তেরেসা বলে ডেকে ওঠা লোকটা

মূল গল্প: ইটালো কালভিনো
অনুবাদ: সাগর রহমান
ফুটপাথ থেকে একটু নিচে নেমে এলাম আমি।
পায়ে পায়ে পিছিয়ে গিয়ে প্রায় মাঝ রাস্তার উপরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার চোখ এবং মুখ বিল্ডিংটার একদম উপরের তলার দিকে। দুই হাতের চেটো গোল করে একটা কাল্পনিক মাইকের মতো করলাম। তারপর সেটাকে মুখের সামনে তুলে ধরে গলার সবটুকু জোর ঢেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, তেরেসা।
চিৎকারের তীব্রতাতেই বোধহয় আমার নিজের ছায়া ভয় পেয়ে আমার দুই পায়ের মাঝে,গুটিয়ে এলো।
কেউ একজন যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। আমি গ্রাহ্য করলাম না। আবার ডেকে উঠলাম, তেরেসা!
লোকটি থেমে গেল। আমার কাছে এসে বলল, এত আস্তে ডাকলে কী অত উঁচু থেকে শোনা যাবে? দাঁড়ান, আমিও আপনার সাথে ডেকে উঠি। এক থেকে তিন গোনা হলে দুইজনে একসাথে ডেকে উঠবো, তাহলে জোর শব্দ হবে।
বলে তিনি গুণতে শুরু করলেন, এক, দুই, তিন।
সংগে সংগে আমরা দুইজনেই ডেকে উঠলাম, তে-এ রে-এ স াা া।
আমাদের পাশ দিয়ে একদল ছেলেমেয়ে যাচ্ছিল। সম্ভবত কোন রেস্টুরেন্ট কি সিনেমা থেকে এক সংগে বেরিয়েছে। আমাদেরকে দেখে পুরো দলটি এগিয়ে এলো। একজন বলল, আমরাও আপনাদের সাথে ডাকছি।
সুতরাং মাঝরাস্তায় আমাদের পুরো একটা দল হয়ে গেলো। ওদেরই একজন ̧গুনল এবার, এক দুই তিন।
আমরা সবাই তখন অভিন্ন কোরাসে চিৎকার করে উঠলাম, তে-এ-এ রে-এ-এ সা-া া া…!
কোনদিক এসে আরেকটা লোক যোগ দিলো যেন। এবং পনের মিনিটের মাথায় আমাদের দলটার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো প্রায় বিশে। সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়তেই থাকলো।
এতগুলো লোকের এক সংগে কোন একটা শব্দ এক যোগে ডেকে ওঠা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয় অবশ্য দেখা গেলো তিন গুণে ওঠার আগেই কেউ হয়তো ডাকতে শুরু করে দিলো, কিংবা কেউ হয়তো সা-া া বলে লম্বা টান দিতেই থাকলো। তবে সবমিলিয়ে বেশ একটা জোরালো ডাকই তৈরী হচ্ছিল যা হোক। আরেকটু গু̧ছিয়ে ডাকার জন ̈ আমরা ঠিক করলাম, ‘তে’ শব্দটা একটু নিচুতে কিন্তু দীর্ঘ লয়ে, ‘রে’ শব্দটা সবচেয়ে উঁচু পর্দায় এবং দীর্ঘ লয়ে, আর শেষে ‘তে’ শব্দটা খানিকটা নিচুতে এবং হ্রস্ব লয়ে উচ্চারণ করা হবে। যদিও দুয়েকবার কেউ কেউ ভুল পর্দায় ডাকছিল, কিন্তু কয়েকবার ডাকতেই বেশ একটা সুরেলা ব্যাপার তৈরী হলো।
ডাকটা যখন প্রায় নির্ভূল হয়ে উঠছিল, তখন কেউ একজন, খুব সম্ভবত তিল আর মেচেতায় ভরা একটা মুখ, জিজ্ঞেস করলো আমাকে, আচ্ছা, ডেকে তো চলেছি, কিন্তু আপনি নিশ্চিত যে – ও বাসায় আছে?
না, আমি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম।
ওহ হ। তাহলে তো সমস্যা। ঘরের চাবি সাথে নিতে ভুলে গেছেন বুঝি?, অন ̈ একজন প্রশ্ন করে আমাকে।
আমি বললাম, চাবি? না না, সে আমার সংগেই আছে।
কয়েকজন এবার একসাথে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে এত ডাকাডাকি না করে উপরে চলে যাচ্ছেন না কেন?
আমি বিনয়ের সাথে বললাম, তা অবশ ̈ পারা যেতো। তবে আমি তো এ বাসায় থাকি না। সত্যি বলতে কী, আমি আসলে এ পাড়াতেই থাকি না।
এবারে সেই তিল আর মেচেতায় ভরা মুখের মানুষটা বলে উঠল, তাহলে কে থাকে এখানে? অবশ্য যদি বলতে আপনার কোন আপত্তি না থাকে।
আমি বললাম, না না আপত্তি কিছু নেই। তবে আমি আসলে ঠিক জানি না কারা এখানে থাকে।
ওহ, জনতার মধ্যে বেশ খানিকটা অসন্তোষের শব্দ ওঠে।
তীব্র গলায় একজন ভদধলোক আমাকে প্রশ্ন করেন এবার, তাহলে এই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনি তেরেসা বলে ডাকাডাকি করছেনই বা কেন?
আমি আরো বিনয়ের সাথে জবাব দিলাম, দেখুন ‘তেরেসা’ বলেই ডাকতে হবে- এমন কোন ব্যাপার কিন্তু নেই। আপনারা চাইলে অন ̈ যে কোন নাম ধরেও ডাকা যেতে পারে।
বুঝতে পারছিলাম, লোকজন স্পষ্টতই বিরক্ত হয়ে উঠছে।
তিল আর মেচেতা মুখের লোকটা বলে ওঠেন, আপনি আমাদের সাথে কোন ফাজলামো করার চেষ্টা করছেন না তো?
ফাজলামো করবো আপনাদের সাথে? ছি ছি- আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম। সমর্থনের আশায় আমি চারপাশের লোকগুলোর মুখে চোখ বুলালাম, কিন্তু কারো মুখেই খুব একটা অনুগ্রহ দেখতে পেলাম বলে মনে হলো না।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। একটা আচমকা থমথমে ভাব নেমে এলো জায়গাটায় হঠাৎ।
তারপর একজন সহৃদয় সম্পন্ন একজন মানুষ বলে উঠল, আচ্ছা একটা কাজ করা যাক। এতক্ষণ ডাকলামই যখন, আরেকবার ‘তেরেসা’ নামটা ধরে ডেকে আমরা বরং বিদায় হই।
তখন আবারো ‘এক দুই তিন’ ডেকে ওঠে আমরা সুর করে ‘তে-এ রে-এ সা-া-া ’ বলে ডেকে উঠলাম। তবে ডাকটা তেমন জোরালো হলো না, সুরটা যেন কোথায় কোথায় কেটে গেলো!
এরপরই লোকজন যে যার পথ ধরতে লাগলো, কেউ এদিকে তো কেউ ওদিকে।
আমি নিজেও জায়গাটা পেরিয়ে এলাম। গলির মোড় পর্যন্ত গেছি, হঠাৎ মনে হলো শুনতে পেলাম, কেউ একজন ডাকছে, তে-এ রে-এ সা- া- া- া …..!
বেশ। আমি ভাবলাম, ডাকার জন্য কেউ একজন থাকার দরকার। কেউ একজন যে জেদী,আর একগুঁয়ে।