প্রবন্ধঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্পর্ধিত বিবর্তনের শান্ত ইতিহাস

সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্পর্ধিত বিবর্তনের শান্ত ইতিহাস
সোমনাথ রায়
‘ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যা বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি—
যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।’
উদ্ধৃতিটি ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২) কাব্যগ্রন্থের ‘পাথরের ফুল’ কবিতার অংশ। দারিদ্র ও বঞ্চনায় বিদগ্ধ কথাসাহিত্যিক মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পরে এই সংবেদনশীল কবিতাটি লিখেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। উদ্ধৃত অংশটুকু নিয়ে লেখাটি শুরু করার কারণ এই যে, একজন সৎ কবিই পারেন সহমর্মিতার নিবিড়ে ডুব দিয়ে ভনিতা ও কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণের কাব্যচিত্র প্রকাশ করতে। সন্তান যেমন মায়ের কোলেই সর্বাধিক সুন্দর, ফুলও তাই। অথচ তাকে আমরা নির্দ্বিধায় ‘বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া নিহত গোলাপ’ –এর মতো ভালোবাসা দ্যাখাতে, পুজোর বেদী বা পুজ্য-চরণ সাজাতে বা মালা গেঁথে অর্চনায় অথবা জীবিতাবস্থায় অবহেলিতের মৃতদেহে বা শ্রাদ্ধবাসরে যত্রতত্র ব্যবহারের মাধ্যমে স্থূল সংযোগের তাগিদে অতি ক্ষণস্থায়ী যে অমানবিক আচার পালন করে থাকি, তা তো সত্যিই কোনো সেতু সঞ্চার করে না। বরং অনেকক্ষেত্রেই তা শুধু প্রথাসর্বস্ব লৌকিকতাকেই বহন করে। মুহূর্তেই দেখি তো আবর্জনায় পরিণত হতে! ফলে এই আবেগের সঙ্গে মিশে থাকে একপ্রকার মুখোশের বাহুল্য। যা ‘আগুলের ফুলকি’ বরদাস্ত করে না। আমৃত্যু পদাতিক কবি সুভাষ এটাই উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘ফুল থাক ফুলের মতো/ খাঁড়া খাঁড়ার মতো # ফুল তুলে কেউ যেন আমাকে কাটতে/ খাঁড়া তুলে কেউ আমাকে/ যেন গন্ধ শোঁকাতে না আসে’ (বুড়ি বসন্ত/ ধর্মের কল, ১৯৯১) অর্থাৎ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কবি সোজাকে সোজা আর বাঁকাকে বাঁকা বলতেই ভালোবেসেছেন চিরদিন। যেমন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ (১৯৪০)-এ লেখা ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,/ চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/ কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।’ (মে-দিনের কবিতা) আমাদের সচকিত করে, পরিচয় করিয়ে দেয় সমাজসচেতন কবিতাবোধে পা রাখা এক সংগ্রামী তরুণ কবিকে, ঠিক তেমনই যখন গীতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ের (১৯৫১) আট মাস পরেই শহরের জৌলুস ছেড়ে সস্ত্রীক চলে যান বজবজের ব্যঞ্জনহেড়িয়া গ্রামে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে তখনই তাঁর কলম থেকে ফুলের ভিন্ন নির্যাস উঠে আসে, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত। # আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে/ তারপর খুলে—/ মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে/ তারপর তুলে—/ যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে/ যেন না ফেরে।’ (ফুল ফুটুক না ফুটুক/ ফুল ফুটুক, ১৯৫৭) ব্যথা-যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে চলার ও চালনার ঝোঁক, মুখে-মুখে ফিরে এক স্বতন্ত্র ভাষ্য-মিথ গড়ে তোলে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কে যে অপবাদ বা মতবাদ শোনা যায়, তিনি নাকি কখনো প্রেমের কবিতা লেখেননি, তখন আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, প্রেম কি শুধুই নারী-পুরুষের মিলন-সম্ভোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি হৃদয়ের সুক্ষ্ম অনুভূতির ভেতরেও, বেদনা-বিরহের অনুরণনেও প্রেমার্তি প্রকাশ পেতে পারে, যা এই কবিতারই পরের অংশে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি— ‘গায়ে হলুদ-দেওয়া বিকেলে/ একটা দুটো পয়সা পেলে/ যে হরবোলা ছেলেটা/ কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত/ —তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো। # লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মতো/ আকাশটাকে মাথায় নিয়ে/ এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে/ রেলিঙে বুক চেপে ধরে/ এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল— # ঠিক সেই সময়/ চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল/ আ মরণ! পোড়ারমুখ লক্ষীছাড়া প্রজাপতি!/ তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।/ অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে/ দড়িপাকানো সেই গাছ/ তখনও হাসছে।’ হরবোলা ছেলেটির কোকিলের শিসে কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ের রেলিঙে বুক চেপে ধরে উদাস হয়ে যাওয়া এবং তারপরে চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসা পোড়ারমুখ লক্ষীছাড়া প্রজাপতির বেদনাবিদ্রুপ থেকে পালিয়ে ঘরে ঢুকে, লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে, দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দে আমি অন্তত খুঁজে পাই এক নারী হৃদয়ের উথালপাথাল।
২
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামারবাড়িতে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ সালে। তিনি ১৯৩৭ সালে কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪১ সালে স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক হয়ে ১৯৪২ সালে এম এ পড়ার সময় দলের হোলটাইমার কবিকে দুদফায় কারাগারে বন্দী হতে হয়। মায়ের মুখ থেকে পাওয়া নদীয়ার সুমিষ্ট ভাষা কবিকে শৈশবেই আকৃষ্ট করে। কবিতা সীমান্ত পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হওয়া, কালান্তর সংবাদপত্রের জন্য মলয় দাশগুপ্তকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি সুভাষ জানিয়েছেন, ‘আমার মা ছিলেন কৃষ্ণনগরের মেয়ে, মা খুব ভাল কথা বলতে পারতেন এবং মার কথা শুনতে অনেকে আমাদের বাড়িতে আসত, আমার নিজের মনে হয় সেই মার কথা বলার ধরন খানিকটা আমার অজান্তে আমার লেখার মধ্যে এসেছে। …. কাজেই শুনে শুনে হয়ত আমার মধ্যে একটা বাংলাভাষার ধাঁচ গড়ে উঠেছিল, সত্যি বলতে কী আমি যত না বই পড়ে লিখতে শিখেছি তার চেয়ে লোকের কথা শুনে’ —এই ধাঁচটাই নতুন। প্রথমে গদ্যে এবং পরে কবিতায় কথ্য ভাষাকেই অর্থাৎ সাধারণ মানুষের বাচনভঙ্গিকেই সৃজনশিল্পে উত্তীর্ণ করেন তিনি। যা গ্রহণ করার জন্য কোনো স্তরের পাঠককেই অভিধান হাৎড়াতে হয় না। অনেক সময় হয়ত অদ্ভুত লাগে তাঁর প্রয়োগ, ‘শুকনো মুখে/ বলেন মা, ‘কী/ পেলাম বল্ দিনি?’/ ভুলে যাইনি।/ ভুলে যাব না/ জীবনে কোনোদিনই।।’ (ভুলে যাব না/ কাল মধুমাস, ১৯৬৬) এই ‘দিনি’ শব্দের আভিধানিক কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু দ্রুত কথা বলার সময় দেখিনি শব্দের সংশ্লেষে ‘দিনি’ শব্দের ব্যবহারে আমরা বুঝে নিতে পারি বক্তার মনের ভাবটিকে। এ বিষয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি, ‘লিখতে হবে পুরোপুরি নিজের মতো করে। তাতে চটকদারি লোক-দেখানো ভাব না থাকে। লেখাটা যেন হয় মুখে কথা বলার মতো।’ এ শুধু কথার কথা নয়, সারা জীবন এই বিশ্বাস কবিতায় ও গদ্যশৈলীতে, বিশেষত সংবাদপত্রে ‘রিপোর্টাজ’ লেখার বিবর্তন সৃষ্টিতেও এক অসামান্য স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। এখানে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিষ্ণু দে-র ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ গ্রন্থটির কথা। ঘটনা অনুভবের মধ্যেই থাকে কবিতার বীজ। তাকে শিল্পে রূপ দিতে পারাটাই মুন্সিয়ানা। এটি একমাত্র সম্ভব মানুষের মধ্যে মিশে যেতে পারার সংবেদনশীল সামর্থ্যে। যা প্রকৃত পদাতিকের পক্ষেই সম্ভব। শ্রূত শব্দকে শৈশবের জাদুশক্তিবলে আত্মসাৎ করে সৎসাহসের পরিবেষণে সরল ও সাবলীল কাব্যভাষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
৩
‘কবিতাভবন’ থেকে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশের মুহূর্তেই বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেনদের পেছনে ফেলে তরুণ কবির শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আর তাতে শ্লাঘা বোধ করেছিলেন অগ্রজ বুদ্ধদেব নিজেই। ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থে ‘পদাতিক’ সম্বন্ধে আলোচনায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্যঃ প্রথমত, তিনি বোধহয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি, প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; কোনও অস্পষ্ট, মধুর সৌরভ তাঁর রচনায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম কবিতাগুলিতে লক্ষণীয় ছিল। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্যরচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।’ এই শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কলমের শেষ আঁচড় পর্যন্ত রেখে গেছেন সুভাষ। যদিও শ্রদ্ধা-অবনত থেকেও বলা যায়, আক্ষরিক অর্থে প্রকৃতি বহির্ভূত কোনো কবিতা লেখা প্রায় অসম্ভব। ‘পদাতিক’-এও তার নমুনা খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। যদিও ‘রোমান্টিক’ শিরনামে কবিতায় প্রকৃতি উৎসারিত ‘আগ্নেয়গিরি’, ‘রাত্রি’, ‘মাহেন্দ্রক্ষণ’, ‘সময়’, ‘জ্যোৎস্না’, ‘চাঁদ’, ‘জোয়ার’ ইত্যাদি শব্দমালা চিত্রায়িত হয়ে আছে। ‘ভ্রমণ-বিলাসী ভাবনা’, ‘চাঁদের পাড়ায়’, ‘হৃদয়-জোয়ারে’ ইত্যাদি চিত্রকল্পের মধ্যে ‘অস্পষ্ট, মধুর সৌরভ’ সুভাষের কবিতায় লাবণ্যের স্বাদ খুঁজে দিতে সক্ষম। তবে প্রথমাবধি ছন্দ প্রয়োগে রীতি-সচেতন কবি চিরদিনই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। এই কবিতাতেও ছয়ের মাত্রাবৃত্ত প্রয়োগে, ছন্দ গণনায় চোখের থেকে কানের গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। চার পঙক্তির পাঁচ স্তবকে নির্মাণ করা কবিতাটির তৃতীয় স্তবকের চতুর্থ পঙক্তি— ‘সেলাইয়ের প্রতি সুতোয় লুকোয় লজ্জা।’ এখানে ‘সেলাইয়ের’ শব্দবন্ধে চোখ আটকায়, কারণ সেখানে পাঁচ মাত্রা নজরে পড়ে। কিন্তু পড়ার গতিতে শব্দ সংশ্লেষে ‘সেলায়ের’ পাঠ চার মাত্রায় কানে হজম হতে বাধে না। এই গ্রন্থের ‘বধূ’ কবিতায়, ‘গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল/ পুরানো সুর ফেরিওলার ডাকে, দূরে বেতার বিছায় কোন্ মায়া/ গ্যাসের আলো-জ্বালা এ দিনশেষে। # কাছেই পথে জলের কলে, সখা/ কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে/ হঠাৎ গ্রাম হৃদয়ে দিল হানা/ পড়ল মনে, খাসা জীবন সেথা। # সারা দুপুর দীঘির কালো জলে/ গভীর বন দুধারে ফেলে ছায়া।/ ছিপে সে-ছায়া মাথায় কর যদি/ পেতেও পার কাৎলা মাছ, প্রিয়। # কিংবা দোঁহে উদার বাঁধা ঘাটে/ অঙ্গে দেব গেরুয়া বাস টেনে/ দেখবে কেউ নখ বা কেউ জটা/ কানাকড়িও কুঁড়েয় যাবে ফেলে। # পাষাণ-কায়া, হায় রে, রাজধানী/ মাশুল বিনা স্বদেশে দাও ছেড়ে;/ তেজারতির মতন কিছু পুঁজি/ সঙ্গে দাও, পাবে দ্বিগুণ ফিরে। # ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে—/ দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন/ আসছে লাঠি উঁচিয়ে পেশোয়ারি/ ব্যাকুল খিল সজোরে দিই মেলে। # ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম/ উধাও; লোকলোচন উঁকি মারে—/ সবার মাঝে একলা ফিরি আমি/ লেকের কোলে মরণ যেন ভালো। # বুঝেছি কাঁদা হেথায় বৃথা; তাই/ কাছেই পথে জলের কলে, সখা/ কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে/ গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল।।’ পাঁচের মাত্রাবৃত্তের নিখুঁত গড়নে লেখা কবিতাটিতে, গ্রাম থেকে শহরে, স্বামীর ফেলে যাওয়া রমনীর বিরহ-বেদনায় গাঁথা প্রেমের অনবদ্য এক কাহিনী উঠে এসেছে কলেজ পড়ুয়া এক সমাজ দর্শক তরুণের কলমে। ‘দোঁহে’, ‘হেথাও’ জাতীয় কিছু সাবেকী শব্দের মোহ কাটিয়ে উঠতে না পারাও অস্বাভাবিক নয়। কারণ, কাব্য-ইতিহাস দীর্ঘ ধারায় প্রবাহমান। সে নিজেই শুরু বা নিজেই শেষ নয়। যুগ থেকে যুগে তার ওপরে পরম্পরার ছায়া লেগে থাকে। সচেতন কবির কলমে সময়ের অভিঘাতে ভাষা বাঁক নেয়, কবিতায় বিবর্তন ঘটে। তবে সম্ভাবনার ইঙ্গিতও অবশ্যই থাকতে হয়। তবুও মাথার ওপরে টর্চ বাহকেরও প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেববাবুর ভূমিকা যেমন সর্বজনবিদিত, তেমনই কৈশোর-প্রয়াত অকল্পনীয় প্রতিভাধর সুকান্ত ভট্টাচার্যযের জন্যেও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অগ্রগণ্য ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। সে প্রসঙ্গের বিস্তারে না গিয়ে কবি সুভাষের কবিতার অনুসঙ্গে ফিরে এসে দেখি, ‘ফাল্গুন অথবা চৈত্রে বাতাসেরা দিক্ বদলাবে।/ কথোপকথনে মুগ্ধ হবে দুটি পার্শ্ববর্তী সিঁড়ি,—/ ‘অবশ্যকর্তব্য নীড়।’ (মড়াকাটা ঘর,—স্থানাভাবে?)’ বা একই কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম পঙক্তিতে ‘নখাগ্রে নক্ষত্রপল্লী; ট্যাঁকে অর্ধদগ্ধ বিড়ি।’ কিংবা তৃতীয় স্তবকের প্রথম পঙক্তিতে ‘বিকেলে মসৃণ সূর্য মূর্ছা যাবে লেকে প্রত্যহ।’ (নির্বাচনিক-ঐ) মহাপয়ারে লেখা অক্ষরবৃত্তের এই নমুনা একাধিক দিক থেকে অভিনব। যেমন অজস্র যতিচিহ্ন, তেমনই শব্দের সংশ্লেষ-বিশ্লেষে স্বক্রিয় স্বাধীন প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। ‘,’-র সঙ্গে ‘—’-র ব্যবহার অবশ্য পরবর্তীকালে সতর্ক কবির কলমে খুব বেশি নজরে পড়েনি, তবে ‘বদলাবে’ যে বিশ্লেষে চারমাত্রা পেয়েছে, সেখানে ‘টুকরো’ সংশ্লেষে পেয়েছে দুমাত্রা। তবে অক্ষরবৃত্তের ‘প্রত্যহ’-কে মাত্রাবৃত্তের ধাঁচে ফেলে চারমাত্রায় বিশ্লেষ করেছেন কবি ‘রাজদ্রোহ’-এর সঙ্গে অন্তমিলের পক্ষপাতে। আর বাতাস বহুবচনে ‘বাতাসেরা’ হয়েছে চারমাত্রা পাওয়ার প্রয়োজনে। আমাদের কানে জীবনানন্দের ‘লাশকাটা ঘর’-এর ব্যঞ্জনা লেগে থাকলেও সুভাষের ‘মড়াকাটা ঘর’-এর (মড়া নাকি মরা!) ব্যঞ্জনাও আধুনিকতায় উজ্জ্বল ও শ্রুতিমধুর।
সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী-কে উৎসর্গীকৃত পাঁচ পর্বে লেখা ‘পদাতিক’ কবিতাটি যন্ত্রণাবিদ্ধ সময়ের নগ্ন-স্বরূপ আবিষ্কারে মুক্তি পেয়েছে ভাষার আড়ষ্টতা, পরিবর্তে ফুটে উঠেছে তরুণ-রক্তের উষ্ণ স্পন্দন। ‘৪ (উঞ্ছজীবী ডাস্টবিন নির্জন বলেই)/….মাঝে মাঝে শোনা যায়, ভবঘুরে কুকুরের ঠোঁটে/ নতুন শিশুর টাটকা রক্তিম খবর!’ এ কোনো চিত্রকল্প নয়, রবীন্দ্রনাথের মতে চিত্তদর্শন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ঠাসা বর্ণনায় কবি সুভাষের আর্ত হৃদয়খানি পাঠকের মন জয় করে নেয়। অক্ষরবৃত্তের দক্ষচালে চিঠির বয়ানে লেখা টানাগদ্যাকারে ‘অতঃপর’ কবিতাটি এ-সময়ে যাঁরা ছন্দ উপেক্ষা করে গদ্যছন্দের কবি হিসেবে ঢাক বাজিয়ে বেড়ান, তাঁদের ও তাঁদের মগজখেকোদেরও ফিরে দেখা উচিত বাংলা কবিতার ঐতিহ্য। মোটকথা প্রথম কাব্যগ্রন্থেই কবি যে ভবিষ্যতের একজন স্বতন্ত্রধারায় বিশিষ্ট কাব্যদ্রষ্টা হয়ে উঠবেন, তাতে কোনো সংশয় ছিল না। কথায় ও কর্মে, পায়ে পায়ে তিনি মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর ‘পদাতিক’ উপাধি।
৪
‘জনযুদ্ধ’ ও ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় সাংবাদিকের ভূমিকায় রিপোর্টাজ লেখায় যে অনন্য গদ্যশৈলীর নিদর্শন সৃষ্টি করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তার ফলে তিনি বদলে দিতে পেরেছিলেন সংবাদপত্রের ভাষা। যদিও সেখানে মন ভরলেও পেট ভরত না। তাই অগণিত পোষ্যসহ সংসার চালাতে কলম ধরতে হয়েছিল বানিজ্যিক পত্র-পত্রিকায়। ভাত দেবার মুরদ না থাকলেও কিল মারার গোঁসাইরা রে রে করে উঠেছিল সে সময়। সুভাষ পাত্তা দেননি। নতি স্বীকারও করেননি, বরং উপেক্ষা করেছেন। কারণ তাঁর ছিল অবিচল আত্মবিশ্বাস ও সুস্পষ্ট লক্ষ। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, নেতাদের ভণ্ড মুখোশ ছেঁড়ার প্রয়োজন আর শোধনবাদীদের জবাব দেবার তাগিদে তাঁর কলম ছিল গদ্যে ও কবিতায় সব্যসাচী। অর্থের প্রয়োজনে অনুবাদ বা গদ্য রচনা করলেও, কখনও তিনি আদর্শচ্যুত হননি। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ বিশেষ প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়, ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ থেকে প্রকাশিত ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থটির ভূমিকায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন—
‘….ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় স্নেহবশে তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)’ বইটি ছোটোদের উপযোগী করে পুনর্লিখনের অনুমতি দেন।
কাজটা যে সহজ নয়, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিষয় ছিল দর্শন। ইতিহাস নয়। নিজেকে তৈরী করার জন্যে নীহাররঞ্জনের নির্দেশিত মূল বইগুলো লাইব্রেরিতে বসে মন দিয়ে মাসের পর মাস পড়তে হয়েছিল। পরে লেখা শেষ করে, নীহাররঞ্জন বিদেশবাস থেকে ফিরে এলে, সাহস করে তাঁকে দেখাই। পাণ্ডুলিপি পড়ে তিনি ছাপাবার ছাড়পত্র দেন।
কাজে হাত দিয়ে ছিলাম পেটের দায়ে। কাজ শেষ হলে দেখি মনের বন্ধ দরজা-জানলাগুলো যেন খুলে গিয়েছে। নীহাররঞ্জনের কাছে যাওয়া মানেই ছিল নিত্যনতুন মনের খোরাক নিয়ে ফেরা। তাঁর কাছে আমার ঋণের শেষ নেই।
আমার দুঃখ, একটি লেখা তাঁকে আমি দেখাতে পারিনি। তাতে ছিলঃ
লোকটার জানা ছিল কায়কল্পের জাদু/ ধুলোকে সোনা করার/ ছুঁ-মন্তর # তাঁর ঝুলিতে থাকত/ যত-রাজ্যের ফেলে-দেওয়া/ রকমারি পুরনো জিনিস/ যখন হাত ঢুকিয়ে বার করত/ কী আশ্চর্য/ একেবারে ঝকঝকে নতুন….’ (‘সুখটান’ কবিতার অংশ/ চইচই-চইচই, ১৯৮৩)
দেখা যাচ্ছে, পেটের দায় থাকলেও কবি সুভাষের মনের খিদে ছিল ঢের বেশি। উপন্যাসও লিখেছেন ভেতরে জমে থাকা অজস্র অনুভূতিদের মুক্ত করার অভিপ্রায় থেকে, তলে তলে তৈরী হয়েও দ্বিধা মিশ্রিত অনেক অপেক্ষার পরে। যার জন্য প্রথম উপন্যাস ‘হাংরাস’ অভিজ্ঞতা ও বর্ণনার সমন্বয়ে অর্জন করে চূড়ান্ত সফলতা। উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে অনুজ কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে কথোপকথনে যে দ্বিধার কথা তিনি বলেছিলেন, ‘ওই যে থাকে না? উপন্যাসে মেয়েপুরুষের একটা ব্যাপার থাকে না? ওটা মনে হয় আমি ঠিক বুঝতে পারি না।’ যদিও এই লেখায় পূর্বে ও পরে দেওয়া কবিতার উদাহরণগুলি থেকে বলা যাবে যে, সে- দ্বিধা ছিল নিতান্তই অমূলক। উপন্যাস লিখে স্বচ্ছলতার সম্ভাবনায় তিনি কলমের সঙ্গে আপোষ করে কখনও মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। যে কারণে ‘অন্ত্ররীপ’ লেখার জন্য তাঁকে বাঁকুড়ায় কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে গিয়ে থাকতে হয়েছে মাসদুয়েক। আসলে মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজে পেতেন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতিধ্বনি। আর সেই প্রতিধ্বনি প্রাত্যহিক অনুষঙ্গে আশ্রয় পেয়েছে চমকপ্রদ কাব্যভাষার অনন্য নির্মাণে। কারণ কবিতা ছিল তাঁর কাছে সর্বক্ষণের প্রাণভ্রমরা।
৫
একটি লম্বা কবিতায়, শাশুড়ি, বউ, মৃতস্বামী এবং ছেলেদের নিয়ে গড়ে ওঠা কাহিনীতে শেষ দু-তিন পঙক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তার সারমর্মে পৌঁছতে। কবিতায় কাহিনী নির্মাণে পরস্পর ঘটনা-প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে— ‘শাশুড়ি বিড়বিড় করে মালা জপছেন,/ বউ/ গটগট গটগট করে হেঁটে গেল। …. কলতলায়/ ঝমর ঝম খনন খন ক্যাঁচ ঘ্যাঁষঘিঁষ ক্যাঁচর ক্যাঁচর/ শব্দ উঠল।/ বাসনগুলো কোনোদিন তো এত ঝাঁজ দেখায় না—/ বড় তেল হয়েছে। …. মিনসের আক্কেলও বলিহারি! কোত্থেকে এক কালো অলক্ষুণে/ পায়ে খুরঅলা ধিঙ্গি মেয়ে ধরে এনে/ ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেল/ কেন? বাংলা দেশে ফরসা মেয়ে ছিল না? …. রাত্রে/ বড় ছেলের ঘরে আড়ি পেতে/ এই এই কথা কানে এল— # বউ বলছে, ‘একটা সুখবর আছে।’/ পরের কথাগুলো এত আসতে যে শোনা গেল না।/ খানিক পরে চকাস চকাস শব্দ,/ মা হয়ে আর দাঁড়াতে লজ্জা করছিল।/ কিন্তু তদন্তটা শেষ হওয়া দরকার—/ বউয়ের গলা, মা কান খাঁড়া করলেন।/ বলছেঃ ‘দেখো, ঠিক আমার মতো কালো হবে।’/ এরপর একটা ঠাস করে শব্দ হয়া উচিত।/ ওমা, বউমা বেশ ডগমগ হয়ে বলছেঃ/ ‘কী নাম দেব, জান?/আফ্রিকা।/ কালো মানুষেরা কী কাণ্ডই না করছে সেখানে।।’ (মেজাজ/ যত দূরেই যাই, ১৯৬২) শেষ দ্বিতীয় লাইনে এসে থমকে যেতে হয়। একদম আটপৌরে সমাজের ভাষা, ছবি ও সংলাপ বুনে বুনে, দৃশ্যত নিপাট গদ্যের ঢঙে (ছন্দের চেতনাবোধ যখন অবচেতনকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি পায়) কবিতাটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেলেন, পাঠক সেখানে স্তম্ভিত হয়ে মাথার টুপি নামিয়ে দেয়।
‘কাল মধুমাস’ (১৯৬৬),-এর সুদীর্ঘ নাম-কবিতায় ফুটে উঠেছে কবির জীবন-কোলাজ। কবি ছোটোবেলায় এক ভয়ঙ্কর অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যার ফলে জখম হয়েছিল তাঁর দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি এবং স্মৃতিশক্তিও। ‘বার বার ফিরে আসা নয়।…. মনে রেখো,/ এ নদীতে একবার/ একটি মাত্র খেপ।/ তা নিয়ে আক্ষেপ/ করবার/ পাত্রই আমি নই।।…. যদিও আবাল্য চোখে দেখে আসছি কম/ ইদানীং ডান কানে/ ইস,/ একদম শুনছি না— দ্রোণাচার্য তুচ্ছজ্ঞানে/ নেন নি ভাগ্যিস/ বাল্যে বুড়ো-আঙুল দক্ষিণা। # পারলে তাই দেখাতে ভুলি না/ যখন যেখানে যাকে/ দেখানো দরকার। …. তোমার সময় দিয়ে তাই/ বৃথা চেষ্টা আমাকে মাপবার। …. যাই/ গিয়ে দেখে আসি/ কী বীজ বুনছে মাঠে চাষী। ….আকাশটা দুখানা করবে/ বিদ্যুৎ ঝলক।/ নেব না বর্ষাতি কিংবা ছাতা। # আমার স্বভাব নয়, তাই/ বাঁচাই না মাথা/—রোদে না, জলে না। # যাই/ কিছুক্ষণ গিয়ে বসি। যে-পুকুরে মাছগুলো/ জলের গভীরে দিচ্ছে ঘাই।/ ফাৎনায় বেঁধানো থাকবে চোখ …. বিকেলে মিছিল থাকলে আজ/ ছোকরাদের সঙ্গে যাব পাল্লা দিয়ে হেঁটে/ সারিবদ্ধ দুটো হাত দোলাতে দোলাতে। ….আর যদি ভাগ্যে যায় জুটে/ তবে বাড়ি-গাড়িও হাঁকাব। …. কে হে লোকটা/ এক হাতে বোঁটাসুদ্ধ চুন/ অন্য হাতে কোঁচা?/ যেতে যেতে দিয়ে গেল খোঁচা?/ ‘কী মশাই, লিখছেন না কেন?/ লিখুন! লিখুন!’ # লোকটার বরাত ভালোঃ/ চলে গেল।/ নইলে ও নির্ঘাৎ হত খুন। …. আবগারি-দারোগা হয়ে বাবার যে নামডাক এত—/ দাদা বলত, কী জন্য বল্ তো?/ কারণ, নেন না বাবা ঘুষ।/ জল দিয়ে লজেঞ্চুস/ এক রকম ঘুষ।। …. কাঁথিতে কোথাও কোনো সমুদ্রের ধারে/ নুন তৈরী করতে গিয়ে পুলিশের বুটের কাঁটায়/ ঝাঁঝরা হয়েছিল যার পিঠ—/ সে এল স্ট্রেচারে। # সমস্ত শহর ক্ষুব্ধ; ফেটে পড়ছি রাগে/ আমরা সবাই।/ মাঝে মাঝে হাঁক উঠছেঃ জোরসে বলো, ভাই—/ বন্দে মাতরম্। …. মাকে মনে পড়ে।/ মা আমাকে বলতেন বাঁদর। # কিন্তু তবু যখনই বৃষ্টিতে ঝড়ে/ চমকাত বিদ্যুৎ/ পাসে এসে মা বলতেন হেঁকেঃ/ জয়মণি! স্থির হও। # যে-মন্ত্রে ঘেঁষে না কাছে ভূত/ সে-মন্ত্র তো মার কাছেই শেখা। …. দেঝুন, আমার একটা কুষ্ঠির দিরকার। …. আমার মনের মধ্যে জন্মগত একটা ছবি আছে,/ একেবারে শীতের শেষদিন।/ পাতা নেই গাছে।/ দুটি ঠোঁট শব্দ তুলে অন্য দুটি ঠোঁটে/ বলে ওঠেঃ/ ‘মনে নেই? কাল মধুমাস!’ # বলেছিল আর কেউ নন। # বললাম তো কারণ—/ মা তখন আমাকে নিয়ে যন্ত্রণায় নীল।’ জন্মবৃত্তান্ত, সমাজ-পরিবেশ, আত্মীয়বর্গ, বাবার কর্মক্ষেত্র থেকে শৈশবে লব্ধ মূল্যবোধ, লবন-বিদ্রোহে গান্ধিবাদী অসহযোগ আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা সংগ্রামী চেতনা, মিছিলে চলা, বাবু-কালচার, স্নেহ-ভালোবাসা ও বিদ্রুপ, কুষ্ঠি-রাশির মিথ থেকে মায়েয় প্রসব বেদনার যাবতীয় সংমিশ্রণে বেড়ে ওঠা জীবনের অনবদ্য স্মৃতিকথন।
‘ডান কানটা বিগড়ে গেলেও/ বাঁ কানটা আছে/ তাইতে ধরছি কে এবং কী/ ছাড়ছে ধারে-কাছে— …. ‘ফুলকি ছেড়ে ফুল ধরেছেন/ মিছিল ছেড়ে মেলা/ দিন থাকতে মানে মানে/ কাটুন এই বেলা।‘ # হেই গো দাদা, ছাড়ুন ঠ্যাং—/ চলে যাচ্ছি ড্যাডাং ড্যাং।।’ (ল্যাং/ এই ভাই, ১৯৭১) এখানে ছড়া কেটে কবি যে বিদ্রুপের অবতারণা করেছেন, তাতে নিজের সিদ্ধান্তকে স্পষ্ট করেছেন রাখ ঢাক না রেখে, মতান্তরের ফসল হিসেবে। কবি সুভাষের থোড়াই কেয়ার ভাব ফুটে ওঠে, ‘আমি তো আর ফটোয় তোলা ছবি নই/ যে,/ সারাক্ষণ হাসতেই থাকব! # আমার মুখে তো চোঙ লাগানো নেই/ যে,/ সারাক্ষণ গাঁক গাঁক করব! আমার তো হাতে কুষ্ঠ হয় নি/ যে,/ সারাক্ষণ হাত মুঠো করে রাখব!’ (দুয়ো/ ঐ) এই যে শ্লেষমুখোর বিদ্রোহ, যা একান্তই মর্মান্তিক এবং ঐতিহাসিক কলঙ্কও বটে। পাবলো নেরুদার লাঞ্ছিত জীবনাবসানের কথা স্মরণে রেখে এই ক্ষেত্রে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের এক আলাপচারিতার কথা মনে পড়ছে। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘সুভাষদার সঙ্গে পথ চলা’ শিরনামে শঙ্খ ঘোষের লেখা থেকে অংশবিশেষ—
“সেটা ছিল বোধহয় ১৯৫৪ সালের এক ডিসেম্বর-সন্ধ্যা। ইডেন গার্ডেনস্-এ মস্ত আকার নিয়ে চলছে কয়েকদিনের যুব-উৎসব। …. অনেকের সঙ্গে দেখা অনেকের সঙ্গে কথা, বেশ একটা ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সঙ্গে আছেন সুভাষদা।
ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সুভাষদা বললেনঃ ‘শোনো, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে। চলো একটু ওইদিকে যাই।’
মন্থর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আলোবিরল জনবিরল একটা অংশে পৌঁছে গেছি, কিন্তু কথাটা আর বলছেন না উনি। অনেকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত বলে ফেললেনঃ ‘ তোমার বিষয়ে একটা গুজব শুনছি, সেটা কি সত্যি?’
‘গুজব? আমার বিষয়ে? কিসের গুজব?’
আবার অনেকক্ষণ চুপ থেকেঃ ‘শুনলাম তুমি পার্টি মেম্বারশিপ নেবার কথা ভাবছ?’
চমকে উঠলাম শুনে। এবার নীরব থাকবার পালা আমার। কেননা, নিশ্চিত জানি যে উত্তরটা শুনে উনি আশাহত হবেন, আর সে-আঘাতটা আমার দিতে ইচ্ছে করছে না এই সুন্দর সন্ধ্যায়। ইস্কুলজীবন থেকে শুরু করে কখনোই কোনো দলীয় রাজনীতির অন্তর্গত হবার অভ্যাস আমার নেই, ইচ্ছেও নেই। দলীয়তার কথা ভাবলেই একটা দমচাপা অনুভব টের পাই ভিতরে। কিন্তু অন্যদিকে এও ঠিক যে ব্যক্তিগতভাবে একটা রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনুবর্তী হয়ে আছি বেশ কিছুদিন ধরে, আর সেই সূত্রেই সুভাষদার এতটা কাছাকাছি আছি এই দু-বছর। একজন কমিউনিস্ট লেখক কেমন হতে পারেন, তার মডেল ভেবে চলেছি তাঁরই জীবনযাপনকে, তিনিও অনেকটা স্নেহ করছেন আমাকে। সেই স্নেহপথে হয়তো এখন তিনি আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চান নিবেদিতপ্রাণ একজন পার্টিকর্মী হিসেবেও, গুজবটা তাই যাচাই করে নিচ্ছেন এই নিরালায়।
অনেকটা দ্বিধার পর, ব্যথা দেওয়া হবে জেনেও, বলতেই হলো তাঁকেঃ ‘না, কথাটা ঠিক সত্যি নয়। ও-রকম কোনো ভাবনা আমার নেই। ওটা আমি পেরে উঠব না।’
শুনে, আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন তিনিঃ ‘সত্যি নয় তবে? খুব ভালো। শোনো, এখন তো নয়ই, লিখতে যদি চাও, পার্টি মেম্বারশিপ নেবার কথা ভেবো না। পার্টির কাজ যদি করতে চাও, তাহলে বাইরে থেকে করো। বাইরে থেকেই অনেক ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। দুপক্ষেই সেটা ভালো।’
‘আপনি? আপনি বলছেন এই কথা?’
‘হ্যাঁ, আমই বলছি। এ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনার আর দরকার নেই। তবে পার্টির কাজে সাহায্য করার কথা ভুলো না কখনো। মানুষের সঙ্গ ছেড়ো না। চলো এখন ওই দিকে যাই।’
আবার আলোর দিকে চলতে থাকি আমরা”
আমরা জানি যে, শঙ্খ ঘোষ চিরদিনই তাঁর চেতনা ও সিদ্ধান্তে আত্মোৎসারিত। তবু অগ্রজপ্রতিমের উপদেশ লঙ্ঘন করেননি কখনো। কিন্তু দ্বিধা থেকে বিস্ময়ে আবিষ্কার করেছেন সেদিন একজন শিল্পী ও দলানুদাসের ভিন্ন অবস্থান। দলানুগত থেকে স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অভাব ঘটলে মুক্ত চিন্তায় সৃজন-বিকাশ কোনো কালেই হয়নি, হবে না। সমাজের চোখে অবিশ্বাসে, ক্ষণস্থায়ী ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ হবে মাত্র। কবি সুভাস মুখোপাধ্যায়ের শততমবর্ষে এই সত্যই আজ প্রকট।
মায়াবী মৃত্যু-চেতনায় আবিষ্ট কবি ছোটো ছোটো সিঁড়ি ভাঙা পঙক্তিতে, অসাধারণ অন্তমিলে মেঘ, হাওয়া, রোদ, ছায়া, ফুল, পাখি, ছুঁচ, সুতো, জুতোর ফিঁতে, ছবি, গান, সিঁড়ি, কাঠের পিঁড়ি, আশা, কুয়াশা, গরু, মোষ, সাপ, ব্যাং, কাজললতা, পাপোশ, মুখচুম্বন, বাহুবন্ধন, ভয়, লজ্জা, কাঁচালঙ্কা, বোমা, বন্দুক, বাংলাভাষা, রবিঠাকুর, লেপ, কাঁথা, বই, খাতা, ভাত, রূটি, সমকাল, শপথ ইত্যাদি সকলকে যাচ্ছি যাচ্ছি বলে বিদায় জানিয়ে সব শেষে এই জন্মের প্রতি টান জানিয়ে বলছেন, ‘ও মায়া/ আসছি/ ও মিউ….’ (যাচ্ছি/ জল সইতে, ১৯৮১) অর্থাৎ যাবতীয় ব্যবহারিক অনুষঙ্গ ত্যাগ করতে চাওয়ার পরেও বিবাগী মনের পিছুটান, মায়া ও মমতার প্রতি অনুরাগে এক দরদি মনের ছবি তুলে ধরেছেন ঋজু-শান্ত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
৬
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে শেষ দুটি কবিতার কথা উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করব। ‘সপ্তাহ’, শারদীয়া সংখ্যা ২০০৩-এ প্রকাশিত কবিতাদুটির উৎস সম্পর্কে জানানো হয়েছে, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় জীবনাবসানের আগে পি জি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তাঁর এই কবিতা দুটি হাসপাতালে তাঁর ডায়েরিতে পাওয়া গিয়েছে। কবিতা দু’টি গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (সহকর্মী ও সহধর্মী) সৌজন্যে প্রাপ্ত।’ ১) ‘জানি না ঠিক/ কোথায় তুমি,/ রফিক/ তোমার জন্যে/ হাতে বেঁধেছি/ মন্ত্রপূত তাবিজ/ গাছের ডালে/ ঝুলিয়ে দিয়ে ঢেলা/ খোদা হাফিজ/ খোদা হাফিজ/ বলেছি সারাবেলা # রাস্তায় লাল ডাকবাক্সে ফেলা/ ঠিকানাহীন খামে’ এবং ২) ‘দেখা হলেই ‘ভালো তো সব?’/ তারপর—/ কী খবর?’ উত্তরটা জানা। একেই বলে লৌকিকতা/ একেই বলে প্রথা। উঠতে বসতে ধরছে হাঁপ—/ মনের কথা যদি না আনি মুখে/ শুনবে কেউ?/ কী করে বলি খারাপ!/ বেশ তো আছি/ পায়ের নীনে সবুজ জাজিম/ মাথায় নীল মেরাপ।’ কবিতাদুটির মধ্যে পদাতিক জীবনের পথে মাটি থেকে শৃঙ্গে উঠে, আগামীর ঠিকানায় পাঠানো কয়েকটি মূল্যবান দিশার হদিশ দিয়ে গেলেন কবি, কবিতার রসিক বাচনে, সাম্য-দর্শনের ইঙ্গিত রেখে গেছেন, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। দুটি কবিতাতেই রঙের ব্যবহারগুলি লক্ষণীয়। মানুষের বিশ্বাসকে সম্মান করা যেমন জাতীয় ঐতিহ্য, তেমনই অধীত বিদ্যাকে ব্যক্তিগত যন্ত্রণায় সীমাবদ্ধ না রেখে, আপসোসের আড়ম্বর সরিয়ে, প্রকৃতিকে গ্রহণ করার যে বাস্তবতা, যে বিলাসহীন প্রশান্তি, তাই যেন জীবনসায়াহ্নের বার্তা হয়ে উঠে এসেছে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিদায়-কলমে।