গল্প : উপন্যাস

উপন্যাস
তনিমা সাহা
“অ্যাই বুড়ো..বুড়ো। অ্যাই বুড়ো..শুনতে পাচ্ছিস না কি…অ্যাই বুড়ো…”।
লতিকা একটানা ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু বুড়োর কোনো সাড়া-শব্দই নেই। একটানা ডাকতে ডাকতে লতিকা বুড়োর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই লতিকার মুখের শব্দ মুখেই রয়ে যায়। বিছানায় চিৎ হয়ে খোলা চোখে শুয়ে আছে বুড়ো মানে ‘তপোধর’। ষাটোর্ধ্ব লতিকার চশমার মোটা কাঁচ দিয়ে তপোধরের বুকটা স্থির কিনা বুঝতে পারছিলেন না। একবুক মেঘ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন তপোধরের বিছানার সামনে। দেখেন তপোধরের বুক ওঠা-নামা করছে না, বাঁহাত দিয়ে বুকটা চেপে রেখেছে, সারা মুখে এক ভীষণ বেদনার স্পষ্ট ছাপ।
লতিতা সভয়ে দু’কদম পিছিয়ে দরজার দিকে মুখ করে চিৎকার করে বললেন, “ওরে, কে কোথায় আছিস। শিগগির আয়। দেখ কি সর্বনাশ হয়ে গেছে”।
বাড়ির রাধুনী মোতি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার বোসকে ডেকে নিয়ে এল। ডাক্তার বোস তপোধরের নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন, “খুবই দুঃখিত লতিকা দেবী। এনার হার্ট অ্যাটেক হয়েছে। হয়তো ভোরের দিকেই অ্যাটেকটা হয়েছিল। আমি একটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিচ্ছি”।
বাড়ির জমাদার মকবুলই ছুটোছুটি করে লোক জড়ো করে তপোধরকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল।
লতিকা সেই যে ডাক্তার বোসের কথা শোনার পর নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিলেন আর বাইরেও বেরোন নি। তপোধরের শেষযাত্রার সময় মুখটা বাড়িয়ে একটু দেখেই আবার দরজায় খিল দিয়ে দিলেন। মকবুল আর মোতি লতিকাদেবীর
স্বভাব সম্বন্ধে খুব ভালভাবেই অবগত আছে। তাই ওরা দুজনে মিলেই বুড়ো মানে তপোধরের শেষকৃত্য সম্পন্ন করল। তপোধর ছিল এ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো চাকর।
মোতি রাতে লতিকার সাথে থাকতে চেয়েছিল… বুড়ো মানুষ একা বাড়িতে কি করে থাকবেন। কিন্তু লতিকা প্রায় জোর করেই তাকে বাড়ি পাঠালেন। পরের দিকে দুটো চিড়েমুড়ি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পরলেন। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারবার তপোধরের চেহারাটা মনে পড়তে লাগল।
লতিকা যখন দশ বছর তখন একদিন লতিকাদের বাড়িতে ‘বুড়ো’ এল। বাসা-ভিটেহীন গরিব ছেলে দেখে লতিকার মা তাকে কাজে রাখলেন। নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলল, “তপোধর”।
মা বললেন, “ওরে বাবা এত বড়ো নাম ধরে ডাকতে হবে। আমি বরং তোকে ‘বুড়ো’ বলেই ডাকবো”।
লতিকার পরিবার বেশ অবস্থাপন্ন ছিল। কিন্তু লতিকার দিকে তাকানোর সময় কারোর নেই। ছোট থেকেই লতিকা প্রচণ্ড একরোখা, কারোর কথা শুনতেন না। বুড়োর দায়িত্ব ছিল লতিকার পেছন-পেছন ছায়ার মত চলা।
সময় পেরিয়েছে দূর্বার গতিতে। লতিকার বুড়োর প্রতি একটা বিশেষ টান সৃষ্টি হল। সবার সামনে তপোধরকে ‘বুড়ো’ বলে ডাকলেও আড়ালে তাঁকে ‘তপু’ বলে সম্বোধন করতেন। অবশ্য সেকথা বুড়োর কান অব্দি পৌঁছেছে কিনা জানা নেই।
লতিকাকে অনেক জোড়াজুড়ি করেও বিয়ে করানো যায় নি। বয়সের সাথেসাথে লতিকা আরো খিটখিটে হয়ে উঠলেন। বুড়ো এখনও লতিকার পেছন-পেছন ছায়ার মতই থাকে।
আজ বুড়ো নেই। এক অব্যক্ত অভিমান গরম জল হয়ে লতিকার গাল বেয়ে নেমে আসে। রাতের প্রহরগুলো তখন যেন আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। লতিকা বিছানার এক ধারে শুয়ে আছেন। আজ আর ঘুম আসছে না। তপোধরের শেষবেলার চেহারাটা বারবারই ঘুরেফিরে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
তপোধরকে লতিকার বাবা বিয়ে দেওয়ার বহুচেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তপোধরের ওই এক কথা, “না….আমি নিজেই আপনার অন্ন খাই। আবার অন্য কাউকে নিয়ে এসে আপনার অসুবিধা করতে চাই না। আমি একাই ভাল আছি”।
লতিকার বাবা আর কথা বাড়ান নি। লতিকা ভাল চাকরি করতো। কিন্তু যখন তাঁর বিয়ের সময় হল তিঁনিও বেঁকে বসলেন। লতিকার জেদের কথা বাড়ির সকলেরই জানা ছিল। সময়ের চাকা গড়িয়ে সাঁজের বাতি জ্বলল। কিছু বছর পর লতিকার বাবা এবং মা মারা গেলেন। লতিকা তখন চল্লিশ তপোধরের সাতচল্লিশ। বাড়িতে কাজের লোক তিনজন। লতিকা এত খিটখিট করতো যে কাজের লোকেরা আড়ালে তাকে ‘খেঁটিয়া বুড়ি’ বলে ডাকত।
কিন্তু তখনও বুড়ো ছায়ার মত লতিকার পেছন-পেছন থাকত। লতিকার কখন কি প্রয়োজন হয় সব বুড়ো সাজিয়ে রাখে। তবে খিটখিটে লতিকা তাকেও দু’কথা শোনাতে ছাড়তেন না। বাড়ির কাজের লোকেরা বলতো, “আপনার গোটা জীবনটা আপনি শুধু এ’বাড়ির সেবায় লাগিয়ে দিয়েছেন। নিজের জন্য কখনও ভাবেননি। তা-ও খেঁটিয়া বুড়ি আপনাকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। আপনার রাগ হয় না…”।
একটু হেসে তপোধর বললেন, “মালিকবাবুর অনেক ঋণ আমার ওপর। উনি যদি সেময় আমাকে এখানে না নিয়ে আসতেন তাহলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। হয়তো পেটের দায়ে অপরাধ করতাম। বা আরো খারাপ কিছু হতে পারতো। মালিকবাবুর দয়ায় আজ একটা সুস্থ জীবন পেয়েছি। তাছাড়া এ’বাড়ি, এ’বাড়ির লোকজন আমার দায়িত্ব। এই গুরু দায়িত্ব থেকে কিভাবে মুখ ফিরিয়ে নেই বলো তো”।
কথাগুলো বলে তপোধর সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে উঠে চলে এলেন। কারণ ওনার চোখদুটো ছলছল করে উঠেছিল। বাইরে আসতেই চোখের জল বাঁধ মানে নি। মনে মনে বললেন, “আমি এ’বাড়ির চাকর ভিন্ন আর কিছুই নই। তাই তোমাকে পাওয়ার আশা করা স্বপ্নেরও অতীত। তার চেয়ে এই ভাল। রোজ তোমাকে দেখি। তোমার আশেপাশে থাকতে পারি। এটাই আমার প্রাপ্তি। এই শূণ্যতার মধ্যেও এক প্রশান্তির পূর্ণতা রয়েছে। আমি এতেই খুশি”।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে লতিকা ছটফট করছেন। এই এতো বছরে একদিনও এমন হয় নি যে তিঁনি একা থেকেছেন। প্রতি সময় প্রতি ক্ষণে তিঁনি কারণে-অকারণে তপোধরকে পাশে পেয়েছেন। কিন্তু আজ…আজ উঁনি বড্ড একা..বড্ড অসহায়। এই ঘর..এই বাড়ির প্রতিটি কোনা যেন তাঁকে তপোধরের অভাবটা তীব্র ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে আসলেন লতিকা। দক্ষিণ দিকের জানলাটা আজ বন্ধ।ওই জানলাটা খুললে তপোধরের ঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়। মাঝে মাঝে যখন বুকে চাপা কথাগুলোর গুমরানো যন্ত্রনায় কষ্ট পেতেন তখন এই জানলার সামনে এসে দাঁড়াতেন। আশ্চর্যজনক ভাবে তখন তপোধরকেও দেখা যেত ঘরের মধ্য পায়চারি করছিল। বহুরাত এভাবেই তপোধরকে জানলা দিয়ে শুধু দেখে কাটিয়েছেন। কিন্তু কখনও মুখ ফুটে কিছু বলেন নি। শুধু অপেক্ষা করে গেছেন এই আশায় যে হয়তো কোন একদিন সে-ই এগিয়ে এসে নিজের মনের কথা বলবে। কিন্তু শুধু অপেক্ষাতেই বেলা শেষ হল….কেউ-ই আর মনের না-বলা কথাগুলোকে মুখে আনতে পারেন নি। আজ দক্ষিণ জানালায় দাঁড়িয়ে ওপাশের বন্ধ ঘরের দিকে তাকাতেই লতিকার চোখদুটো জ্বালা করে উঠলো। অবিলম্বেই দুচোখ ছাপিয়ে গরয় নোনাজলের প্লাবন শুরু হল।
“তুমি কাঁদছ….লতা”।
খুব চেনা স্বর এটা। হাতের চেটো দিয়ে চোখের জলে প্লাবিত গালদুটো মুছে অস্ফুটে বললেন, “তপু…। তুমি..”।
“হ্যাঁ লতা….আমিই..”।
“তপু….তুমি কেন চলে গেলে। আজ যে আমি বড়ো একা হয়ে গেলাম”।
“নিয়মের বাঁধন লতা। সেকি তুমি-আমি খণ্ডাতে পারি। শুধু একটি কথা তোমায় জানাতে এলাম। যে কথাটি না বললে আমার মুক্তি নেই। ওপারে গিয়েও আমি শান্তি পাবো না…সেকথাটি তোমাকে জানাতে এলাম…”
“কি কথা….”
“আমার প্রতিটি স্পন্দনে শুধু তুমি আছো লতা। মনে মনে প্রতিদিন এই ‘লতা’ নামে তোমাকে ডেকেছি। কিন্তু বলতে পারি নি। মালিকবাবুর কৃতজ্ঞতা বারবার আমার মুখ চেপে ধরতো।…..ও কি…. তুমি কাঁদছ কেন লতা? আর কষ্ট পেও না। আমি এখন যাই…তুমি ভাল থেকো লতা”।
লতিকা দু’হাত দিয়ে ঢেকে ক্রমাগত ফুঁপিয়ে যাচ্ছেন। একটানা কাঁদার ফলে ওনার মুখ-চোখ ফুলে উঠেছে। কান্নার দমকটা যথাসাধ্য চেপে তিঁনি বললেন, “না…না..তপু যেও না। তুমি বাবাকে কথা দিয়েছিলে যে যেমনই পরিস্থিতি হোক না কেন তুমি সবসময় আমার খেয়াল রাখবে…আমার পাশে থাকবে। তাহলে…আজ…আজ কিকরে চলে যাচ্ছ তুমি। আমার এই জীবন তুমি ছাড়া কিছু নয়। আমার আমিত্বে শুধু তুমি বিরাজ করো তপু। যেও না তপু আমাকে ছেড়ে..”।
“না…লতা। তা হয় না। আমার সময় হয়ে এসেছে। এবার আমাকে বিদায় দাও”।
“বেশ…তবে আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলো”।
“না..না…তা কি করছ সম্ভব”।
“সব সম্ভব। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার কাছে বিষময়। আজ আমি তোমার হাত ধরেই আমার শেষযাত্রা করবো। সারাজীবন যে ভালবাসার জন্য আমি অপেক্ষা করেছি আজ তাকে পেয়ে এভাবে ছাড়তে পারবো না”। লতিকার স্বরে খুব দৃঢ়তা শোনায়।।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপোধর বলে, “বেশ তবে….এসো”।
লতিকা স্পষ্ট বুঝতে পারেন একটা বায়বীয় শীতল কিছু উঁনার ডানহাতটিকে স্পর্শ করলো। খানিকটা শিহরিত হলেন তিঁনি। এরপর তপোধরের হাত ধরে সমস্ত অন্ধকারকে পরাজিত করে এগিয়ে গেলেন আলোর পথের দিকে।
সকাল বেলা মোতি ঘরে ঢুকে দেখে তাদের ‘খেঁটিয়া বুড়ি’ বিছানায় শুয়ে আছেন কিন্তু তাঁর শ্বাস চলছে না। মুখে ছড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছায়া।
ডাক্তার বোস এসে ডেফ্থ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে মকবুলকে বললেন, “স্ট্রেঞ্জ…..দুজনের মধ্যে এতটা টান ছিল। সেটা তো কখনও বোঝা যায় নি”।
মকবুলও ডাক্তার বোসের কথায় সম্মতি দেয়।
মোতি আর মকবুল স্থবিরের মতো প্রাণহীন লতিকার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগল।