্যাস নয়। তাই সেও চুপ হয়ে শুধু নয়, চুপসেই থাকলো।
জেসমিন তার ছেলেদের কবর যখন একা দেখতে গিয়ে আর খুঁজে পায়নি। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলে নিজের অজান্তে তার পেটের দাগটিতে হাত চলে যায়। মনে হয় এখানেই আছে তারা। এই দাগটিতে মিশে! ওই দাগটিকেই তার মনে হয় আসল প্রেমিক। পরাণসখা! সে তারই উদ্দেশ্যে মনেরও অগোচরে নিজের মতো মাত্র একখানা লাইন গেয়ে ওঠে ‘ এই-যে ব্যথার রতনখানি আমার মনে দিলো আনি…।’