জসীম উদদীন: পল্লী কবি কিন্তু আধুনিক

জসীম উদদীন: পল্লী কবি কিন্তু আধুনিক
আবু আফজাল সালেহ
জসীম উদদীন ‘পল্লী’ কবি। তবে চিন্তা ও চেতনায় তিনি ‘আধুনিকতা’-ও ধারণ করে লিখেছেন। রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি কতেছেন। তিনি আধুনিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আবহমান ও চিরায়ত সবুজবাংলার সাধারণ ও সহজলভ্য উপাদানের ডালি ভরিয়ে কবিতায় বুনন নির্মাণ করেছেন। সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন।
জসীম উদদীনের আখ্যানমূলক কাব্য চারটি হচ্ছে: নকশীকাঁথার মাঠ(১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট(১৯৩৩), সকিনা(১৯৫৯), ও মা যে জননী কান্দে(১৯৬৩)। আখ্যানমূলক কাব্যগুলোর শব্দাবলি বা উপাদানগুলো আশেপাশের; সবুজবাংলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মাইকেল, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি আখ্যান বা কবিতায় রামায়ণ-মহাভারত, লোকগপুরাণ বা ধর্মীয় ঐতিহ্যের কাছে হাত পেতেছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জসীম উদদীন ব্যতিক্রম ও অনন্য। তার আখ্যানকাব্য জনপ্রিয়তা ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য। জীবনানন্দ দাশও গ্রামবাংলার উপাদান নিয়ে কবিতা নির্মাণ করেছেন; তবে তার আখ্যানকাব্য নেই। জসীম উদদীনের অন্ত্যমিলের কবিতাগুলো কানে সমধুর ঝংকার তোলে। নকশীকাঁথার মাঠ সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। সোজন বাদিয়ার ঘাট-ও জনপ্রিয় কাব্য। এ দুটি আখ্যানকাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত।
নকসী কাঁথার মাঠ কাব্য ঞযব ঋরবষফ ড়ভ ঊসনৎড়রফবৎবফ ছঁরষঃ নামে ইংরেজিতে অনুবাদক করেছেন ঊ.গ. গরষভড়ৎফ। সেসময়ে(এমনকি এখন পর্যন্ত) বাঙালিসাহিত্যিক ও সাহিত্য নিয়ে এমন উপস্থাপন খুব কমই দেখা গেছে। তার মূল্যায়ন- ‘ঔধংরসঁফফরহ ঠরষষধমবৎ’ং ৎবলড়রপব ধহফ ংঁভভবৎ, ফবংরৎব ধহফ ঁহফবংরৎবফ, যধঃব ধহফ ফবংঢ়ধরৎ ভৎড়স ঃযব াবৎু ফবঢ়ঃয ড়ভ ঃযবরৎ ংড়ঁষ; ঞযবৎব রং হড়ঃযরহম ঃৎরাধষ ধনড়ঁঃ ঃযবস, হড়ঃযরহম ংঁঢ়বৎভরপরধষ, ঃযবু ধৎব ৎবধষ’। আন্তর্জাতিক খ্যাতিস¤পন্ন বিশিষ্ট লোক-সাহিত্যিক উৎ. ঠবৎৎরৎ ঊষরিহ নকসী কাঁথার মাঠ পড়ে মন্তব্য করেন: ‘ও ৎবধফ ঃযব ঢ়ড়বস রিঃয মৎড়রিহম বীপরঃবসবহঃ ধহফ যধাব ৎবঃঁৎহবফ ঃড় রঃ ধমধরহ ধহফ ধমধরহ ঃড় নব ফবষরমযঃবফ নু রঃং ংরসঢ়ষরপরঃু, রঃং ফববঢ় যঁসধহরঃু’. উল্লেখিত দুজন প-িতের মন্তব্যেই বুঝা যায় যে, কবি জসীম উদদীনের কাব্যপ্রতিভায় লোকজ উপাদানের ব্যবহারের দক্ষতা। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগর-চেতনাস¤পন্ন, নাগরিক জীবন-স্বভাব ও আচার-আচরণে অভ্যস্ত এবং সাহিত্য-চর্চার ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট, জসীম উদদীন সেখানে এক উজ্জ্বল, ব্যতিক্রম। তার কবিতায় তিনি আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। বলে রাখি, কবির কবিতা পড়লে বুঝা যাবে, লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়।
সোজন বাদিয়ার ঘাট কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যের মতো এটাও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টঘঊঝঈঙ কর্তৃক ‘এুঢ়ংু যিধৎভ’ নামে অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক পাঠক-সমাজে পরিচিতিলাভ করেছে। দুটি আখ্যান কাব্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিদেশি অনেক মনীষী কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। দুটো কাব্যেই অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস। সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। অন্য আখ্যান-কাব্যেও তাই। এটাও কিন্তু আধুনিকতা ও উদারনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হিন্দু কিশোরি দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সোজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীম উদদীন লিখলেন, ‘এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে/মাথার ওপর একই আকাশ ভাসছে রঙের নীলে/এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি/সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি।’-(সোজন বাদিয়ার ঘাট)
কবি জসীম উদদীনের নকসীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সখিনা ইত্যাদি কাহিনীকাব্য এদিক হিসাবে স¤পূর্ণ নতুন। আধুনিক বাংলা কাব্যে যারা আখ্যান-কাব্যের রচয়িতা তারা কেউই জসীম উদদীনের মতো এভাবে মৌলিক কাহিনী নির্মাণ করেননি। এসব আখ্যানকাব্যের মূল উপাদান লোকজ থেকে নেওয়া। অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় স¤পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীম উদদীন নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রামবাংলা থেকে। রাখালী, বালুচর, ধানখেত ইত্যাদি কাব্যের ক্ষেত্রেও তাই। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। তবে কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে।
কবি জসীম উদদীন বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের গীতিকার। এমন সব গান কে না শুনেছেন! গান নিয়ে সঙ্গীত গ্রন্থগুলো: রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৩৫), গাঙের পাড়(১৯৬৪), জারি গান(১৯৬৮), মুর্শিদী গান(১৯৭৭)। বোবা কাহিনী(১৯৬৪)নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। তার ভ্রমণকাহিনীগুলো চমৎকার। চলে মুসাফির(১৯৫২), হলদে পরির দেশ(১৯৬৭), যে দেশে মানুষ বড়(১৯৬৮) ও জার্মানীর শহরে বন্দরে(১৯৭৫)। নাটক ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও আছে। রাখালী(১৯২৭) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া বালুচর(১৯৩০), ধানখেত(১৯৩৩), হাসু(১৯৩৮), মাটির কান্না(১৯৫১), এক পয়সার বাঁশি(১৯৫৬), হলুদ বরণী(১৯৬৬), জলে লেখন(১৯৬৯), পদ্মা নদীর দেশে(১৯৬৯), দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি(১৯৮৭) উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
আধুনিক কবিতায় অলংকারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীম উদদীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমসোক্তি ও অন্যান্য অলংকারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলংকারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ। যুতসই উপমা ও অনুপ্রাসের ব্যবহার কবিতার শিল্পগুণকে উন্নীত করেছে। প্রতিনিধি হিসাবে কিছু উল্লেখ করছি। প্রথমেই ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ থেকে কিছু অলংকারিক(উপমা ও অনুপ্রাস) প্রয়োগ দেখে নিই:
‘কাঁচা ধানের পাতার মত কচি মুখের মায়া’, ‘লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী’, ‘কচি কচি হাত-পা সাজুর সোনার সোনার খেলা,(যমক)/তুলসী তলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঝের বেলা’, ‘তুলসী ফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলেত ধূপ’, ‘কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো’, ‘বাজে বাঁশী বাজে, রাতের আঁধারে, সুদূর নদীর চরে,/উদাসী বাতাস ডানা ভেঙে পড়ে বালুর কাফন পরে’-(সমাসোক্তিসহ)।
অন্যান্য কাব্য থেকে কিছু উদাহরণ টেনে দিতে পারি এভাবে:
(১) ‘চলে বুনো পথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন পরি।/দুর ছাই,কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি’।-(উপমা ও অনুপ্রাস প্রয়োগ,পল্লী জননী, রাখালী)
(২) ‘হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুফু, সাত বছরের মেয়ে/ রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল বেহেস্তের দ্বার বেয়ে।’-(অনুপ্রাস ও উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ, কবর/রাখালী)
(৩) ‘হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোৎ¯œায় জাল পাতি,/টেনে টেনে তবে হয়রান হয়ে, ডুবে যায় সারারাতি।’-(সমাসোক্তির প্রয়োগ, নকসী কাঁথার মাঠ)
(৪) ‘উদয় তারা আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পূবের পথে,/ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে’। -(সোজন বাদিয়ার ঘাট)
গ্রাম বাংলার মানুষের আথিথেয়তা বিশ্ববিখ্যাত। নিমন্ত্রণ কবিতায় জসীম উদদীনের স্বর এবাবেই বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে, ‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের/ছোট গাঁয়,/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,/মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের /¯েœøহের ছায়,/তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের/ছোট গায়।’ গ্রামবাংলার বর্ষার দৃশ্য-মেঘ নিয়ে কবির বর্ণনা: ‘আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়েছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে,/কেয়া বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল ধরে।/কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝুম নিরালায়,/ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়।(পল্লী বর্ষা)
রূপক, উপমা, প্রতীক, রূপকল্পের বিচিত্র, নৈপুণ্যপূর্ণ ব্যবহার আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আগের যুগেও এর ব্যবহার ছিল। চিরচেনা পরিবেশ নিয়ে জসীম উদদীনের কবিতার চিত্রায়ণ খুব স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হয়। আশেপাশের লোকজ উপাদানের এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি:
(১) ‘মাঠের যতনা ফুল লয়ে দুলী পরিল সারাটি গায়,/খোঁপায় জড়ালো কলমীর লতা, গাঁদা ফুল হাতে পায়।’-(সোজন বাদিয়ার ঘাট)
(২) ‘পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সংকেত/সবুজে হলুদে সোহাগ ভুলায়ে আমার ধানের খেত’। (ধানখেত)
(৩) ‘এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,/কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!/কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া, /তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।/জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু,/গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।/বাদল-ধোয়া মেঘে কেগো মাখিয়ে দেছে তেল,/বিজলী মেয়ে পিছে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।’-(নকসীকাঁথার মাঠ)
(৪) ‘‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,/এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।/‘কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙ্গল দিয়ে খেলি,/নিড়িয়ে দেই ধানের খেতের সবুজ রঙের চেলি’।/…খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা লাঙল-চষা,/সারাটা দিন খেলে— জানি জানিইনেক বসা।’’-(রাখাল ছেল, রাখালী)
বলে রাখি এমন সাধারণ উপাদানে অসাধারণ বুননের কবিতা অনেক। উল্লেখিত কবিতাংশ তার কবিতার প্রতিনিধি হিসাবেই ধরে নেওয়া শ্রেয় হবে।
চরিত্র নির্মাণে(বিশেষত নায়ক-নায়িকা) কবি জসীম উদদীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপমার প্রয়োগে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আর অন্ত্যানুপ্রাস তো কবির স্বভাবজাত।
(১)‘সোজন যেনবা তটিনীর কূল, দুলালী নদীর পানি/জোয়ারে ফুলিয়া ঢেউ আছড়িয়া কূল করে টানাটানি/নামেও সোজন, কামেও তেমনি,শান্ত স্বভাব তার/কূল ভেঙে নদী যতই বহুক, সে তারি গলার হার।’- (সোজন বাদিয়ার ঘাট)
(২) সকিনা আখ্যানকাব্যে নায়িকা সকিনাকে নিয়ে নায়ক আদিলের স্বপ্ন; জসীম উদদীনের কবিতায়, ‘সকিনারে লয়ে আদিল এবার পাতিল সুখের ঘর,/বাবুই পাখীরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর।/স্রোঁতের শেহলা ভাসিতে ভাসিতে একবার পাইল কূল,/আদিল বলিল,‘‘গাঙের পানিতে কুড়ায়ে পেয়েছি ফুল’’।/এই ফুল আমি মালায় মালায় গাঁথিয়া গলায় পরিয়া নেব,/এই ফুল আমি আতর করিয়া বাতাসে ছড়ায়ে দেব।/এই ফুল আমি লিখন লিখিব,ভালোবাসা দুটি কথা,/এই ফুলে আমি হাসিখুশি করে জড়াব জীবনলতা।’
প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহ-বেদনার বর্ণনাতেও নিখুঁত। এ যেন মধ্যযুগের কবি বিদ্যাপতির ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’ কবিতাংশের মতো জসীম উদদীনের স্বর: ‘আজকে দুলীর বুক ভরা ব্যথা, কহিয়া জুড়াবে/এমন দোসর কেহ নাই হায় তার,/শুধু নিশাকালে, গহন কাননে, থাকিয়া থাকিয়া/কার বাঁশী যেন বেজে মরে বারবার।/ৃ..কে বাঁশী বাজায়! কোন দূর পথে গভীর রাতের/গোপন বেদনা ছাড়িয়া উদাস সুরে,/দুলীর বুকের কান্দনখানি সে কি জানিয়াছে,/তাহার বুকেরে দেখেছে সে বুকে পুরে?’(সোজন বাদিয়ার ঘাট)
রবীন্দ্রনাথ ‘ময়নামতীর চর’ পড়ে লিখেছিলেন: ‘‘তোমার ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং ¯পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গীতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি। তাতে করে কবিতাগুলি আরও সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট ¯পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনা কবিতায় পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’’
জসীম উদদীন বেশ কিছু জনপ্রিয় লোক ও ধর্মীয় গানের গীতিকার। ‘আমার সোনার ময়না পাখি…’, ‘আমার গলার হার খুলে নে…’, ‘আমার হার কালা করলাম রে…’, ‘আমায় ভাসাইলি রে…’,‘আমায় এতো রাতে…’, ‘কেমন তোমার মাতা পিতা…’, ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই…’,ও ‘বন্ধু রঙিলা, রঙিলা নায়ের মাঝি…’, নিশীথে যাইও ফুল বনে…’, ‘ও ভোমরা…’,‘ও বাজান চল যাই মাঠে লাঙল বাইতে..’, ‘প্রাণ শখি রে ঐ শুনে কদম্ব তলে…’, ‘ও আমার দরদি আগে জানলে…’, ‘বাঁশরি আমার হারাই গিয়াছে…’, ‘আমার বন্ধু বিনুধিয়া…’ গানগুলো আমাদেরকে তৃপ্তি দেয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এরকম অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার কবি জসীম উদদীন।
আধুনিকতা স¤পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য: ‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ আবার জীবনানন্দ দাশ মনে করেন, ‘বাংলা কাব্যে কিংবা কোনো দেশের বিশিষ্ট কাব্যে আধুনিকতা শুধু আজকের কবিতায় আছে; অন্যত্র নয়, একথা ঠিক নয়’। কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত কাব্যকে আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করা যায়। জসীম উদদীন এ সংকীর্ণ অর্থে পল্লীকবি নন। নকসীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সকিনা কিংবা বেদের মেয়ে ইত্যাদির উপাদান-উপকরণ পল্লীতে পাওয়া গেলেও কাহিনীবুনন, কবিতায় শব্দচয়ন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, প্রতীক ও রূপক নির্মাণ শিল্পসম্মত ও আধুনিক। কবি হিসাবে তিনি শুধু পল্লীর নন, আবার শহরেরও নন। বরং এই দুয়ের মধ্যে সংযোগ সেতু।
রবীন্দ্রনাথের মতে, জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা তার সমসাময়িক কবিদের কাব্যরীতির অনুসরণ-অনুকরণ না করে লোক-ঐতিহ্যের ধারা নিয়েই সাহিত্যরচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় যেমন আছে প্রেম, মৃত্যু, তেমনি আছে চর দখলের লড়াই, আবার আছে অধিকার আদায়েরও লড়াই। জসীম উদদীনের চরিত্র ও নায়ক-নায়িকা আমাদের খুব চেনা ও আপন। ঘটনাবলিও চিরচেনা। চেনা-পরিবেশের শব্দাবলি নিয়ে খেলা করেছেন এবং আমাদের মনে গেঁথে গেছেন। আমাদের মনের প্রতিনিধি হয়ে তিনিই কথা বলেছেন; কবিতার মাধ্যমে। সে বিচারে তিনি আমাদের মানস-কবিও বটে। আমরা প্রতিবছর বরীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী ইত্যাদি করি। এটা তাদের প্রাপ্যতা। বর্তমানে জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুনীল, মহাদেব, শামসুর রাহমান প্রমুখ কবিদের নিয়ে যতটা আলোচনা করছি; তবে জসীম উদ্দীনকে তেমন করছি না। কাব্যপ্রতিভা জসীম উদদীনের কম নয়। সামান্য আলোচনায় তা বুঝা যায়। এতে তার আরও মূল্যায়ন দাবি করে।