গল্প:একজন পারুলের কথা

গল্প:একজন পারুলের কথা

একজন পারুলের কথা
স্বাতী চৌধুরী

– ছেলের নাম কি যেন রেখেছো কাকী ?
– নয়ন।
-নয়ন ?তা নয়ন এর মুখের আদলটা যে একদম সিরাজের মতো! সেই চোখ,নাক,মুখ এমনকি হাসিটাও।সে কি করে হয়? বাপ মা কারোর সাথে মিল নেই।মিল হলো কিনা যার সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই, জাতের মিল নেই।নয়নের মা চুপ করে থাকে।কারন এজাতীয় প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে সে ভেবে পায় না।
– ছেলের বয়স কতো ? আবার প্রশ্ন আসে।
পনেরো বছর ? আচ্ছা!পনেরো ষোলো বছর আগে তোমাদের একটা দোকান ছিল।সিরাজ তোমাদের সেই দোকানে চাকরি করতো?ঠিক বলছি?তা তুমি কি ছেলেকে পেটে নিয়ে রোজ ভোরবেলা সিরাজের মুখ দেখতে? তাই কি ছেলে সিরাজের চেহারা পাইলো ?
আহ শেলী একসাথে অত প্রশ্ন করে কেউ ? থামো এবার।
আরে সেই সময় তুমিওতো এ বাসায় পেয়িংগেস্ট থাকতে তাই না ?
হ্যাঁ থাকতাম।তাতে কি হলো?
কিছু হয়নি।জানতে চাইছি এদের দোকানে যে সিরাজ চাকরি করতো সেটা তোমার মনে আছে কিনা ?
না মনে নেই।চামেলির কন্ঠে মহাবিরক্তি।নয়ন আশেপাশেই ঘুরছে।যদি শেলীর এসমস্ত বাজে কথা ছেলেটার কানে যায় কেমন হবে?তাই সে শেলীকে থামাতে চাইছে।কিন্তু শেলীর লক্ষ্য যেন একটাই।গর্ত খুড়ে গুপ্তধন খোঁজার নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে।
শেলী বললো,আশ্চর্য তোমার মনে নেই অথচ আমার মনে আছে।
-তাইতো,আশ্চার্যই বটে।সেইযে আমি ওদের বাসা ছেড়ে একেবারে অন্য শহরে চলে গেলাম গত পনেরো বছরে এশহরে দুএকবার এলেও এদের বাসায় আসার সুযোগ আমার হয়নি।নয়নকে এই প্রথম দেখলাম আমি।
-কাকী নয়ন কোন ক্লাসে পড়ে?
চামেলী প্রসঙ্গ ঘুরানোর চেষ্টা করে।নয়নের মা পারুল এখনো তরুণীই বলতে গেলে।মাত্র কিছুদিন আগে সে বিধবা হয়েছে।সে জানেনা তাতে তার শোকের মাত্রা কতটা তবু অবান্তর প্রশ্ন তাকে মর্মাহত করবেই।তাছাড়া শেলী তার প্রশ্নে যে বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করছে এটা অভদ্রতাই শুধু নয় ইতরামি এমনকি অপরাধও বলা যেতে পারে।কারোর একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়ে উঁকিঝুঁকি মারা কেবল অভদ্রতাই নয় রীতিমত ট্রেসপাস বা অবৈধ অনুপ্রবেশ।
শেলী তাও থামেনা।বলে, আমার মনে আছে তুমি যখন থাকতে তখন সিরাজ এই বাসায় ছিল আর তখন বিয়ের পাঁচ ছয় বছর পর কাকী প্রথম প্রেগন্যান্ট হলো।
তাতে কি হয়েছে?
না ছোটবেলায় যে শুনতাম রানী গর্ভের আগের পিরিয়ডের দিন ঘুম থেকে ওঠে বান্দরের মুখ দেখেছিল বলে রাজপুত্রের চেহারা বান্দরের মতো হয়েছিল সেকথা মনে পড়ে গেল।এই আর কি ? বলতে বলতে শেলী হাসে। আর চামেলীর প্রচন্ড রাগ হয়।তার ইচ্ছে হয় বলে যে, শেলী খামোকাই তুমি গ্র্যাজুয়েট হয়েছো,খামোকাই তুমি একটা হাইস্কুলের শিক্ষক।খামোকাই তুমি গ্রামের লোকের নিকট শহুরে হওয়ার অহংকার করো।আসলে তুমি নিজেও একটা মস্ত গাঁইয়া,একটা মহামূর্খ তুমি।কিন্তু সে বলেনা।সে বুঝতে পেরেছে শেলীর সাথে কথা বলে লাভ নেই।আদতে সে বুঝতে পারেনি যে শেলী দিনে দিনে একটা মহামুর্খে পরিণত হয়েছে।অল্প বয়সের চপলতা যে সে এখনো বহন করে চলেছে তা যদি জানতো তবে সে শেলীকে নিয়ে এ বাসায় আসতোনা।
গ্রামের মেয়ে চামেলী যখন কলেজে বিএ পড়তো তখন পারুলের বাসায় পেয়িং গেস্ট থাকতো।শেলী তার ক্লাসমেট ছিল।আর পারুলদের প্রতিবেশীর বাসায় তার আত্মীয়রা ভাড়া থাকতো। সেই সুবাদে এ পাড়ায় এলে চামেলীর সাথেও দেখা করতে আসতো।চামেলীর যতদূর মনে পড়ে শেলী পড়াশোনার বেলায় টনটনে ছিল। ক্লাসে স্যারেরা কি বুঝিয়েছেন আগের ক্লাসে তা তার মনেও থাকতো না। পাশের বেঞ্চির পরীক্ষার্খীর দয়া ও টুকলি করে সে বিএ পাশ করেছে।আর চামেলীর সাথে দেখা করতে এসে এইটুকু আলাপ পরিচয়ের সূত্রে পারুলের প্রেগন্যান্সি,তাদের দোকানে সিরাজ নামের ছেলের চাকুরী করা সবস্মৃতি মনে রেখে দিয়েছে শেলী।অথচ চামেলী এবাসায় থেকে বছর খানেক ধরে সিরাজকে দেখেছে কিন্তু তার ঐ ছেলেটার চেহারার কথা মনেও নেই।শেলী না বললে নয়ন যে দেখতে হুবহু সিরাজের মতো হয়েছে চামেলীর মনেও পড়তো না।কিন্তু শেলী যা ইঙ্গিত করছে সেসবের আঁচও যে চামেলী সেসময় পায়নি তাওতো নয়।বিএ ক্লাসের শেষের দিকে সিরাজ পারুলের প্রায় বৃদ্ধ বর যামিনী বাবুর দোকানে কাজ শিখতে আসে।সিরাজের মা যামিনী বাবুকে ধর্মের ভাই ডেকেছিল।আর এই ধর্মের ভাই বোন আপন ভাইবোনের অধিক ছিল। সিরাজের মা এসে কান্নাকাটি করে বলেছিল দাদাগো!আমার সিরাজটা নষ্ট হয়ে গেল বুঝি।গত চারপাঁচবছর ধরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বন্ধুদের সাথে ক্যারম খেলে আর সিনেমা দেখে।তুমি ছাড়া আর কার কাছে যাই যে আমার ছেলেটার একটু গতি কেমনে হয় তা কই। জানি তোমার দোকান বেতন দিয়ে কর্মচারী রাখার মতো না।তোমাকে বেতন দিতে হবে না।তুমি শুধু তারে কাজ শিখবার সুযোগটা দেও দাদা।
যামিনীবাবু খুশি হয়েই পাতানো ভাগ্নেকে দোকানে রেখে দিলেন।বোনকে বললেন হ্যাঁ আমি তাকে বেতন দিতে পারবো না।তবে ও তিনবেলা আমার এখানে খাবে।কারন ও থাকলে আমার কাজেই লাগবে।আসলে একা একা দোকান চালানো যায় না।বাজার হাটে যাওয়া লাগে,মাঝে মাঝে সামাজিকতাও রক্ষা করা লাগে।তখন দোকান বন্ধ করে যেতে হয়।তুই বোন আমার উপকারই করলি মনে হয়।
কথামতো সিরাজ চলে এল দোকানে। ক্লাস টেন পর্যন্ত সে পড়েছে ।হিসাব নিকাশ বুঝতে দুচারদিনের বেশী লাগেনা।যামিনীবাবু পাতানো বোনের উপর বড় প্রসন্ন হন।দোকানেরই কাজে বা অন্য কাজে বাইরে গেলে দোকানটা বন্ধ করতে হয় না।কিন্তু এই আরাম বেশী দিন টেকসই হলো না। ছেলেটা ফাঁকিবাজ।কাজে মন বসে না।কেবল বন্ধুরা টানে। মাঝে মাঝেই দোকানে আসেনা।ওর মা জানে সে দোকানেই আসে।কিন্তু সে যায় সিনেমা দেখতে।কোন বন্ধুর বাসায় ভিসিআর না ভিডিও আনছে। তাই সারাদিন খালি সিনেমা নিয়ে মশগুল হয়েছে ওরা।।যামিনীবাবু নতুন ফন্দি আটেন।বোনকে বলেন তোর ছেলে দিনেরাইতে আমার বাড়ি থাকবে।চোখের সামনে থেকে দেখি পলায় কি করে ?
সিরাজ আর পলায়নি।রাতে সে দোকানেই ঘুমায়।যদিও দোকান সংলগ্ন আরেকটা ঘর আছে সে ঘরেই তার কাপড় জামাও থাকে এবং ঐ ঘরের একটা টেবিলে সিরাজের তিনবেলার খাবার রেখে দেয় পারুল।একটা চৌকিও আছে সে ঘরে তবু ঐ ঘরে সে ঘুমায় না। দোকানঘর আর সে ঘরটা এমন যে ঘরদুটো থেকে সরাসরি মূল ঘরে যাওয়ার বা মূল ঘর থেকে ঐঘরদুটোতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাতে মূল ঘরের গেট বন্ধ করলে দোকান থেকে এ ঘরে আসার সুযোগ নেই। তবে দোকান কোঠা থেকে একটা করিডোরের মতো আছে সেটা দিয়ে সিরাজ যে ঘরে জামা কাপড় রাখে তার দরজা খুলে উঠান পেরিয়ে সে বড় ঘরের পেছনে বাথরুমে যেতে পারে।যামিনীবাবু একটু বেশী মাত্রায় সচেতন । বাইরের মানুষ নিয়ে যাতে বসবাসের ঘরের সাথে তেমন সংযোগ রাখতে না হয় সেজন্যই এইটুক জায়গার মাঝে এতোরকম ব্যবস্থা করে রেখেছেন।টেবিলে সিরাজের খাবার দেয়া হয়েছে একথা পারুল যামিনীবাবুকে জানায়।তিনি সিরাজকে বলেন,যা, খেয়ে আয়।কিন্ত এই সতর্কতার বেড়া ভেঙ্গে যায় মাঝে মাঝে। খেতে বসে সিরাজ প্রায়ই মামীর উদ্দ্যেশ্যে ডাকাডাকি করে। অ মামী একটু ভাত লাগবে বা অ মামী একটু ডাল দেন। একটা কাচামরিচ দেন।
যামিনী বাবু বলেন সবকিছু একটু বেশী করেই দিয়ে দিও।তাতে অপচয় হলে হবে।বারবার যাওয়া লাগেনা তাতে।
আবার ঘরের বাজার যা নিজেদের দোকানে আছে যেমন ডাল,লবণ, তেল, পেয়াজ, রসুন, আদা,চাপাতা চিনি দুধ সব একসাথে বেশী করে এনে রাখেন যামিনীবাবু।তাওতো মাঝে মাঝে ফুরিয়ে যায়।হঠাৎ দরকার পড়লে করিডোর দিয়ে দোকানকোঠায় উঁকি দেয় পারুল।যামিনীবাবু চোখ পাকিয়ে বলেন এখানে কী?এমন সতর্কতায় পারুলের অপমান লাগে।তাহলে আর ছেলেটাকে বাড়িতে রাখা কেন?
-পেঁয়াজ নাই।কখনো বলে,চিনি চা পাতা লাগবে।
-এসব দরকারের কথা ঘরে যখন থাকি বলতে পারো না? খালি দোকানে আসা চাই।আসলেতো রাস্তার মানুষ দেখা চাই।যামিনীকান্ত গজগজ করতেই থাকেন।
চামেলীর কানে আসে সেসব কথা।ভদ্রলোক মাঝে মাঝে চামেলীকেও শাসন করেন।যেদিন কলেজ থেকে ফিরতে দেরী হয়ে যায়।
-মনে রাখিস মেয়ে,তোর বাপ তোরে আমার দায়িত্বে রেখে গেছে।কোনো অঘটন ঘটলেতো দায় আমার হবে।
অঘটন বলতে তখন কোনো ছেলের সাথে প্রেম করে পালিয়ে যাওয়াকেই বোঝত মানুষ।কয়েকদিন আগে চামেলীর এক বান্ধবী এভাবে পালিয়েছিল।চামেলী তর্ক করে।
-কেন দায় হবে কেন?আমি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে।কারো সাথে পালিয়ে গেলে সেতো আমার দায়িত্বে যাবো।
-তুমি পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে নও গো,সে আমি জানি।কিন্তু দেশকাল ভালো না।কোনখানে কোন বিপদ লুকিয়ে থাকে তুমি কি করে জানবে?কত বয়স তোমার? পড়াশোনায় ভালো হলেই কি সব জানা যায়?বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি।শোনো,মেয়েদের পদে পদে বিপদ।সাধে কি তোমার বাবা তোমারে আমার বাসায় রাখছে?শহরে আর বাসা ছিল না?
তার উপর যামিনীবাবুর এতো বিশ্বাস আছে জেনে চামেলী আর তর্ক বাড়ায় না।সিরাজের বিষয়ে এতো সতর্কতা তবে তাকে নিয়ে নয়।স্ত্রী পারুলকে নিয়েই যে তার এত সংশয় বুঝতে বাকী থাকেনা চামেলীর।তাও মনে মনে সে ক্ষুব্ধ হয় যামিনীবাবুর ওপর।এতোই যদি সন্দেহ তাহলে আর যুবতী মেয়ে বিয়ে করো কেন?সংসার চালানোর জন্য মধ্যবয়সী কাউকে কাজের লোক রাখলেই হতো।না নিজের শখ আছে নতুন বউ নিয়ে সংসার করার আবার অবিশ্বাসও থাকবে? চামেলী তখন বুঝতো না কেন এই অবিশ্বাস।তখনতো বয়স কম ছিল।নরনারীর অন্তর্গত জীবনের কীইবা ধারণা ছিল তার? তাছাড়া শেলীর মতো এত ইচঁড়েপাকাও সে ছিল না।কিন্তু পারুলের জীবনের টানাপোড়ন ও লুকোচুরি তার কাছে মানুষের জীবনের অনেক অজানা রহস্য উন্মোচিত করেছিল যা সেই সময়ে তার বোঝার কথা নয়।
সেই সময় যামিনীবাবুর বয়স ষাটের মতো হলেও পারুলের বয়স ছিল চামেলীর থেকেও কম। পারুলের মুখ থেকেই চামেলী তার শৈশব কৈশোর ও বিবাহ পর্যন্ত জীবনের দুঃখময় দিনগুলোর বর্ণণা শুনেছিল।তাই মাঝে মাঝে তার সাথে কিছু বাজে ব্যবহার করলেও চামেলী পারুলের প্রতি রাগ করতে পারতো না।তার শুধু মনে হতো আহারে!সে কত কষ্টের জীবন কাটিয়ে এসেছে।সেই কষ্টের জীবনের তুলনায় প্রায় বৃদ্ধ যামিনীবাবুর স্ত্রী হওয়াতে আপাতত খাওয়াপরার কষ্ট থেকে মুক্ত হলেও আঠারো ঊনিশের এক তরুণীর পক্ষে ষাট বছরের খিটখিটে বুড়োর সংসার করা যে কম কষ্টকর নয় সেটা প্রায়ই মনে হতো চামেলীর। কিন্তু এটাতো ছিল কষ্টকর জীবনের বাইরের স্বরূপ ।অন্তর্গত স্বরূপটা কি সেসম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলনা তার তবু সে বুঝতো, ভেতরে ভেতরে কি যেন একটা কষ্ট বয়ে বেড়ায় পারুল।
খুব ছোটবেলায় পারুলের বাবা মারা যায়-যে বাবার মুখ বা কোনো কিছুই তার স্মরণে আসেনা।তার বড় দুই বোন আর একটি ভাই ছিল।তার মা এদের নিয়ে খুব কষ্টে দিনপাত করে যাচ্ছিল।এ অবস্থায়ই বড় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিল।এসব কথা পারুলের মনে পড়ে না।কারন তার যখন পাঁচছ বছর বয়স সেসময় তার মাও মারা যায়।তার দিদিদের মুখে এসব কথা সে শুনেছে বড় হওয়ার পর।মা মারা গেলে তাদের নিসন্তান পিসিমা তিনভাইবোনকে নিয়ে আসেন।কয়েক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বোনটার বিয়ে দিলেন তিনি।ভাইটাও সতেরো আঠারো বছর বয়সী হওয়ায় গেরস্থ বাড়িতে কৃষিকামলা হিসেবে কাজ পেয়েছিলো।পিসিমা ভাবলেন এবার বোধ হয় সুদিন এলো।কিন্তু একদিন ভাইটিও নিখোঁজ হয়ে গেলো।অনেক খোঁজ করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি। আর এই শোক সামলাতে না পেরে পিসিমাও মরে গেলো।পারুল তখন মাত্র তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়ে।একের পর এক অভিভাবক হারিয়ে পারুল বিশাল এই পৃথিবীতে একা। আশ্রয়হীন।তার বোনেরা কান্নাকাটি করছিল নিরাশ্রয় বোনটির জন্য।বড় বোনের শশুড়বাড়ির মন গলেনি।তবে দ্বিতীয় বোনের শাশুড়ি বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন।তিনি এসে পারুলকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি।কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয়-যে ডালে ভরসা করে ভাঙ্গে সেই ডাল।দ্বিতীয় বোনের যৌথ সংসারে এক বউয়ের বোন দিনের পর দিন থাকছে খাচ্ছে এ নিয়ে অন্তর্কলহ শুরু হয়ে গেলো।
বোনের শাশুড়ি ছেলেদের বোঝাতে না পেরে একটু বিপাকে পড়লেন।তিনি ভাবতে থাকেন কি করা যায়!
হঠাৎ তার মনে পড়ে যামিনীবাবুর কথা।শহরে ডাক্তার দেখাতে গেলে বা দূর্গাপূজা দেখার জন্য শহরে গেলে তিনি যামিনীবাবুর বাসায় যান একটু জল খাওয়া বা টয়লেটে যাওয়ার জন্য। সে অনেক বছর ধরে।যামিনীবাবুর বউ তখন ছিলেন এবং যেদিন সে বউ ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে রেখে মারা গেলেন তারপরদিনও তিনি গিয়েছিলেন।এরপরও আরো অনেক দিন গেছেন।দেখেছেন সেই ছেলেমেয়ে দুটো,সংসারের কাজ বিশেষ করে রান্নাবান্না,আবার দোকান সামলানো নিয়ে লোকটির কি দিশেহারা অবস্থা।কাঁদো কাঁদো সুরে বলেছিলেন ও মাসী,একটা মেয়ে দরকার গো।আছেনি আপনাদের গ্রামে?কাজ করার লোক হলে বেশ বয়স্ক যদি হয় তবে ভালো,নয়তো এমন কোন গরীব মেয়ে যার গার্জেন বিয়ে দিতে পারছেনা-যদি থাকে আমি বিয়ে করে নেবো।
কিন্তু এ তো প্রায় বছর খানেক আগের কথা।এর মধ্যে শহরে যাওয়া হয়নি।যামিনীবাবু কি বিয়ে না করে আছেন এখনো ? সুরবালা পরদিন সকালেই শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে যামিনীবাবুর বাসায় গিয়ে উঠেন।না এখনো তার পক্ষে বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি।মেয়ে পাওয়া যায়নি বলে।এমন কি কোনো কাজের লোকও মেলেনি।
-আমার কাছে একটা মেয়ে আছে।আপনি বিয়ে করবেন বাবা? মেয়েটার বড় দুই দিদি ছাড়া আর কেউ নেই।এক দিদি আমার বউ।সেই সুবাদে আমার বাড়িতে আছে।কিন্ত আমার অন্য ছেলের বউরা সেটা পছন্দ করে না।মেয়েটা কই যায় বলুন?বড় ভাবনায় আছি।মায়াও লাগে।আপনার কথা মনে পড়ল।
অ মাসী তুমি ভগবানের দূত হয়ে এসেছো গো।কি যে বিপাকে আছি।না থাকুক তিনকূলে কেউ। তারতো দরকার নাই আমার।তা তুমি এখন তার গার্জেনতো?তুমি যেভাবে বলো,যেদিন বলো আমি তাতেই রাজী।
সেদিনের পরদিন সন্ধ্যায় শুধু দিদির বাড়ির লোকের উপস্থিতিতে এক পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণের ভেতর দিয়ে যামিনীবাবুর সাথে পারুলের বিয়ে হয়ে গেল আর সেদিনই এবাড়িতে এসে উঠল সে।যামিনী বাবু বললেন,আমিও গরীব মানুষ।এখানে অনেক কিছুর অভাব হবে তোমার কিন্তু এ তোমার নিজের বাড়ি।তবে তুমি ছোট মানুষ,অনেক কিছু জানো না।তোমার অনেককিছু শেখা লাগবে। আমি শেখাবো।কিন্তু কথায় কথায় না চললে বিপদ।
বিপদ! যামিনীবাবুর কথায় সে ভয় পেয়ে যায়। একেতো বুড়ো বর তায় আবার ভয় দেখায়। জড়সড় হয়ে থাকে পারুল।মাঐমা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে।ঝিয়ারী,জামাই খারাপ নয়।একটু বয়স বেশি,রাগও আছে কিন্তু কথাবার্তা শুনলে দেখবে আর কোনও ভয় নাই।
যামিনী বাবুর দশ বছরের ছেলেটা বলল বাবা, তুমি বিপদের কথা বলছো কেন ? মাসীতো ভয় পাবে।মা মরা ছেলেমেয়ে দুটি পারুলকে মূহূর্তে আপন করে নিল।মাকে হারিয়ে ওরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।কাল বাবা বলেছিল বিয়ে করে একজন মাসী নিয়ে আসবে যে তাদের রেঁধে বেড়ে খাওয়াবে আর আদরযত্ন করবে।আজ সত্যি সত্যি নিয়ে এসেছে বলে তারা খুব খুশি।
কি বুঝে যেন পারুল ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরল তারপর তিনবছরের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল।যামিনীবাবু পারুলের এই আচরণে খুবই সন্তোষ লাভ করেন।এরপর রান্নাবান্না ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ পারুলকে হাতে ধরে শেখালেন।চামেলী যখন এ বাসায় পেয়িং গেস্ট থাকতে আসে ততদিনে পারুল সকল প্রকার রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজকর্ম শিখে পাক্কা গৃহিনী।এমনকি পারুলের রান্না করা মরা শিং মাছের তরকারীও তারা হাত চেটে খায়।
বছর দুইতিনের ছোট আর বলতে গেলে অক্ষরজ্ঞানহীন পারুলের সাথে কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্রী চামেলীর ভাব হতে অসুবিধে হয়নি।সহজ সরল পারুল।তার সুন্দর মুখের অনিন্দ্য হাসিতে মুগ্ধ চামেলী।তার কাছে সে পরিবারের ও গ্রামের গল্প করতো।পারুলও তার ফেলে আসা জীবনের সুখদুঃখের কথা বলতো চামেলীকে।সে আরো বলতো,তুমি আসাতে আমার একটা কথা বলার জায়গা হলো।
একজন বিবাহিত নারী যার বর একসাথেই বসবাস করে তার কথা বলার জায়গার অভাব শুনে চামেলীর একটু ভাবনা হয়েছিল।পরে মিলিয়ে দেখে কথাটাতো ঠিক।যামিনীবাবু পারুলের সাথে কোনও প্রকার নির্দয় আচরণ করে না।তবে প্রেম ভালবাসার নিদর্শনওতো নেই!চামেলী প্রচুর গল্প উপন্যাস পড়ে। তাতে করে সে জানে,বৃদ্ধলোকের তরুণী ভার্য্যার প্রতি সীমাহীন প্রেম মানুষের ঈর্ষার কারন হয়ে ওঠে।কিন্তু যামিনী বাবু যতক্ষণ ঘরে থাকেন পারুলের প্রতি তার সারাক্ষণ উপদেশ আর ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার খিটিমিটি লেগেই থাকে।অথচ সে আর পারুল কাছাকাছি বয়স হলেও যামিনীবাবু চামেলীকে যথেষ্টই সমীহ করে।সেকি সে টাকা দিয়ে এই বাড়িতে থাকে আর কলেজে পড়ে বলে?কিন্তু পারুল যেমন নিরুপায় ছিল যামিনীবাবুও তো নিরুপায় হয়েই বিয়ে করেছেন তাকে।সেও যে তার ভেসে যাওয়া সংসারের হাল ধরে তার কত উপকার করেছে সেজন্য হোক না ছোট সে, তাকে একটু সম্মান দিয়ে কথা বললে কি হয়?চামেলীর প্রায়ই সেকথা মনে হতো।কিন্তু তা না,কেবল খিটিমিটি।তাতে পারুলের মুখের অনিন্দ্য হাসি যে মিলিয়ে যায় সেটা চামেলী খেয়াল করে কিন্তু যামিনীবাবু তা খেয়াল করে না।আসলে লোকটির ধাতই এরকম।ঘরে এসে সকলের সাথে খবরদারি আর খিটিমিটি করা সংসারের কর্তা হিসেবে এটা যেন কর্তব্য তার,নাহলে যেন সংসার ঠিক থাকে না এমন ধারণা পোষণকারী লোক সে।কিন্তু এটা যে ঠিক নয় কে তাকে বুঝাবে?দুনিয়ার সমস্ত কিছু যেন সে বুঝে বসে আছে।প্রতিবাদ হিসেবে পারুল কেবল মুখ ভেঙ্গায় তাও যামিনীবাবুর অলক্ষ্যে।
চামেলী দেখেছে পাকঘরে তারা যখন সকলে একসাথে খেতে বসে,সেসময় কথা বলতে বলতে ভাতের গ্রাস ‍মুখে পুরার জন্য যামিনীকাকা যখনি মাথাটা নোয়ায় তখনই চুলার কাছে বসে পারুল মুখ ভেঙ্গায় দেখে চামেলীর খুব হাসি পায়।সে হাসতে থাকে।
এই মেয়ে তুই হাসছিস কেন ?
কিছু না।
কোন কারন ছাড়া কেউ হাসে ?
পারুল তখন একটু সাহসী হয়ে ওঠে।খানিটা গার্জেনের মতো করে বলে, এই শুরু হইছে ! ঘরের মানুষের সাথে খিটখিটি করতে করতে অখন—
পারুল কথা শেষ করেনা।যামিনী বাবু বলেন ঘরের মানুষ আর পরের মানুষ কে ? চামেলী আমার পর নি? জানো তার বাবার সাথে আমার কত যুগের বন্ধুত্ব ?
চামেলী ইচঁড়েপাকা ছিল না।তাই বলে বিএ ক্লাসে পড়া এবং অনেক নাটক উপন্যাস পড়া মেয়ে হয়ে যে নরনারীর সম্পর্কের বিষয়ে তার ন্যুনতম অনুমানও ছিল না তাতো নয়।কিন্তু সে ভীষণ লাজুক ছিল।এসব বিষয় নিয়ে কোনো বিবাহিত মেয়ে-সে হোক তার বান্ধবী বা অন্তরঙ্গ কেউ,তাকে কোনো প্রশ্ন করা যায় সে ভাবতেই পারতো না।তবে তার মনে খটকা লাগতো।পারুলের সাথে যামিনীবাবুর সম্পর্কটা ঠিক দাম্পত্য সম্পর্কের মতো মনে হয় না।যদিও তাদের দুজনের জন্য একই বিছানা ছিল। সে বিছানায় অবশ্য যামিনীবাবুর ছোট্ট মেয়েটাও ভাগ বসাতো।এতো ছোট ছিল যে ও জানতো পারুলই তার মা।ছোট মেয়েটি সমস্যা ছিল না।পারুলও ওকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসতো।ছেলেটা যদি ওকে একটা চড় থাপ্পর দিতো সে আপন মায়ের মতোই রে রে করে উঠতো।আসলে সন্তানের জন্য পারুলের কোনো আফসোস আছে বলে তার কোনো কথা বা আচরণে প্রকাশ পায়নি।এবং বুড়ো লোকের বউ হয়েছে বলেও যে তার দুঃখ আছে এমন কথাও কখনো তার মুখে শোনেনি চামেলি।কিন্তু কোনো কোনো সকালে দেখা যেত পারুলের মেজাজ ঠিক নেই।থম ধরা মুখ।কারো সাথে কোনো কথা নেই।ছেলেটা যদি এসে বললো,মা চা হয়নি ? অমনি খেকিঁয়ে উঠতো সে।সে ভয় পেয়ে চলে যেতো।এরকম মূহূর্তে চামেলীও যেন পারুলকে কিছুটা ভয়ের চোখে দেখতো।চা দেয়া বা রান্নার দেরী হলেও সে কিছু বলতো না।বিছানায় বসে নিজের পড়া পড়ে যেতো।আর দেখত রান্না ঘরে পারুল থালাবাসন মাজছে,ঘর মোছে রাখছে।সবকিছুতে ঢিলেঢালা ভাব।যেন কিছুতেই মন নেই।প্রথম প্রথম একদিন শুধু মন খারাপ কেন প্রশ্ন করেছিল চামেলি।সে উত্তর না দিয়ে এমনভাবে তাকিয়েছিল যে দ্বিতীয়বার আর সাহস হয়নি প্রম্ন করতে।রান্নার দেরী হলে না খেয়েই সে কলেজে চলে যেতো।চামেলীর রাগ হতো।তার মনে হতো পারুলের রাগ হতেই পারে কিন্তু যে তার রাগের কারন নয়,তার প্রতি এই রাগ কেন?এখন চামেলী তার সংবেদনশীল মন দিয়ে বিচার করে বুঝে পারুলের তাতে দোষ ছিলনা।যে কারনে সেই সময় পারুলের মন খারাপ থাকতো বা থম মেরে থাকতো সেসময় তার পক্ষে যে কারো সাথেই কথা বলতে ভাল না লাগাটাই স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু সম্ভবত পারুলের মনের আকাশের সেই থম ধরা মেঘ উড়ে যেতে বেশি সময় লাগতো না।কলেজ থেকে ফিরে চামেলী দেখতো সে হাসছে। ছেলে মেয়ে ও তাদের বাবার সাথেও কথা বলছে।
সিরাজ যখন এলো কিছুদিন না যেতেই পারুলের উচ্ছাস যেন থামে না।কথায় কথায় হাসি উচ্ছাস। যামিনীবাবু ধমকায়।তাতেও হাসি থামে না।ঠোঁট বেঁকিয়ে একটু মুখ ভেঙ্গিয়ে আবার হাসি।চামেলির কেন যেন মনে হয় পারুলের কাছে তার আগের সেই গুরুত্ব আর নেই।সে কিছুটা অপমানিত বোধ করে।মনে মনে নিজেকে স্বান্ত্বনা দেয় ধুর ধুর।লেখাপড়া শিখে সে কোথায় চলে যাবে আর কোথায় পড়ে থাকবে পারুল।কিন্তু কেন তাকে অবহেলা করে পারুলের এই হাসি উচ্ছাস?এই অকারণ হাসি উচ্ছাসের উৎস কি?চামেলি না বুঝলেও যামিনীবাবু কি বুঝতে পারেন?সিরাজ আসার সাত আট মাস পেরিয়ে গেছে তখন।একদিন সকালে পারুলের আবার সেই থমথমে মুখ।বাসনের ঠাস ঠাস শব্দ। রান্নাবান্নায় ঢিলেমি।যামিনীবাবুর গজগজ।কলেজে যাওয়ার মূহূর্তে চামেলি দেখে সিরাজের মুখখানা চূন হয়ে আছে।ওকে যেন চোরের মতো লাগছে।সে ভাবে এ আবার কিসের আলামত?ঘরের থমথমে ভাব দেখি বাইরের আকাশকেও সংক্রমণ করেছে।এবারের থমথমে ভাব আর শেষ হয় না।একদিন যায়। দুদিন যায়।পারুল বিছানা ছেড়ে পাকঘরের মাটিতে বিছানা পাতে।যামিনীবাবু তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধমক ধামক দিয়ে মান ভাঙ্গাতে চেষ্টা করেছেন।কাজ হয়নি।চামেলীও চেষ্টা করেছে।বলেছে তাহলে আমার সাথে এসে শোও।সে কারো কথা শোনেনি।জবাবও দেয়নি।এরমাঝেই একদিন রাত তখন দুটো আড়াইটা সম্ভবত।কি কারনে চামেলির ঘুম ভেঙ্গে গেল।মনে হলো কেউ একজন পা টিপে টিপে পাকঘরের দরজার কাছে গেল।তারপর আস্তে করে দরজাটা খুলে বাইরে থেকে শিকল টেনে আবার পা টিপে টিপে উঠানের দিকে হেঁটে গেল।চামেলি নিজের বিছানায় শুয়ে কান খাড়া করে কিছু বোঝার চেষ্টা করে।না,পারুল টয়লেটে নয় উঠানের দিকে গেল।ওদিকে কেউ যেন দেইড়া ঘরের দরজা খুলে আবার লাগিয়ে দিল।মূহূর্তের পর মূহূর্ত গড়িয়ে যাচ্ছে।চামেলির হাতে রেডিয়াম দেয়া ঘড়ি।অন্ধকারেই দেখা যায় সাড়ে তিনটা বাজে।তার অনুমান তবে ঠিক।টয়লেটে যায়নি পারুল।দোকান ঘর থেকে এসে সিরাজ আগে থেকেই দেইড়া ঘরে ছিল।বিষয়টা চামেলির কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।তার শরীর কেমন করতে খাকে।সিনেমায় দেখা নায়ক নায়িকার আবেগঘন দৃশ্য তার চোখে ভেসে ওঠে।সেখানে পারুল আর সিরাজের মুখ।
দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকলো।চামেলি রুদ্ধশ্বাসে প্রার্থণা করে যামিনীবাবু টয়লেটে যাওয়ার আগে যেন পারুল নিজের বিছানায় ফিরে আসে।কিন্তু সে আশ্চার্য হয়ে লক্ষ্য করে যামিনীবাবুর টযলেটে যাওয়ার সময়টা যেন কেবলি পিছিয়ে যাচ্ছে?কিন্তু কেন?দাম্পত্য,সংসার, প্রেম ও যৌনতা অনভিজ্ঞ উদাসীন চামেলী পারুলের এই ছলাকলা বুঝতে পারে আর অভিজ্ঞ চতুর যামিনীবাবু কিছুই বুঝতে পারেন না?চামেলির বিশ্বাস হয় না !
কেউ কি বলেছিল নাকি কোথাও পড়েছিল চামেলির আজ আর মনে পড়ে না যে পুরুষ চির যৌবনা।কিন্তু যামিনীবাবু ও পারুলের দাম্পত্য সম্পর্ক দেখেতো সেটা মনে হয়না।সোনা গয়না দামী শাড়ীর জন্য পারুলের কোনো হাপিত্যেশ দেখেনি চামেলি।যা পায় তাই যেন ওর কাছে অঢেল। খাওয়ার ব্যাপারে খুব সামান্য চাহিদা তার।তাহলে প্রায় সকালেই কেন পারুলের মুখে আষাঢ়ের থমথমে মেঘ ঝুলে থাকে?এক অষ্টাদশী বিবাহিত তরুণীর রক্তমাংসের শরীরে খাওয়া পরার বাইরেও যদি অন্যরকম খিদে থাকে সেটা নিশ্চয় দোষের যে নয় চামেলী সেটা বিশ্বাস করে।তাও পারুলের সাহস দেখে সে ভয় পায়।সে ভয় পায় পারুলের জন্য।যদি যামিনীকান্ত সব জেনে যায় পারুলের ভাগ্যে কি যে হবে!
আর কিনা দিনের পর দিন যায় ভদ্রলোক কিছুই বুঝতে পারে না ?
তাহলে কি যামিনীবাবু তার অক্ষমতা ঢাকতে কিছুই না বোঝার ভান করে মটকা মেরে পড়ে থাকে? বছরের পর বছর ধরে রাত সাড়ে তিনটায় তার টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস বদলে সময়টা ইচ্ছে করে পিছিয়ে দেয়?সেকি তরুণী ভার্য্যার খুশীর জন্য নাকি কড়াশাসনে স্ত্রী যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় আর একজন শক্ত সামর্থ্য স্ত্রীলোকের অভাবে গোছানো সংসারটা আবার ভেসে যায় এই ভয়ে আত্মসমর্পন? আর যে গৃহে একের অন্তরালে এমন সব কান্ড ঘটে সেখানে সব জেনেশুনে তার মতো একজন অল্প বয়স্ক মেয়ের পক্ষে একসাথে বসবাস করা কি ঠিক ? এসব প্রশ্নের দোলাচলে পড়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় এ বাসায় সে আর থাকবে না।ততদিনে তার বিএ ফাইন্যাল পরীক্ষার সময় এসে গেছে।কলেজে আর ক্লাসটাস হয় না।ফরম ফিল আপসহ পরীক্ষার যাবতীয় কাজ গুছিয়ে সে যে বাড়ি যায় আর আসে পরীক্ষা দেয়ার সময় হলে।এসে শুনে পারুল কয়েকমাসের প্রেগন্যান্ট।চামেলি অবাক হয়না।সেতো জানতো এমন হতেই পারে।কিন্তু পারুল তার অনিন্দ্য হাসিখানা হাসে।তবে লাজরাঙ্গা সেই হাসি।শান্ত স্নিগ্ধ তৃপ্ত আর সুখী মানুষের মুখ।
নয়ন তার সেই গর্ভের সন্তান।পনেরো বছরের কিশোর।সত্যি এ যেন সিরাজের কার্বনকপিই।সেই চোখ নাক,মুখ,এমনকি সেই হাসির স্টা্ইলটাও।চামেলি মনে মনে পারুলকে স্যালুট জানায়।
শেলী আরো কি কি যেন বলতে চেয়েছিল।চামেলী তাড়াহুড়ো করে পারুলকে ডেকে বলে-কাকী,আজ আমরা আসি।পরে একদিন এসে অনেক গল্প করবো।আজ অন্য একটা জায়গায় যাওয়াটা খুব জরুরী।শেলী চলো আমার সাথে।অর্ডারের মতো বলে শেলীকে প্রায় বগলদাবা করে ঘরের বাইরে এনে একটা রিকশা ডেকে লাফিয়ে ওঠে।পারুল তার বারান্দার গেটে দাঁড়িয়ে সকৃতজ্ঞচোখে চামেলীর দিকে চেয়ে হাত নাড়ে।