ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

ছেঁড়া বোষ্টুমির কবিতাগুচ্ছ
১
তার উঠানে নাইন-ও-ক্লক
নয়
না
নেই
নই
বলতে বলতে জাদুগন্ধ
অন্ধ শ্লোক পায়ের সামনে
নয়
না
নেই
নই
ভিজতে ভিজতে ভাঙা ছন্দ
খুন করে খুন নিম বোষ্টুমি
নয়
না
নেই
নই
মুখে পড়ুক ফুল ও চন্দন
২
জল নেমে গেছে, মাটি শুকনো, মেঘ বলে আর কিছু নেই
আকাশ ঘুমোয়নি
শুকোয়নি
আজ অব্দি যাকে অশ্রু বলে মুলুক
শুকোয়নি ক্ষত মাধবীগলির
কী উদ্দেশ্য কী বিধেয় খেয়াল ছিল না
নূপুর না, ইয়ারোঁ, ধরে নিও অশ্রুর ধ্বনি
অশ্রুর ধ্বনি তার মুখ হয়ে, বৃষ্টিরা উন্মুখ হয়ে,
তাতাথৈ নাভিফুলে লাল লাল আবির
খোঁপাখোলা তলোয়ার সন্ধ্যার অসাবধান যা অল্প জমা
এখনও নির্ভাজ সোজা শিরদাঁড়া
তার হাতে তুলে দিই পড়ে পাওয়া আমার ভুবন
ফুলখালি বালিশ জড়িয়ে, ঘুমিয়ে পড়েনি
রাত্রি তার বুকের কুসুম
ভালোবাসায় না-ভালোবাসায় ভয়পাওয়ানো ঠোঁট ছেঁড়া বোষ্টুমির
৩
আমের বোল এই তো এল, পাতায় তামার রঙ
প্রশ্ন নেই স্নিগ্ধ শীতল বৃষ্টি যদি থামে,
সকালে স্নান সেরে এলে তোমার শ্রীমুখ যেমন
দেখতে চেয়ে উঠানে রোদ নামে
পাতা নাড়ে কী হাতটি নাড়ায়, ডাল নাড়ে কী ঘাড়?
গাছ বলছে— চিন্তা কিসের? ঠিক আছে সব দিক।
চোখের পাতা ভেজা আমার, গাছের ক্লেশ অপার,
কত কী বলে, তাকায় অলৌকিক
মুঠোয় হাত, তোমার চোখে পরমানন্দ চোখ—
যা দেখি তার কোথাও নেই খানিক অনিশ্চয়?
শরীর থেকে ফিরে আসে শিশিরধোয়া আলো
গাছ বলছে— দশ দিকে বিস্ময়
কোথায় যেন এক হয়ে যাও গাছের সঙ্গে তুমি
ছুঁই এবং না ছুঁই যা হোক, আজব দুষ্টুমি
৪
দিনের বেলা কাজকর্ম থাকে, ছূটোছুটি থাকে, বন্ধুবান্ধব, একথা, সেকথা,
দিনের বেলা সবকিছুই ঠিক
রাত নামলেই রাত বাড়লেই সে আমায় পেয়ে বসে, একা পেয়ে বসে, হাতে যেন কিছুই থাকে না, কী করে যে নিয়ে যায় পুরাতন বাদামি দুপুরে, হিমের সন্ধ্যায় কী, করে যে পায়ে পায়ে পাশাপাশি, স্পর্শ করা যায়, কথা বলা চলে, প্রফুল্ল চোখদুটি স্পষ্ট দেখতে পাই
ঘুম আসে না, ছায়াশরীর আসে, দূরে সরে যাওয়া যায় না, মোছেওনি একটিমাত্র কলম দিয়ে দুজনে লিখেছি
দিনের বেলা খেয়াল থাকে না
রাত বাড়লে ছায়া ঘন হয়
ছায়াশরীর আসে
একা যখন
একা
৫
দূর থেকে আসতে হয়, সন্ধে নামতেই আসেন
হাতের কাজ বাকি রয়ে যায়, চুল বাঁধা সারা হয় না,
কাচটিপ কপালের ঠিকঠিক মধ্যিখানে বসে না, ধোয়া শাড়ি জড়িয়ে নিতে নিতেই
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং
ঢেউ
ঝড়ের ভেতর তাসার শব্দ মিলিয়ে
জানলা দিয়ে চোখ বেরিয়ে যায়, দুয়ার কামড়ে দুলি মাধবীমাধবী
দ্রুতই আসেন, দুঃখদগ্ধ মুখ
পাথরপিষ্টচোখ
নীল শিখার দীপ
দিন এমন
প্রত্যেকদিন এমন
যেদিন এসে পড়েন
চোখ তুলে দেখব আড় ভাঙে না
আমি কিছু কইবার আগেই নিজেই তিনি ধরেন,
কাছে এসো, সন্ধে নামছে, ফিরে যেতেই হবে, এইটুকু সময়
হাত ধরে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়ব
হয় না
তেনার খুঁটি আছে
আমিও যে খুঁটিতেই বাঁধা
সরষেদানা সময়ের পায়ে, বড় করে বাতাস নিয়ে ভাবি, কেমন পোড়া কপাল
সময় থামে, স্পষ্ট ধরতে পারি, নড়েই না স্পষ্ট ধরতে পারি
কালো পোশাক পরে কী ভেবে ঠায় দাঁড়িয়ে যে রাত্তির শেষ হওয়ার না
গোঁসাই চলে যেতেই
৬
মনে তো হয় আসে, সত্যি হয়ত মনের ভুল
রাশি রাশি ভুল জীবনভর, এমন কথাও উড়িয়ে দেব কেন?
আসে কিন্তু
শাদা কাগজ ছুঁয়ে আমার কলম, একটি-দুটি শব্দ, চেনা শব্দ, একটি-দুটি চরণ, চেনা চরণ
সামনে এসে দাঁড়ায়, পেছনে এসে দাঁড়ায়, কখনো কখনো দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, সম্বিত ফিরতে, কোনো কোনো দিন দেখি ছিটকে গেল কিছু, তড়িতদ্রুতি
আজ অব্দি আমার কিছুই লেখা হয়নি
কী ভাবেই বা হবে!
ধরো, টিয়া পাখি সবুজ,
লিখলাম সবুজ।
হল? হয়?
তারপর ওই মানুষ, অমূল্যুধন, তার আলো-আঁধার,
ধরা যায়?
যে আসে, সত্যি যদি আসে, সত্যি যদি শাদা কাগজে ওই আমার মিনিংলেস লেখার একটি-দুটি শব্দের দিকে, একটি-দুটি চরণের দিকে তাকায়,
শেষ পর্যন্ত বলি, অকিঞ্চনের কিচ্ছু করার নেই,
গেরস্তের ঘরে কাকপাখিও আসে না রান্না যদি না হয়
যা দেখেছি, যেমন দেখেছি, যেমন সাধ্যি লিখি
আসুক
হোক মিথ্যে এই কথাটি
তা সত্ত্বেও
যদি না আসে, যেন অন্তত মনে হয় এসেছে
এসেছে এমন বোধে আমার মনে কী হয় কেন কী সব হয় কেমন করে কাকে আর বোঝাই!
৭
চেনা কখন চেইন ছিন লী,
এত খিদে না রাহা শানাম,
নিজেই চমকে উঠি, হায়!
আমি এত ভালোবেসেছিলাম?
ও নিগাহেঁ, ওহি হোঠোঁ নে
ঘোঁট লী দাম পাল পাল,
চেনা ওই গোপন মধুর
ভালোবাসা মানে রঙ লাল
গোলাপি নৌকা বলে, আয়!
কাঁহি দূর গীত আনশুনি,
কুচাল থী দিল আউর দিমাগ,
আমি মূর্খ মুহূর্তও গুনি
খত্ম নেহি, নেহি শুরুয়াত,
সাল ভর বরষে শাওয়ান,
জিশ্ম কুছ মামুলি সা, প্যারা,
তেনারেই মানি ভগবান
তেরি ওর, তেরি হি ওর
দিল বোলি ডেস্টিনেশান,
আধি ধুঁয়া আধি দিয়ালি,
ভালোবাসা পাষাণপাষাণ
৮
লোকজন সব কেমন হয়ে গেছে
মা বলল
কেমন হয়ে গেছে জিজ্ঞেস করি না
রোদ্দুর আর আগের যেমন নেই
মা বলল
আগে কেমন ছিল জিজ্ঞেস করি না
মা এইভাবে বলে শিউলি টগর মাধবীদের কথা
মেঘবৃষ্টির কথা
শালিখ বক বুলবুলির কথা
যে বাচ্চারা এখন আর হেঁটে হেঁটে স্কুল যায় না তাদের সবার কথা
পরনে লুঙ্গি যে মানুষটা এখনও শিল কুটতে আসছে তা্রও কথা বলে
এদিক সেদিক না দেখে রাঙা বিড়াল রান্নাঘরে সেঁধিয়ে গেল
মা বলল, দেখেছিস?
মা সিতারার কথা সিতারার মায়ের কথা একবারও বলে না
রোজ ছোড়দি মাকে কীসব বলে
অনেক সময় নিয়ে
মা একসময় ফোন নামিয়ে শুকনো বিকেলের মরা আলোয়
দুঃখীদুঃখী মাঠের দিকে চোখ জাগিয়ে রাখে
সিতারা অনেকদিন ব্যালকনিতে আসেনি
আমার কিছু হয়নি
একটাও কথা হয়নি
একটাও
কথা
আমার
হয়
না
৯
ডাইরির ভেতর ইয়ে শাম মাস্তানি ফ্রেম হয়ে
নাভি থেকে উঠে আসে পুরনো নিশান
নাভুমি থেকেও
নূপুর বাজিয়ে মানানসই জল সন্ধের আগে
একমিটার বড়ো আজগুবি
লক ডাউনেই ছিলাম, বোষ্টুমি!
মাস্ক নেই, ছিলও না, বলো?