রম্যরচনা : জন্মদিবস এবং বাকি দিবসের ইতিহাস

রম্যরচনা : জন্মদিবস এবং বাকি দিবসের ইতিহাস

জন্মদিবস এবং বাকি দিবসের ইতিহাস

তাপস চক্রবর্তী

আমাদের সময় জন্মদিবস লইয়া এতো হৈ হুল্লোড় কস্মিনকালেও ছিল না। আর ছিলো না বলিলেও বড্ড বেশি বলা হইবে না। কেনোনা আজকাল এতো দিবসের পয়গাম, কখন যে মুরগী দিবস আসিয়া উপস্থিগ হইবে… তাহা ভাবিতেই শিহরিত হই।
এইসব দিবসের মধুসঙ্গম লইয়া যেইসব লঙ্কাকান্ড বাঁধিয়াছে তাহা ক’জনেইবা মনে রাখিয়াছে– এইতো সেদিন সি আর বি সাতরাস্তার মোড়ে কথিত মোড়লের জন্মদিন পালন চক্ষে দেখিলাম। শ’খানেক ইঞ্জিন চালিত দ্বী-চক্রযানের সমারোহ। অতঃপর নবীনের হৈ হুল্লোড়, বিয়ারের ছড়াছড়ি, কান ফাটানো ড্রামের শব্দ লহরী, বেলুনের ফুলঝুরি। এরপর মূহুর্তে যা দেখিলাম বেলুনগুলো টুসটাস করিয়া অতঃপর ফুটিয়া চুপসে গেলো, উপস্থিত ললনারা ক্রন্দন ধ্বণিতে আকাশপাতাল ভেদ করিয়া উঠিলো। দু’পা এগিয়ে যেতেই দেখিলাম একঝাঁক নবীনের অস্ত্রের ঝনঝনানি… রক্তের মাখামাখি এবং পত্রিকান্তে পরেরদিন উহা শিরোনাম হইল এই মর্মে ‘অমুক নেতার জন্মদিনে তমুক নেতার আক্রমণ’। উপসংহারের স্থিতি… উহা ছিলো একরকম মেয়ে ঘটিত ব্যাপার। আহ কী সুখ! ফিরিয়া গেলাম ট্রয় নগরীতে… চক্ষু বন্ধ করিয়া হেলেনকে আহ্বান করিলাম। বলিলাম, “এবে এসো হেলেন, দেখো– এখনও প্রেমের জন্য রক্ত ঝরে… আবার কেউ কেউ ভালোবাসিয়া ঘর ছাড়িয়াছে, আবার কেউ কেউ ভালোবাসিয়া সন্তানের মোহ ছাড়িয়াছে, অতএব আজ আমায় একফোঁটা ভালোবাসার অমৃত বারি দাও। ভালোবাসো। হে হেলেন জুড়াও প্রাণ”
চক্ষু খুলিতেই সম্মুখ সমরে উপস্থিত লাইলি একখানা গোলাপ হাতে দিয়ে কহিলো, “এসো দোঁহে মন্থন করি গোলাপের কান্না…”
শিরিন কহিলো মরুর তপ্ত বালুকণা ও আগুনের কথা। অথচ রাধার প্রেম মাহাত্ম্যের গুঞ্জণ বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ জানে। যেমনটি উড়িষ্যার মাটি ছুঁয়ে যে প্রেম উচ্ছ্বাসিত আজ পৃথিবীর সাহিত্যে, সেইসব ছিল অমৃত ভাণ্ডার। কিন্তু কলিকালে প্রেমের কােনো সরলার্থ নেই। বক্ররেখায় ধাবিত সহস্রধারা। সেজাসাপ্টা বয়ান প্রেম ভালোবাসার অর্থ আজকাল দেহজবল্লরী শয্যা। ইত ভালোবাসা দিবস।
আহ্ প্রেম! আহ্ জন্মদিবস! আহ্ গোলাপ আহ্ আলাপ। আজ সবারই হোক জয়… জানি পৃথিবীর সব পুষ্পই রীতিমত চমৎকৃত কিন্তু আমাদের সময়কার জন্মদিবস মানেই আজও সবিতো স্মৃতির মুঞ্জরিতে বাঁধা গান– যেমনটি ঘটিয়াছে গত সপ্তান্তে আমার কণ্যার জন্মদিবস পালনে আর্থিক দৈণ্যতায় সূর্যগ্রহন লাগিল। বিষুব রেখায় শনির কোপানলে হঠাৎ গিন্নির চিৎকার থামিয়া গেলো… মনকে প্রশমিত করিলাম। ভাবিলাম যাহাদের নুন আনিতে পান্তা ফুরিয়ে যায় তাহাদের জন্য জন্মদিন তো শুধুই জোনাকপোকার আলো কিম্বা যজ্ঞের আগুনটির উপমাই যথার্থ সাদৃশ্য বলিয়া ধরিয়া লইলাম। মনে মনে নিজের মনকে প্রবোদ দিলাম– যাহা গন্য নয় তাহা কেবলি মরুভূমির মতো ফাঁকা। হায় কণ্যা দিবস
এইবার আবার জন্মদিবসে ফিরিয়া যাওয়া আবশ্যকতা আছে। কেনোনা আমার জীবনে প্রথম জন্মদিবস দেখা হয়েছিলো ইস্কুলে… মফস্বলে অজো পাড়াগাঁয়ের এক বনোদি ইস্কুলেই মাধ্যমিক জীবন। যদিও শ্রীহট্ট নামিক শহরে প্রাথমিক জীবন শেষে আরও দুই শ্রেণি অতিক্রম করিয়াছি। তথাপি অষ্টম শ্রেণি অধ্যায়নকালীন পিতার অশেষ আবদার তাহার শ্বশুড়কূলের নির্ভরতায় বাড়ুক সন্তান। অতএব পিতার যেই কথা সেই কর্ম। আমরা বাকশো পেটরা বাঁধিয়া চলিয়া আসিলাম শ্রীহট্ট হইতে চট্টগ্রাম। আমার মাতৃকূলের আশ্রয়ে এবং ভর্তি হইলাম সেই ইস্কুলে– যেই ইস্কুলে আমার আদর্শিক পরিবর্তন ঘটিয়াছে বলিয়া আজকাল প্রায় গণ্য। কালক্রমে ইহাই মাতৃকূল দিবস বলিয়া স্থিতি হইল।
আমাদের সময় প্রয়াশঃ ইস্কুল পরিদর্শনে, ইস্কুল পরিদর্শক মহাশয় আসিতেন। বিভিন্ন দিবসে, বিভিন্ন অনুষ্টানে কিম্বা অতর্কিত হামলা চালাইয়া ছাত্র শিক্ষকের ঘাম ছুটাইয়া ফেলিতেন। এখনকার সময় ইস্কুল পরিদর্শক বলিয়া আদৌও কিছু আছে কিনা সন্দেহ জাগে! এমন কি কয়জন শিক্ষক সেই শিক্ষা প্রতিষ্টানে পাঠদানে ব্যস্ত তাহা জানে কিনা সংশয় জাগে। তাহার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ কিম্বা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমার পুত্র। মনস্থির করিলাম ইহা পুত্র দিবস।
আজকাল কতো দিবসের হিড়িক– এইসব দিবসের বেহেল্লাপনায় আজ তিনশত পঁয়ষট্টি দিনেই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। অতএব এইসব দিবসের হিড়িকে আমি আমার শিক্ষক দিবসের কথা আজ বলিতে ব্যাকুল। শিক্ষকদিগকে সন্মান জানানোর মহান কর্মকে আমরা আমাদের ছাত্রাবস্থায় অত্যন্ত গৌরবজনক বলিয়া মনে করিতাম। ইত শিক্ষক দিবস।
আমার পিতৃদেবের মুখে শুনিয়াছি ষাট ও সত্তরের দশকে স্কুল শিক্ষকেরা কস্মিনকালেও গৃহশিক্ষকতা করিতেন না। যদিও তখনকার শিক্ষকদের বেতন ছিল যৎসামান্য এবং অনিয়মিত। ফলে শুধুমাত্র আদর্শে নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকেরাই শিক্ষকতা পেশায় আসিতেন। শত অভাবেও শিক্ষকেরা ছাত্রকে শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনকে ঘৃণার চোক্ষে দেখিতেন। একমাত্র শিক্ষিত বেকার সন্তানরাই গৃহশিক্ষকতা করে সামান্য যৎসামান্য অর্থোপার্জন করিতেন। ইহাকে অর্থ দিবস বলিলেও কি অন্যায় হইবে?
আমরা ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদিবসের কয়েক দিন আগে থেকেই প্রতিটি শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এক টাকা, কিম্বা অবস্থা ভেদে দু’ টাকা করিয়া চাঁদা তুলিয়া সামান্য অর্থ যোগাড় করিতাম। শিক্ষক দিবসে দেবদারু পাতা, লাল কৃষ্ণচূড়া পুষ্পের সমারোহ ঘটাইয়া শ্রেণীকক্ষ ও অফিসঘর সাজাইতাম। শিক্ষকদের বসার ঘরে শিক্ষক দিবসে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান পালিত হইতো। এবং অনুষ্ঠানের শেষে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে নানাবিধ ফল ও রসগোল্লা, সন্দেশ কিনে কলাপাতায় শিক্ষকদের সম্মূখে পরিবেশন করা হতো। শিক্ষকেরা দুই-এক টুকরো ফল বা মিষ্টি মুখে দিয়ে বাকি ফল ও মিষ্টি ভাঙিয়া ভাঙিয়া ছাত্র ছাত্রীদের মুখে তুলিয়া দিতেন। সত্যি কথা বলিতে কি ঐ সময়কার শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের মত। ইহা খাদ্য দিবস।
আশি দশকে শিক্ষকেরা রাজনীতি দৃষ্ট হওয়ার পরেই শিক্ষার বারোটা বাজিয়া যায়। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেনাপাওনার সম্পর্ক মাথাচাড়া দিয়া উঠিতে শুরু করিল। বিশেষ করে পঁচাত্তর পরবর্তী আমলেই সবচেয়ে বড় দুর্নীতি ছিল উৎকোচের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দান। কতিপয় সুবিধাবাদী স্বল্প মেধার মানুষ উৎকোচ প্রদান করিয়া শিক্ষকতার পেশায় আসিন হইল। পরবর্তী তাহারাই তাহাদের উৎকোচ বাবদ দেওয়া অর্থ উশুল করিবার জন্য গৃহ শিক্ষকতার ঝাঁপিয়ে পড়িয়া সরস্বতীর জগত উদ্ধার করিতে ব্যস্ত হইল। নিজের চোক্ষে দেখিয়াছি যে শিক্ষকেরা স্কুলে না গিয়ে সারাদিনে ব‍্যাচ ছাত্র পড়াচ্ছেন। তাহাদের স্কুল ফাঁকি, ছাত্র পড়ানো সংক্রামক রোগের মত ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষা রাখা, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল তুলে দেওয়া প্রভৃতি মূঢ়োচিত সিদ্ধান্তও ছাত্র টেবিল ব‍্যবসাকে ফাঁপিয়ে তোলে। এমনকি অভিভাবকেরাও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্কুল কলেজ থেকে প্রাপ্ত নম্বর বেশী পাওয়ার আশায় অসাধু চক্রদের মদদ দিতে থাকে। ঠিক তখন থেকেই সার্বজনীন শিক্ষক দিবস নিতান্ত ব‍্যক্তিগত শিক্ষক দিবসে পরিগণিত হয়। এখনকার শিক্ষক দিবসে স্কুল শিক্ষকদের বাড়িতে সেকি রাজকীয় আয়োজন! দলে দলে ছাত্রছাত্রী আসছে মূল্যবান উপহার ও মিষ্টির প‍্যাকেট নিয়ে, এইসব দৃশ‍্য এখন পাড়ার অলিগলিতে জলছবির মত দৃশ্যমান। দুই-একজন শিক্ষকের স্ত্রীর কাছ হইতে গল্প শুনিয়াছি, ছাত্র ছাত্রীদের আনা মিষ্টি নাকি তাহারা সাত-আটদিন ফ্রিজে রেখে খেয়েও শেষ করিতে পারিতেন না, কিছু ডাস্টবিনে ফেলিয়া আসিতে হইতো। সেইসব শিক্ষকদের চিরদিন ঘৃণা করিয়া আসিয়াছি, এখনো আমার ঘৃণাটুকু অম্লান। তবে ব্যতিক্রম তো আছে। নাইলে পৃথিবীর চাকা ঘুরিবে কেমন করিয়া! অর্থোপার্জনের বড় সুযোগকে অবহেলা করেও কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা যথোচিত কর্তব্য পালন করিয়া গেছেন, এবং গেছেন বলিয়া এখনও সূর্য এখনো লক্ষ অমানুষের ভীড়ে প্রকৃত মানুষকে আলোকিত করে। ইত অধঃপতন দিবস বলিয়াবগন্য হোক ধরাতলে।
সে যায় হোক, আবারও আসল কথায় ফিরিয়া আসি– সেই জন্মদিবসে। এমনি এক শরতে দ্বিতীয় ঘন্টায় আমরা ব্যস্ত বীজগণিতের সূত্র নিরুপণে তখনি আমাদের দপ্তরি লাতুদা আসিয়া কহিল– পরির্দশক আসিয়াছেন, অতএব সাবধান। তৃতীয় ঘন্টায় সকলে কমনরুমে আসিয়া উপস্থিত হইবেন। অতএব আমরা সকলেই ভীরু পদে ইষ্ট নাম জপিতে জপিতে কমনরুমে আসিয়া স্থির হইলাম। হেডমাষ্টার মশাই কহিলেন– বাপুরা আসিয়াছো? এবে স্থির হইয়া বস।
আমরা বসিলাম স্থির হইয়া। ইত্যবসরে পণ্ডিত মহাশয় একগুচ্ছ ডাল ভাঙ্গা পলাশ পুস্প লইয়া আসিলো কমনরুমে। পরির্দশকের কাছে গিয়া উৎফুল্ল হইয়া কহিল– ‘জন্ম হউক জন্মান্তরে, আবার ফিরে আসুন দূর্লভ মনুষ্য চরিত্রে।’
উপস্থিত শিক্ষক মহোদয়রা হাততালি দিয়া উঠিলো, না বুঝিয়া আমরাও বসিয়া থাকিলাম না… আমাদের জোড়া হাতের কম্পনে ইস্কুল কাঁপিয়া উঠিলো। স্বাগতঃ বক্তব্যে পরিদর্শক নানান কথা বলিতে বলিতে তাহার জন্ম-মর্ম ইত্যাদি বিশদ জানাইতে কাপর্ণ্য করিলো না। ইহা ছিল তোষামদি দিবস।
এইখানে একটি কথা বলা আবশ্যক। যদিও ছাত্র হিসেবে আমার অখ্যাতি চিরকালীন তবে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে খ্যাতি আর সব ছাত্রদের চেয়ে উত্তম। গুরুকূল আমার বিবিধ আচরণে আক্রোশ হইলও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পঞ্চমুখ হইয়া থাকিতো। বর্ষ আন্তে নাটকে, আবৃত্তিতে, এমনকি ভুলবাল নৃত্যশৈলিতেও আমার আমিকে জাহির করিতে সদাপ্রস্তুত। এইকথা কি কেউ ভুলিয়াছে, যেইবার জুন ফুটবল খেলায় আমাদের ইস্কুল বাছাই পর্বে খেলিয়া ছিলো! ইতিহাসবিদরা জাগুক ; দেখুক তাহা কাহার অবদান! কে সেদিন মারিয়া ধরিয়া ডিফেন্সকে দৈত্যের শক্তি রক্ষা করিল! ইহা হইল দৈত্য দিবস।
যা হোক জন্মদিবস কোথা হইতে আমদানী হইয়াছিলো, তাহা আজ বলিবার দরকার আছে বলিয়া মনে হয় না। কেনোনা পলাশশিমুলের দেশে কখন যে গোলাপচেরি আসিয়া দখল নিলো… হয়তোবা তেমনি জন্মদিবস। জন্মদিবস যে আমাদের কৃষ্টি নহে সেই ব্যাপার একমত হইতে আজ আমাদের আপত্তি কোথায়? কিন্তু আমরা যে বড্ড নিজস্বতা হারাইয়া ফেলেছি, সেই কথা আজ কে- কাহাকে বলিবে? যেমনটি আমরা ঢুলির বাদ্য না শুনিয়া ড্রামের নিনাদ শুনি। লালন কিম্বা ভাটিয়ালি না শুনিয়া আমরা সকলেই রক শুনি। কী আশ্চার্য আমাদের মতিভ্রম। এইসব কথা আজ থাক। এই ব্যাপারে একদা বিশদ ভাবে আলোচনা হইতে পারে। মাটি খনন করিয়া হাজার পুস্কুনী সৃষ্টি করা যাইতে পারে। এমন কী নদীর গর্ভে পলির আস্তরণ কিম্বা ড্রেজার মেশিন বারবার বিকলঙ্গ হইবার কারণ খুঁজিয়া গোটা কয়েক মুক্তগদ্য লিখিবার কারণ অনায়াসে উদ্ধার হইবে কিন্তু কস্মিনকালেও জন্মদিবসের বিকল্প কিছু থাকিতে পারে না। অতএব যা বলছিলাম, আমাদের অগ্রজেরা পঙ্গপালের মতোন সন্তান উৎপাদন ক্ষমতায় বলীয়ান হইয়া একে অপরের পৌরুষত্ব দেখাইতো।
পৌরুষত্বদিবসের মহিমায় আপ্লুত আমার অগ্রজবৃন্দ
এই কথা কী অস্বীকার করিবার জো আছে? আমাদের পূর্বপুরুষরা তাহার জন্মদিবস মানেই বুঝিতো জন্মদান। যেমন আমার পিতার ছয় সন্তানের কখনো কাহারও জন্মদিন পালন হইয়াছিল বলিয়া কোনো ইতিহাস আমার স্মরণে নাই। তথাপি এও সত্য যে প্রতি বৎসরান্তে পরীক্ষা সমাপ্তকালীন যে ছুটি উপোভগ্য তাহা আমাদের ভ্রাতৃ-ভগ্নিকূলের জন্য তাহা প্রাপ্য কস্মিনকালেও ছিলো না। আমাদের ভাগ্যে জুটিতো রবীন্দ্রনাথ শরত ইত্যাদী। শৈশবে বঙ্কিমবাবু পড়িয়া যে মস্তিষ্ক বিগড়াইয়া গিয়াছিলো, সেই অবাধ্য মস্তিষ্ক আজও আসল জয়াগায় আসিয়া স্থির হয় নাই। সে কথা আজ না বলিলে হয়। ইহা হইল মাসব্যাপি পুস্তক দিবস।
এইখানে একটি না কথা বলিলে নয়। আমার জন্মদিন তিনবার আসিয়া স্থির হইল। যেমন ইস্কুল সাটিফিকেট পরীক্ষা মাষ্টার মশাই ১৫ই এপ্রিল। ভোটার নিবন্ধনে আমি নিবন্ধন করিলাম ২০শে এপ্রিল তথাপি আমার প্রথম বই প্রকাশ কালীন আমার জন্ম তারিখ ভুল করিয়া তাহা ১০ই এপ্রিল বানাইয়া ফেলিল অতএব যাহা হইবার তাহা হইল আমি তথৈবচ হইয়া বসিয়া পড়িলাম তমাল বৃক্ষের নীচে। ইত বেতাল দিবস।
তবুও এই কথা বলিবার জো নাই যে, কেউ কেউ মায়ের আঁচলের তলে বসিয়ে সেই জন্মদিন পালন করিয়াছে আমাদের সময়। আমাদের সময় জন্মদিন মানে ঠাকুরে সামনে বসিয়া এক বাটি মিষ্টিন্ন মায়ের হস্তে ভক্ষন।
আজকাল অনেকেই দেখি-তাহার জন্মদিন পালনে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠে-দামী কেক, পুস্পনদীর সমহার অথচ… সেই কথা পরে হইবে।
গত সাপ্তাহে আমার অনাত্মীয়ের জন্মদিনে উপস্থিত হইবার সুযোগ হইয়াছিল। রেডিসন ব্লুতে। হঠাৎ করিয়া এতো মালকড়ি কিভাবে উপার্জিত হইলো তাহার মর্ম ভাবিতে ভাবিতে আমার হস্তে রেড ওয়াইন ধরাইয়া দিয়া কর্তা কহিলে– ‘স্বাগতম।’
আমি আচম্বিত হইয়া কহিলাম– ‘সু স্বাগতম।’
আমার স্বহস্তে একখানা বই উপহার দিবার ছলে বারবার বইখানা নাড়িতে লাগিলাম। যেমন করিয়া দন্ত দেখাইয়া বেগুন ব্যাপারী কহিত পাঁচ টাকা… এইবার সেই বেগুন ব্যাপারীর গল্পখানা কষিয়া কহিবো।
আমাদের গাঁয়ের হাটে একজন বেগুন ব্যাপারী ছিলো। শ্যামবর্ণী সুঠামদেহী। বয়স অল্প। ফোঁলাকা দন্তের সেই বেগুন ব্যাপরী নাম ছিল কার্ত্তিক। যথাসময়ে সে যুবক হইল, তাহার পিতামাতা পুত্রকে বিবাহ করাইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিলো কিন্তু বিধি বাম হইয়া পড়িলো-সেই ফোঁকলা দন্তের কারণে… অতঃপর ঘটক কহিল– ‘বাপু দন্তখানা বাঁধাইয়া ফেলিলে সকল বিপত্তি কাটিয়া যাইবে।’
অতএব যেই মর্ম সেই কর্ম… ফোকলা দন্তধারী কার্ত্তিকের বিবাহ আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরা ইহাকে বিবাহ দিবস বলিয়া উচ্ছ্বাসে নিমগ্ন হইলাম।