কামিলো হোসে সেলা – সাহিত্যপথের নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী

কামিলো হোসে সেলা – সাহিত্যপথের নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী
“Ideas? My head is full of them, one after the other, but they serve no purpose there. They must be put down on paper, one after the other. – Camilo Jose Cela
সুইডিশ একাডেমির যে সদস্যরা প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের নির্বাচন করেন, তাঁদের মধ্যে সব সময় মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাঁদের মধ্যে যেমন বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকে, তেমনই গোষ্ঠী-প্রভাবও কিয়ৎ-পরিমাণে কাজ করে। স্পেনীয় লেখক কামিলো হোসে সেলার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেই সময় নোবেল কমিটির দুই প্রভাবশালী সদস্য গ্রাহাম গ্রীন এবং আটুর লুণ্ডকভিস্টের মধ্যে মতপার্থক্যের কথা সকলেরই জানা ছিল। শেষোক্ত জন ও তাঁর গোষ্ঠী মনে করেছিলেন যুদ্ধ-পরবর্তী স্পেনের সাহিত্যের নবজাগরণে কামিলো হোসে সেলাই হলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাই নাদিন গর্দিমার, গুণ্টার গ্রাস ও মিলান কুন্দেরাকে টপকে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত সেলা-ই ১৯৮৯ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।
কোনও বিশেষ পুরস্কারের জন্য কোনও ব্যক্তির নির্বাচনই সকলকে খুশী করতে পারে না। সেলার বিরুদ্ধবাদীরাও তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তিতে মোটেই সন্তুষ্ট হননি। প্রতিটি পাঠক নিজের বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে সিদ্ধান্তে আসবেন তাঁর সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার-প্রাপ্তি সঙ্গত হয়েছে কি না। অবশ্য নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসাবে ঘোষিত হবার পর সেলার তাতে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। তিয়াত্তর বছর বয়সী লেখক তখন মাদ্রিদ থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে গুয়ালদুরায় তেত্রিশ বছরের সুন্দরী মারিয়া কাস্তানোকে নিয়ে নিরুত্তাপ জীবন যাপন করছিলেন। বিতর্কিত, দাম্ভিক, বর্ণময় চরিত্র সেলা একদা উদ্ধত ভঙ্গীতে বলেছিলেন – “১৮৯৮-এর প্রজন্মের পর আমিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক।” সেই মানুষটিই আবার নোবেল পুরস্কারের জবাবী ভাষণে বলেছিলেন – “আমাকে যে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাতে আমি নিশ্চয়ই খুব খুশী, যদিও আমার চেয়ে যোগ্যতর অনেক লেখক এখন স্প্যানিশ ভাষায় সাহিত্য রচনা করছেন। আসলে এ পুরস্কার সমগ্র স্প্যানিশ সাহিত্যের জন্য, অন্তত গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী অর্ধশতাব্দীর সাহিত্যকর্মের জন্য তো বটেই।” সেলা তখন অনেক কম উদ্ধত, অনেক সংযত, অনেক মেপে কথা বলেন। বয়সই কি তাঁর চরিত্রের এমন পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, নাকি চলমান জীবনের অভিজ্ঞতা – তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
১৯১৬ সালের ১১ মে স্পেনের গ্যালিশিয়া অঞ্চলের একটি ছোটখাট শহর ইরিয়া ফ্লাভিয়া-তে কামিলো হোসে সেলার জন্ম। তাঁর বাবা স্পেনীয়, মা ইংরেজ। তাঁর শৈশবের বেশ কয়েকটা বছর কেটেছিল ইংল্যাণ্ডে। স্বাভাবিকভাবেই সে দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি তাঁর উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। শৈশবের শেষ দিকে তিনি স্পেনে ফিরে আসেন। কিছুদিন আন্দালুসিয়া ও বার্সিলোনায় কাটাবার পর তিনি মাদ্রিদে থাকতে শুরু করেন। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আইন, দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন। কিন্তু গতানুগতিক শিক্ষায় তিনি বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারেননি। বোধহয় পৃথিবী তাঁর কাছ থেকে ভবিষ্যতে অন্য কিছু প্রত্যাশা করেছিল।
সেলার জীবনের পরবর্তী অধ্যায় স্পেনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ, তবে ফ্রাঙ্কোর বিপ্লবী সৈন্যদলের সদস্য হয়ে। [চার বছর ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালে যখন শেষ হয়, ঠিক সেই বছরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়]। স্পেনের গৃহযুদ্ধ শেষ হলে সেলা আবার মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন শুরু করেন। এবার তাঁর পড়ার বিষয় ছিল আইন। এই সময় থেকেই তিনি সাহিত্যের দিকে ঝুঁকেছিলেন। গিয়েরমো দিয়াজ প্লাজা বলেছিলেন – “১৯৩৬-৩৯ সালের স্পেনের গৃহযুদ্ধ এখনও স্পেনীয়দের জীবনের মূল ও অপরিহার্য সত্য। যারা এতে অংশ নিয়েছিল তারা এখনও তার বর্ণনায় সরব। স্পেনীয় জীবনযাত্রার প্রতিটি অঙ্গ এই যুদ্ধের দ্বারাই প্রভাবিত।” এই কথাগুলো আধুনিক স্পেনীয় জীবনযাত্রা ও সাহিত্যের পরিমাপ করতে আমাদের সাহায্য করে। গৃহযুদ্ধে যিনি অংশ নিয়েছেন, যাঁর চিত্ত বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাধারায় পূর্ণ, তাঁর মনের গতিপ্রকৃতি যে তাঁকে কলম ধরতে উৎসাহিত করবে তাতে আর আশ্চর্য কি? এটাও একইভাবে সত্য যে দেশ ও সমাজজীবন তাঁর লেখায় বার-বার আসবে।
উচ্চকোটির লেখকদের একটা বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব আছে। সমাজ সংগঠন ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে সেই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে লেখক ও শিল্পীদের ভূমিকা ঠিক কী বা কতখানি তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। যেমন রুশো ও ভলতেয়ার-এর ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে তাঁরা ফরাসি বিপ্লবকে সংঘটিত করেছিলেন, নাকি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিলেন, অথবা বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এর ব্যাখ্যা যা-ই হোক না কেন, এসবের মধ্যে থেকে যে মূল কথাটা বেরিয়ে আসে তা হল যে কোনও সামাজিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় লেখক শ্রেণীকে নিজের দায়িত্ব পালন করতেই হয়। এমন নয় যে সকলের কলমই সে কাজে সমানভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এটা মানতেই হবে যে এক অর্থে প্রতিটি অংশগ্রহণকারীর ভূমিকাই কোনও না কোনও ভাবে সাহিত্যের সুষমা লাভ করে। সেলার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সেলার প্রথম উপন্যাস ‘পাসকাল দুয়ার্তের পরিবার’ (‘The Family of Pascual Duarte’) প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। এই উপন্যাস তাঁকে প্রায় রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা আর বিপ্লবী ভূমিকার মধ্যে যে কিছুটা স্ববিরোধ কাজ করে তার উদাহরণ একনায়ক জেনারেল ফ্রাঙ্কো এবং সেলা নিজেও। যে ফ্রাঙ্কোর দেখানো পথে তিনি গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, সেই ফ্রাঙ্কোর সরকারই উপন্যাসটি প্রকাশের পর তাতে ছাঁট-কাট করার হুকুম দেয় এবং পরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর পর থেকে সেলা লেখকজীবনে সরকার বা কোনও ব্যক্তিবিশেষের কর্তৃত্ব ও উপদেশ মানতে রাজি ছিলেন না। তিনি স্বৈরাচারী সরকারের কর্মধারার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ব্যক্তিজীবনে ফ্রাঙ্কো জমানার অনুশাসনকে মানতে রাজী ছিলেন না বলে প্রতিবাদের ধরন হিসেবে তিনি ‘ínner exile’ বা অন্তরের নির্বাসনকে বেছে নেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে ফ্রাঙ্কোর সরকার তাঁকে না পারছিল গিলতে না পারছিল উগরোতে। তাঁর নারীপ্রীতিও তৎকালীন রক্ষণশীল সরকারের পছন্দ হয়নি। সেলার লেখকজীবন ও ব্যক্তিজীবনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা সত্বেও সরকার তাঁকে স্প্যানিশ রয়্যাল একাডেমির সভ্য মনোনয়ন করেছিল। হয়তো অস্বস্তির হাত থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্যই তিনি রয়্যাল একাডেমির সভায় খুব একটা যোগ দিতেন না। অবশ্য ফ্রাঙ্কোর মৃত্যু ও তার পরে স্পেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি ঘটে। এই সময় তিনি সংসদের সেনেটর নিযুক্ত হন এবং সংবিধান রচনার কাজেও অংশগ্রহণ করেন।
কী এমন ছিল ‘পাসকাল দুয়ার্তের পরিবার’ উপন্যাসে? গিয়েরমো দিয়াজ প্লাজা বলেন – “এই একটি উপন্যাসই মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল, স্পেনে সাহিত্যের নবজাগরণকে সূচিত করেছিল।” এই উপন্যাসটি আসলে একজন খুনীর আত্মকথন। কিন্তু কেনই বা একজন খুনীর স্বীকারোক্তি জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মতো স্বৈরাচারী একনায়ককে বিচলিত করেছিল? আসলে ফ্রাঙ্কো চেয়েছিলেন সেলা তাঁর জমানার জয়গান করুন। কিন্তু লেখকের কলম যে অন্য কথা বলত। তাঁর লেখায় স্বৈরাচারী জমানার দুর্বিষহ পরিস্থিতির কথা ফুটে উঠেছিল। সেলার নিজের কথায় – “আমি মনে করি পাঠকেরা চেয়েছিলেন আমি কোদালকে কোদালই বলি। আমি তাই করেছি।” তাঁর লেখা পড়ে পাঠকের এতদিনের শৈথিল্য ঘুচে গিয়ে চিত্তে উত্তেজনার সঞ্চার হল। ফ্রাঙ্কোর জমানার স্পেনের সামাজিক পরিস্থিতির উপর জনসাধারণের নজর পড়ল। এই উপন্যাসের ইংরেজি ভাষায় অনুবাদক আধুনিক স্পেনীয় সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচক অ্যাণ্টনি কেরিগ্যান লিখেছেন – “All this is stark reality as devoid of humanity as a rock . . . the strength of the work is in the bare-boned action of an annihilated will.”
সেলার উপন্যাসের নায়ক পাসকাল দুয়ার্তে একজন খুনী। তার পিতা মদ্যপ ও মাতা উদাসীন, স্ত্রী বিশ্বাসঘাতিনী। এই নিষ্ঠুর পরিবেশের চাপ তাকে একটির পর একটি ঘৃণ্য অপরাধের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। নায়ক অবলীলাক্রমে হত্যা করে চলে তার পোষা কুকুর, ঘোড়া, স্ত্রী, স্ত্রীর প্রেমিক এবং নিজের মাকে। সে শুধু শবের গন্ধ সোঁকে ও পেঁচার ডাক শোনে। প্রথম পুরুষে লেখা এই উপন্যাসের নায়ক মনে করেছে এ পৃথিবীতে অবসাদ ও হতাশা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তার সামনে আর কোনও উপায় ছিল না। অ্যাণ্টনি কেরিগ্যানের কথায় – “ . . . and there is an epical violence, telluric and terrible.” উপন্যাসটি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল।
১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয় সেলার সাড়া-জাগানো লেখা ‘Journey to the Alcarria’। ১৯৪৬-এর মে-জুলাই মাসে তিনি আলকারিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তিনি বেড়াতেন পায়ে হেঁটে, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ট্রেনে বা বাসে চাপতেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে স্পেনের প্রাদেশিক শ্রেণীবিভাগে আলকারিয়া বলে কোনও প্রদেশের নাম নেই, আছে গুয়াদালাহারা প্রদেশের নাম। তবে লেখকের বর্ণনা ও মানচিত্র অনুযায়ী এই অঞ্চলই আলকারিয়া। এরকম বিচিত্র ভ্রমণকাহিনি অবশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না, যাতে কোনও চিরাচরিত নায়ক থাকে না বা কোনও গল্প দানা বাঁধে না। এই ভ্রমণকাহিনিতে লেখক পথে অপরিচিত কোনও যাত্রাসঙ্গীর সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতে খেতে বলতে পারেন – “হয়তো তুমি জান না, কিন্তু সেই গ্রামে রাস্তার ধারে বসে, মানুষ শহরের চেয়ে সব কিছু অনেক পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। সে বোঝে ঈশ্বর সব কিছু যথেষ্ট স্বাভাবিক বুদ্ধি ব্যয় করে গুছিয়ে রেখেছেন।” এই ভ্রমণার্থীর নীতি ছিল তিনি কোনও একটা জায়গায় দু’রাত থাকবেন না। তিনি হেঁটে বেড়াতেই অভ্যস্ত, কঘন্টা হাঁটা হল তা দিয়ে ম্যাপের দুটি স্থানের দূরত্ব বার করতে অভ্যস্ত। যে ভ্রমণ খুব আরামে করা যায় বা খুব তাড়াতাড়ি করা যায় তা আদৌ ভ্রমণ কি না সে ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ আছে। এই অভিনব ভ্রণকাহিনিতে লেখক স্বচ্ছন্দে দার্শনিকের মতো মন্তব্য করেন – “Inwardly – nobody knows why – the passangers on one train always envy slightly the passengers on another train; it is something that’s true but a little difficult to explain. Maybe it’s because, even though they don’t realize it very clearly, a third-class passenger would always be glad to change places with another, even if the other was third-class too.”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লেখকের অভিজ্ঞতা বদলায়, জীবন-দর্শনও বদলায়। কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রবাহিত মূল অনুভূতি বোধহয় বদলায় না। সেলার ক্ষেত্রে দেখা যায় তাঁর জীবন-দর্শনের মূল সুরটি হল নৈরাশ্য, গ্লানি ও অবিশ্বাস। এই ধারণা থেকেই তিনি একদা বলেছিলেন – “এই জীবন এবং মানুষ আদৌ কল্যাণকর কিছু নয়। মাঝে-মধ্যে মনে হয়, মানুষ বুঝি বুদ্ধিমান ও দয়াবান। আসলে এই ধারণা ভুল। তার বুদ্ধিমত্তা ও দয়ালুভাব আসলে একটা মুখোশ মাত্র। জীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন অশুভ কয়েকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়া মানুষ আর কিছু নয়।”
সময় যত এগিয়েছে সেলার মনের মধ্যে ক্রিয়াশীল নৈরাশ্য ও ক্রোধ আরও বেড়েছে। এই সীমাহীন বিয়োগান্ত প্রাত্যহিকতার চরম নিদর্শন ১৯৫১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘মৌচাক’ (‘The Hive’)। এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু হল ১৯৪৩-এর ডিসেম্বরে মাদ্রিদে ডনা রসা নামে এক মহিলার দ্বারা পরিচালিত একটি কাফে। এই উপন্যাসের আঙিনায় কম-বেশি ৩৪৬টি চরিত্রের আনাগোনা। নায়ক মার্টিন মার্কো এক ভ্রাম্যমাণ চরিত্র, এই কাফেতে অসংখ্য চরিত্র তার সংস্পর্শে এসেছে। একটি খুনের ব্যাপারে মার্কো হল সন্দেহভাজন ব্যক্তি, পুলিশ তাকে খুঁজছে। তবে মার্কো নায়ক হলেও উপন্যাসের আসল সুরটি নিহিত আছে চরিত্রগুলির বিশ্লেষণে। সেলা যে মাদ্রিদের কথা বলেছেন তা আশা, উদ্দীপনা ও নিয়ন্ত্রিত সুখের অনুভূতিতে ভরপুর নয়। তিনি মনে করেন এই শহর আসলে একটা মৌচাক, যেখানে অসংখ্য মানুষ মৌমাছির মতো ঘুরে-বেড়াচ্ছে। তারা বহুবিধ কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু কোনও কিছুই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। মাদ্রিদের মধু এখন বিষময়, যা পান করে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই মানসিকভাবে বন্ধ্যা।
‘মৌচাক’ উপন্যাসটি সম্বন্ধে সেলার নিজের ধারণা হল – “যারা জীবনকে সাহিত্যের মত্ত মুখোশ দিয়ে ঢাকতে চায় তারা মিথ্যাবাদী। যে পাপ আত্মাকে বিক্ষত করে, যে অন্যায় শত নামে শত রূপে প্রকাশিত, তাকে শুধুমাত্র রক্ষণশীলতার পলেস্তারা কিংবা কবিতার আবরণ দিয়ে ঢাকা যায় না। তাই আমার উপন্যাস সে রকম কিছু নয়। আমি শুধু জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে জীবনের টুকরোগুলোকেই মেলে ধরছি . . . কিছু বাদ দিয়ে নয়, জীবন যেভাবে বয়ে চলে সেভাবেই লিখেছি।” সেলার এই উপন্যাসটি আসলে মানবিক দলিল। অবশ্য তাঁর রচনায় চিরস্থায়ী হতাশার মধ্যেও দু-একটা শীতল হাওয়ার ঝাপটা রয়েছে। কাফের দমবন্ধ করা পরিবেশেও সেই হাওয়া পাঠককে ছুঁয়ে যায়। এই হাওয়া কোথা থেকে আসছে কেউ জানে না, কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও তা প্রতিটি বন্ধ আত্মার একটি ছোট জানালা খুলে দেয়। এ এক ধরণের অদম্য গীতিময়তা। ফ্যাসিস্ট সমাজের প্রতি লেখকের অকৃত্রিম ক্রোধ ও ঘৃণা তাঁর কলমকে নিয়ন্ত্রিত করেছে।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘Mrs Coldwell Speaks to Her Son’-এও অবদমিত গীতিময়তার ছাপ স্পষ্ট। এই রচনায় সম্ভবত ডি. এইচ. লরেন্স ও ফ্রয়েডের ছাপ রয়েছে। এখানে যে প্রশ্নটি নিয়ে সেলা নাড়াচাড়া করেছেন সেটি হল – পুত্রের প্রতি মাতার সর্বগ্রাসী ভালবাসা কি সমাজ স্বীকার করবে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি আশা-নিরাশার দোলাচলে ভুগেছেন। একই সঙ্গে নিপুণ ভাষাশিল্পীর মতো সংযমের সাথে মানব-মনের একটি বিশেষ দিক তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন কঠিন বাস্তবের মধ্যে দিয়ে নয়, রোমাঞ্চকর ভালবাসার মধ্যে দিয়ে মাতা তাঁর পুত্রকে পেতে চান। অনেকের কাছে এই ভালবাসা হয়তো অদ্ভুত বা অনাচারের নামান্তর বলে মনে হতে পারে। তবে বাস্তব হোক বা অবাস্তব হোক, এই সম্ভাবনাকে বোধহয় একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাঁর পূর্ববর্তী লেখকদের উপন্যাসগুলির কোনও নারী চরিত্রের মধ্যে এরকম ভালবাসার লেশমাত্রও দেখতে পাওয়া যায় না। প্রখ্যাত সমালোচক রবার্ট কিটসনার বলেন – “সেলা শুধু ভয়াবহতার উপাসক নন। তাঁর জীবনদৃষ্টিতে গীতিময়তারও স্থান আছে এবং থেকে-থেকে জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ দিকও তাঁর লেখনীর স্পর্শে গান হয়ে বেজে ওঠে। নিকষ কালো অন্ধকারেও ভালবাসার শিখাটি হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে ওঠে।” তাই বোধহয় শ্রীমতি কল্ডওয়েল বলেন – “মরুভূমির বালির ওপর আমি তোমায় নির্বিচারে ভালবাসব। আমরা নারীরা মরুভূমির বালির ওপর তৃষ্ণার্ত এক পাগল হাওয়া হয়ে যাই – এক দারুণ ঝোড়ো হাওয়া যা পাহাড় গুঁড়িয়ে দেয় আর শহরকে সমাধিস্থ করে।”
প্রচলিত অর্থে সেলা সম্ভবত প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিহ্নিত হবেন, কিন্তু লেখক হিসাবে নন। তাঁর চিন্তার যোগ রয়েছে একদিকে স্পেনীয় সাহিত্যিক মিগুয়েল ডি সারভান্তিস ও বেলিতো পেরেজ গ্যালাদোস-এর সঙ্গে; অন্যদিকে এমিল জোলা, আলবেয়ার কামু, জাঁ পল সার্ত্র ও ফ্রানৎস কাফকা-র সঙ্গে। জীবন ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আপাত অধৈর্যের কারণ খুব একটা দুর্বোধ্য নয়। ফ্রাঙ্কোর বিপ্লব ও স্বৈরাচারী সরকার তাঁকে হতাশ করেছিল। হয়তো সেই কারণেই সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল লেখকদের তিনি এক হাত নিয়েছেন। তাঁর লেখায় স্প্যানিশ রিয়ালিজমের কিছুটা প্রভাব থাকলেও চুলচেরা তত্ত্বগত বিচারে তিনি সোস্যালিস্ট রিয়ালিজমের অনুসারী নন, আবার ক্রিটিকাল রিয়ালিজমের অনুসরণকারী গোষ্ঠীতেও পড়েন না। মননশীলতায় ও কলমে সেলা-কে মডার্নিস্ট বলা গেলেও, আসলে তাঁকে ‘Literature of the Avant Guarde’-এর অনুসরণকারী বলে ধরে নেওয়া যায়।
বিংশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে সেলার প্রতিভার যে স্ফুরণ দেখা গিয়েছিল, ষাটের দশকে তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। যদিও তাঁর কলম একেবারে থেমে যায়নি, কিন্তু অনেকের মতে এই সময় তাঁর রচনার উৎকর্ষ কমে গিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘সান কামিলো ১৯৩৬’ (‘San Camilo 1936’) প্রথমে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করলেও দ্রুত পাঠকমন থেকে মুছে যায়। সমালোচকদের মতে গৃহযুদ্ধের ঠিক আগের মাদ্রিদের পটভূমিতে স্থাপিত এই উপন্যাসটি আসলে ‘মৌচাক’-এর অনুকরণ, এর বর্ণনাভঙ্গী আরোপিত এবং যৌনমুখীনতা অপ্রয়োজনীয়। অবশ্য সুইডিশ একাডেমি সেলার প্রশস্তিতে এই উপন্যাসটিকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বলেছেন। সেলা স্বয়ং তাঁর বইটির সমালোচনা সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তাই তিনি বক্রোক্তি করেছিলেন – “আমরা লেখকরা অনেকটা শামুকের মতো, কিছুক্ষণের জন্য গলাটি বার করে আবার তড়িঘড়ি গুটিয়ে নিই। আমাদের প্রয়োজন আরো আধডজন নতুন, সজীব আইডিয়া।” আবার কারও কারও মতে ছয়ের দশকের শেষের দিক থেকে তাঁর লেখা গতানুগতিকতা বাইরে গিয়ে আরও বেশি করে পরীক্ষামূলক হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘Mazurka for Two Dead Men’ এবং ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘Christ versus Arizona’ লেখাদু’টির কথা বলা যায়।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের অভিঘাত সেলার লেখকজীবনে ও সৃজনশীলতায় অত্যন্ত গভীর। ১৮৯৮-এর প্রজন্মের সাহিত্যিক মিগুয়েল দ্য উনামুনো অন্তরীণ অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তার সঙ্গেই ওই প্রজন্মের এক গৌরবময় অধ্যায়ের অবসান হয়। ভগ্নহৃদয় আন্তোনিও মাচাদো ১৯৩৯ সালে ফ্রান্সে মারা যান। ১৯৪২-এ মারা যান কবি মিগুয়েল হেরনাণ্ডেজ। কবি গুইলেন ও পেড্রো সালিনাস, ঔপন্যাসিক রেমন সেণ্ডার, নাট্যকার মাক্স আওব, সঙ্গীত-শিল্পী পাবলো কাসালস, কবি হিমেনেথ প্রমুখরা সকলেই ফ্রাঙ্কো জমানার স্বৈরাচার এবং বিপ্লবের দুঃখজনক পরিণতি দেখে ক্ষোভে দুঃখে দেশত্যাগ করেছিলেন। যাঁরা দেশে থেকে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সেলা একজন। ঔপন্যাসিক বারোয়া ও আজোরিন, কবি আলেক্সান্দ্রে, সমালোচক দামাসো এ্যালনসো প্রভৃতিরা তখন সৃষ্টিমূলক কিছু করতে পারছিলেন না। স্পেনের শিল্প-সাহিত্যের জগতে তখন হতাশার কালো ছায়া। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এবং পুনরায় রক্তপাতের আশঙ্কা সৃষ্টিকর্মের গলা চেপে ধরে সর্বদা মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে চলেছিল। এই মরুভূমির মধ্যে এক টুকরো মরুদ্যান সৃষ্টি করেছিলেন সেলা, তাঁর ‘পাসকাল দুয়ার্তের পরিবার’ উপন্যাসের দ্বারা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেই বছরই কামুর ‘দ্য আউটসাইডার’ প্রকাশিত হয়েছিল। দুটি বইয়েরই নায়ক হতাশাগ্রস্ত এবং তাদের জীবন চরম নৈরাশ্যে ভরা।
সাহিত্যক্ষেত্রে সেলার একটি বড় অবদান হল ট্রিমেনডিসমো নামে এক নতুন গদ্যরীতির প্রবর্তন। সংক্ষেপে বলতে গেলে এ হচ্ছে ন্যাচারালিজমের উন্নততর সংস্করণ। কখনও তা তীক্ষ্ণ, জ্বালাময়ী; আবার কখনও তা রাস্তার অশ্লীল ভাষাকে জীবন্ত অবস্থায় সাহিত্যের পাতায় উঠিয়ে আনে। কখনও তার সাহায্যে হিংস্র কদর্য পারিপার্শ্বিক ও পটভূমিকে ফুটিয়ে তোলা হয়, আবার কখনও বিষণ্ণ সুররিয়াল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এই নতুন গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কার্ল কব বলেছেন – “A neobaroque and neopicaresque style, which concentrates on the violent and grotesque. It is marked by extravagant and strident diction pointed towards the ugly, by sallies of grimly ironic humour, and by the presentation of irrational and alienated characters.” কিন্তু রূঢ় বাস্তব ও নৈরাশ্য সত্বেও এই গদ্যরীতি এক অমর চিত্রকল্প সৃষ্টি করতে পেরেছে এবং লক্ষ লক্ষ পাঠকের মন কেড়েছে। অনেকেই সেলার গদ্যরীতিকে ফ্রান্সিসকো গোয়ার ছবি এবং লুই বুনুয়েলের সিনেমার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সেলার সাহিত্যিক জীবনের সূচনা ও পরিব্যপ্তি ঘটেছিল স্বৈরাচারী ফ্রাঙ্কোর জমানাতে। তার আগে বিশ্বের পাঠকেরা স্পেনের কবি-সাহিত্যিক বলতে উনামুনো, লোরকা, মাচাদো, হিমেনেথ প্রভৃতিকে চিনতেন। সম্ভবত যে সময়ে সেলা প্রকাশক্ষমতার শীর্ষে, অর্থাৎ ফ্রাঙ্কোর জমানার প্রতি বিরূপতা স্পেনের শিল্প, সাহিত্য ও অন্যান্য সৃজনশীল কাজকর্মের প্রতি পাঠকদের উদাসীন করেছিল। আর তাই গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী স্পেনের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি ততটা জানা ছিল না। এমনকী ১৯৭৭ সালে স্পেনের কবি ভিসেন্তে আলেকসান্দ্রে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সত্বেও সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি স্পেনের দিকে যায়নি। সুতরাং দুরূহ সাহিত্যপথের নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী এই সাহিত্যিকের ১৯৮৯ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি একদিকে যেমন তাঁর সৃজন ক্ষমতার স্বীকৃতি, অন্যদিকে তা আধুনিক স্পেনীয় সাহিত্যের ধারাটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটাতে সাহায্য করেছে। সেলার নিজের কথায় নোবেল পুরস্কারের জন্য – “I was a chronic candidate.”
সেলার নোবেল প্রাপ্তির খবর শুনে অনেক সমালোচক ব্যাঙ্গার্থে বলেছিলেন তাঁর কুকর্মের জন্যই তাঁকে এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য এত দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তাঁরা যে কুকর্মের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তা হল দু’টি সংকলন গ্রন্থ – ‘গোপন অভিধান’ এবং ‘কাম অভিধান’। প্রথমটি হল স্পেনে প্রচলিত বিবিধ রসালো গালিগালাজের সংকলন এবং দ্বিতীয়টি হল স্প্যানিশ ভাষায় যৌন-তথ্যের টিকা-টিপ্পনি সহ একটি অভিধান। বহু বিচিত্র আদিরসাত্মক শব্দ এবং যৌনক্রিয়া সম্পর্কিত বিচিত্র বিবরণ সম্বলিত এরকম সৃষ্টি আর কোনও নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের হাত থেকে বেরিয়েছে বলে জানা যায় না।
বিভিন্ন উপন্যাস বিভিন্ন রীতিতে লেখার স্বাচ্ছন্দ্য এবং গদ্যভাষা নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেলার বৈশিষ্ট্য। ‘পাসকাল দুয়ার্তের পরিবার’ উপন্যাসে ট্রিমেনডিসমো গদ্যরীতির সাফল্য সত্বেও দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মৌচাক’-এ তিনি আরও একটি নতুন ধরনের বাস্তবধর্মী গদ্যরীতি ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৪২ সালে তাঁর একটি উপন্যাস স্পেনের বন্ধ্যা সাহিত্যক্ষেত্রে মরুভূমির মাঝে মরুদ্যান সৃষ্টি করতে পেরেছিল, আরও এক দশক পরে সেই একই সাহিত্যিকের অন্য একটি উপন্যাস স্পেনের সাহিত্যজগতে নিউ ওয়েভের সূচনা করেছিল। গদ্যভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিভিন্ন রকম শৈলীর সার্থক সমন্বয় সেলাকে স্পেনের সাহিত্যের নিউ ওয়েভের প্রাণপুরুষ করে তুলেছিল। ‘মৌচাক’ উপন্যাসে ব্যবহৃত গদ্যরীতিতে আছে বর্ণনার বৈচিত্র্য ও লেখকের স্বভাববাদী ভঙ্গী, আছে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা ও উত্তর দেওয়া বা interior monologue, আর আছে মায়ার সার্বিক বাতাবরণ বা illusion of reality। গদ্যরীতি নিয়ে এই ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেমন ডস পাসোস, এমিল জোলা ও জেমস জয়েসের প্রভাব দেখা যায়, তেমনই সাহিত্যিক সেলার বহুমুখী কর্মময়তার ছাপও চোখে পড়ে। আবার মিসেস কল্ডওয়েল স্পীকস্ টু হার সন বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে অ্যান্টনি কেরিগ্যান বলেছেন – “স্মৃতিময়তা ও প্রতীকী কল্পনায় পরিপূর্ণ এই বইটি নিঃসন্দেহে আধুনিক স্পেনীয় সাহিত্যের কাব্যময়তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।”
উপন্যাস ছাড়াও সেলা ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কবিতা ও ভ্রমণ-বৃত্তান্ত রচনা করেছেন। তাঁর সত্তরটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং অনেকগুলি বই বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘লস পাপেলেস দ্য সন আরমাদানস্’ নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী স্পেনীয় সাহিত্যের বিকাশে এই পত্রিকাটির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ফ্রাঙ্কোর জমানার কোপদৃষ্টি থেকে পত্রিকাটি রেহাই পায়নি। তবুও রীতিমতো অপত্যস্নেহে তিনি পত্রিকাটি লালন করেছেন এবং নিজের নীতিতে অটুট আস্থা নিয়ে স্বৈরাচারি সামরিক শাসনের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করেছেন। সেলা লেখকের স্বাধীনতায় অকারণ হস্তক্ষেপের ঘোর বিরোধী এবং কোনও বিশ্বব্যাপী সাধারণীকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অপারগ। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি – “আমার চারপাশের যেসব জিনিষ বৈদ্যুতিক আলোর মতো পরিষ্কার সেগুলো ঠিক-ঠিক ভাবে দেখতে না পারার ব্যর্থতাকে আমি নিজের দোষ বলে মনে করি না।”
২০০২ সালের ১৭ জানুয়ারি মাদ্রিদে পঁচাশি বছর বয়সে সেলার মৃত্যু হয়। তিনি নিজের রচনায় বরাবরই বাস্তবকে নিয়ে আসতে চেয়েছেন। কিন্তু কল্পনা ও রোমান্টিকতার মোড়কে মুড়ে বাস্তবকে তিনি সাহিত্যের উপযোগী করতে চাননি বা চোখে আশার মায়াকাজল পরিয়ে রচনায় বাস্তবকে ধরবার আত্মঘাতী প্রচেষ্টায় নিজেকে নিযুক্ত করেননি। “আমি তোমাকে দেবদূত হিসেবে চাই না, চাই না সাদা-কালো কিংবা খয়েরি মেঘের বাসিন্দারূপে,” শ্রীমতি কল্ডওয়েলের এই আর্তি তো সেলার সাহিত্যিক জীবনের চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি। বাস্তবও অনেক সময় সংবেদনশীল হয় এবং সাহিত্যের পাতায় তার বর্ণনা পাঠকের মনে যথেষ্ট রোমাঞ্চ জাগায়। এই রোমাঞ্চই আমাদের জীবনের আপাতদৃষ্টিতে নীরস প্রাত্যহিকতাকে আড়াল করে। গতানুগতিক ছকে বাঁধা জীবন যখন সাহিত্যের অঙ্গনকে ঘিরে রাখে, তখন বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে সেলা বলেন – “There are two kinds of men : those who make history and those who endure it.”