গল্পঃ স্পেশাল মা

গল্পঃ স্পেশাল মা

স্পেশাল মা
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

‘পাপ, পাপ । পাপের ফলেই এমন দিন দেখতে হল । নাহলে আমার সংসারে এমন ঘটনা ঘটার কোন কারণ তো ছিল না । এত বড় শাস্তি কপালে জোটার পরেও তো দেমাক কমেনি এতটুকু । কী করে যে এখনো এত দর্প করে বুঝি না বাপু । আর আমার ছেলেটাকেও বলিহারি! জেনেই তো গেছিস ভাল কিছু আর হবে না । তাও এই জলের মত অর্থ খরচ করার কী দরকার বাপু বুঝি না ।’
চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সব কথা কানে আসে সৌমিলির । ঘুম ভেঙে গেলেও উঠতে গড়িমসি করছিল । কাল অনেক রাত পর্যন্ত তুপাই ঘুমোয়নি । ছটফট করেছে । বারেবারে জানতে চেয়েছে সৌমিলি, ‘কষ্ট হচ্ছে মা ? কী কষ্ট ? জল খাবি ? ব্যালকনিতে নিয়ে যাব ?’ তুপাই ব্যালকনিতে যেতে, সেখানে সময় কাটাতে ভালেবাসে । অবশ্য এটা সৌমিলির মনে হয় । এমন আরও অনেক কিছু মনে হয় সৌমিলির । তুপাই কোনদিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি । বলতে পারেও না । বলতে চায় কিনা তাও সৌমিলি জানে না । তবু সৌমিলি অবিরত চেষ্টা করে চলে নিজের মনের সঙ্গে তুপাইয়ের মনটাকে মিলিয়ে এক করে ফেলতে । পারে না হয়তো । কিন্তু সে কখনই হাল ছাড়ে না ।
তুপাই তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে । গত দুদিন ধরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে । তুপাইয়ের গায়ে কম্বলটা ভাল করে ঢেকে দেয় সৌমিলি । আজ ওকে এখন তুলবে না । কবিতা মাসিকেও বলে দেবে আজ তুপাই একটু পরে উঠবে । কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছিল । বেশ কষ্ট হচ্ছিল মেয়ের । হঠাৎ করে কী যে হল মেয়েটার, বেশ তো ছিল, ভাবে সৌমিলি । এটা ঠিক আর পাঁচটা সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চার মত তুপাই নয়, কিন্তু তুপাইয়ের মতো তো তুপাই ছিল ।
ঘরের ভিতরের দরজা খুলে সৌমিলি ব্যালকনিতে দাঁড়ায় । শীতের কনকনে হাওয়া তাকে ঝাপটা দিয়ে যায় । শাড়ির আঁচলটা গায়ে টেনে নেয় সে । নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে রামদীন যথারীতি বাগানের কাজ করে যাচ্ছে । প্রথম যেদিন এই বাড়িতে পা রেখেছিল সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ওই বয়স্ক মানুষটার কাজের প্রতি কোন আলসেমি দেখেনি সৌমিলি ।
তার এই বাড়ির বউ হয়ে আসাটা বেশ নাটকীয় । বেশ মজারও । বিয়েবাড়ি বা কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে অনেক সময় অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ের একে অপরকে পছন্দ হয়ে যায় । হয় তারা নিজেরা বা বাড়ির লোকজন সম্পর্কটা নিয়ে এগোয় । সৌমিলির ক্ষেত্রে একেবারে স্পেশাল । তার মামাতো দিদির বিয়েতে তাকে পছন্দ করে ফেলল তারই বর্তমান শাশুড়িমা । শুধু পছন্দ করাই নয়, দিদির বিয়ে মেটার পরেই তাদের বাড়ি যাতায়াত, কথাবার্তা একেবারে পাকা করে ফেললেন ।
নতুন বউ হয়ে এই বাড়িটায় পা দিয়ে সৌমিলির মনে হয়েছিল এই বাড়িটাই নাকি আজ থেকে তার বাড়ি । এটা কী করে সম্ভব ? প্রশ্নচিহ্ন ধীরে ধীরে কবে মুছে গিয়েছিল টের পায়নি । বরং নতুন বাড়িটাকেই বেশি আপন করে নিয়েছিল সৌমিলি । সপ্তকের মার্কেটিঙের চাকরি । তাই বেশিরভাগ বাইরে কাজ । মাসে মেরেকেটে দশটা দিনও থাকে না । তবে শাশুড়িমা সবসময় চেষ্টা করেছে তার অবসর ভরিয়ে রাখতে । শপিং, মুভি বা ছোট করে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়াআসা । মোটের ওপর বিয়ের পর বছর চারেক সপ্তক তাকে ঠিকঠাকভাবে সময় দিতে না পারলেও সৌমিলির সময় ভালভাবেই কেটে গিয়েছিল । আক্ষেপ ছিল না সৌমিলির । সপ্তক কতদিন মজা করেছে তার সঙ্গে ।
‘কী গো, মা’টা আমার না তোমার মাঝেমাঝে বুঝতে পারি না ।’
ছদ্মরাগ দেখিয়েছে সৌমিলি । বলেছে, ‘কেন, টিপিক্যাল শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া দেখতে পাচ্ছ না বলে খুব কষ্ট হচ্ছে নাকি ?’
সপ্তক হা হা হা করে হেসে উঠেছে ।
অথচ আজ, সেই শাশুড়িমায়ের বলা অতগুলো মন্দ কথা শুনল সৌমিলি । অবশ্য এটা আজ আর নতুন কিছু নয় । শুরু হয়েছে প্রায় সাত-আট মাস হবে । প্রথমদিকে কষ্ট হত, কান্না পেত, রাগও হত । সপ্তকের কাছে এই নিয়ে বহুবার অভিযোগ করেছে, কেঁদেকেটে একসা হয়েছে । তারপর আস্তে আস্তে বুঝে গেছে বাস্তবের কঠোর রূপ । আসলে এটা তার লড়াই, একেবারে তার একার লড়াই ।
যদিও প্রথম দিন থেকে মানে সৌমিলির মার্তৃত্বের প্রথম দিন থেকে সব ঠিকঠাক ছিল । ডাক্তার কোনকিছু অসুবিধা বা সমস্যা আছে বলে বলেননি । তাই কোনরকম আশঙ্কা বা খারাপ কিছুর দুশ্চিন্তা সৌমিলিদের কারোর মনে ছিল না ।
থাকার কথাও ছিল না । ফুটফুটে তুপাই জন্ম নিলো সৌমিলির কোল আলো করে । ওদের বাড়িতে যথারীতি খুশির বন্যা বয়ে গেল । সাতমাসে অন্নপ্রাশনের সময় থেকে মন খুঁতখুঁত শুরু হলো সপ্তকের মায়ের মনে । তুপাই কেন এখনো বসতে শিখল না ! ঘাড়টাও শক্ত হলো না সেভাবে । আর এত লালা গড়ায় কেন মেয়ের মুখ দিয়ে ? মুখ দিয়ে কোন শব্দও বের হয় না । এরকম কতশত প্রশ্ন । সৌমিলি পাত্তা দিতে চায় না তার শাশুড়ির কথাগুলো ।
কিন্তু কথাগুলো এক ভাবে শোনার জন্য সৌমিলির মনে একটু হলেও আতঙ্ক বাসা বাঁধতে শুরু করেছে । ঘটা করে নয়, নিয়মরক্ষার্থে অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হলো তুপাইয়ের । তারপরেই বাড়িতে সাজোসাজো রব উঠে গেল তুপাইকে ডাক্তার দেখানোর জন্য । সবার আশঙ্কা সত্যি করে এক নয়, একাধিক ডাক্তার নিদান দিলেন, তুপাইয়ের জন্য স্বাভাবিক জীবন অপেক্ষা করে নেই।
সৌমিলি হাউহাউ করে কেঁদেছিল । সৌমিলির মাথায় হাত বুলিয়ে সপ্তক বলেছিল, ‘লড়াই করতে হবে সৌমি । এ খুব কঠিন লড়াই ।’
পেরিয়ে গেছে চারটে বছর । সপ্তকের হাতটা কবে যেন সৌমিলির মাথার উপর থেকে সরে গেছে । খাঁ-খাঁ রোদে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে, ঘনঘন পড়া বাজের মাঝে সৌমিলি একেবারে একা । সব ঝঞ্ঝা থেকে তুপাইকে আড়াল করে রাখার দুরন্ত চেষ্টায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত সে ।
সপ্তক প্রথম দিকে ধৈর্য রেখেছিল । কিন্তু ক্রমশ তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে লাগল । সৌমিলি দোষ দিতে পারে না সপ্তককে । মাসে দশদিন বাড়িতে থাকা মানুষটা বাড়ির সুস্থ পরিবেশ যদি দেখতে না পায়, তাহলে সেই মানুষটারই বা ভাল লাগবে কেন ? সৌমিলি সাজগোজ সব ত্যাগ করেছিল । সংসারে কোন দিকেই তার চোখ-কান কিছু নেই । দিনরাত শুধু মেয়ে আর মেয়ে । যে কয়েকটা দিন সপ্তক বাড়ি আসত, সেই কয়েকটা দিনও সৌমিলিকে কাছে পেত না । বলেছিল সৌমিলিকে সে, ‘আমরা আর একটা ইস্যু নিতে পারি তো ? চেষ্টা করে দেখি না । আচ্ছা সৌমি, তোমার কি ইচ্ছা করে না, একটা সুস্থ বাচ্চা পেতে । সে কিভাবে বড় হয়, কিভাবে সব কিছুতে রিয়্যাক্ট করে দেখতে, তার আনন্দ নিতে ?’
সৌমিলি কথাটা শুনে এমনভাবে তাকিয়েছিল সপ্তকের দিকে আর দ্বিতীয়বার এই কথা উচ্চারণ করেনি সপ্তক ।
শাশুড়ির রোজের মন্দকথা সহ্য করে নিয়েছিল সৌমিলি । কিন্তু সপ্তকের সরে যাওয়াকে দোষ যেমন দেয়নি, ঠিক তেমনি মেনে নিতেও পারেনি । সপ্তক যখন আরও একটা বাচ্চা নেবার কথা বলেছিল, সৌমিলির অভিমান হয়েছিল খুব । তার বারবার মনে হয়েছিল, সপ্তক একবারও তুপাইয়ের কথা ভাবল না । তুপাইয়ের ভাই বা বোন এলে তুপাইকে কে দেখবে ?
এখন তুপাইয়ের নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে । মাঝেমধ্যে সারা শরীরে খিঁচুনি আসে । সেইসময় মুখ দিয়ে লালা বেরোনোর পরিমান বেড়ে যায় । শেষে অজ্ঞান হয়ে যায় । ডাক্তার বলেছে এমনটাই স্বাভাবিক ।
কিন্তু ভাল কিছুও ঘটছে বলে সৌমিলির মনে হয় । ফোনে গান চালিয়ে দিলে তুপাই চুপ করে থাকে । একদিন মনে হয়েছে সৌমিলির যেন গানের তালে তুপাই দুলছে । পরমুহূর্তে আর কিছু দেখেনি । হয়তো ওর মনের ভুল । তবু ওই ভুলটুকু মুহূর্তখানেক হলেও তাকে আনন্দ দিয়েছে । সেদিন ওর হাতে একটা বই দেখে তুপাই হাত বাড়ানোর চেষ্টা করেছে । না, এই দেখাটায় কোন ভুল ছিল না সৌমিলির । আগের থেকে তুপাইয়ের শিরদাঁড়া একটু হলেও শক্ত হয়েছে । নিজে ভর দিয়ে কোনদিনও বসতে পারবে না তুপাই । কিন্তু বালিশের সাহায্য নিয়ে তো পারবে ।
লড়বে সৌমিলি । মনের জোর সে কখনো হারাবে না । হয়তো মনের জোর হারাবে মাঝেমধ্যে । তবে সেই জোর ফিরিয়ে আনতে তার আর কোন অসুবিধা হবে না । আজ তার ভাবনাগুলোকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে । ।
সৌমিলি চায় না আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চা যেভাবে বড় হয় তা দেখতে । আজ তুপাইরা স্পেশাল চাইল্ড । কিন্তু সে তা মানতে চায় না । বরং সে একটু অন্যরকমভাবে বেড়ে ওঠা বাচ্চার অন্যরকম মা মানে স্পেশাল মা হয়েই থাকল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.