রেখা রায়ের প্রবন্ধ

দুর্গাপুজোর সেকাল একাল
“দুর্গাপুজোর সেকাল একাল” বলতে বসেছি একালের আঙিনায় দাঁড়িয়ে। একালটাও সেকাল হবে একদিন।
এখন প্রশ্ন হলো সেকাল বলতে কোন সময়? নির্দিষ্ট করে বলা নেই। সুতরাং শুরু থেকে বলি। শুরু মানে? শুরুটা হয়েছিল কবে? সে বিষয়ে প্রামাণিক কোনও তথ্য আছে কি? চিরুণি তল্লাশি করেও হদিশ পাইনি তেমন। তার জন্য হালছাড়া হচ্ছিও না।
মোটামুটি জানা যাচ্ছে যে মোঘল আমল থেকে মহিষাসুরমর্দিনী পূজিত হতেন। আমাদের দেশে মোঘল আমল শুরু ১৫২৬ থেকে। সেই ষোড়শ শতাব্দীতে ৮৮৭ বঙ্গাব্দে অবিভক্ত বাংলার রাজশাহীর তাহেরপুরের সম্ভ্রান্ত রাজা কংসনারায়ণ রায় দুর্গাপুজো শুরু করেন।
কেউ বলেন দিনাজপুর মালদার জমিদার প্রথম এই পুজো শুরু করেছিলেন। তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুরু করেছিলেন পারিবারিক ভাবে। তবে সেই দেবী দুর্গার রূপ অন্যরকম ছিল। লোকমুখে শোনা যায় এই বাড়ির দেবীর বাহন হচ্ছে সাদা বাঘ এবং সবুজ সিংহ। দেবীর চোখ হচ্ছে গোলাকার।
কারুর মতে নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদারের হাত ধরে দুর্গাপুজোর শুভারম্ভ। ভবানন্দ মজুমদার শুনলেই রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের “অন্নদামঙ্গল” মনে পড়ে। ঘরে একাধিক স্ত্রী থাকা সত্বেও বৃদ্ধ বয়সে হরিহোড় অল্পবয়সী এক কন্যার পাণি গ্রহন করলে দেবী অন্নদা কোন্দলের কারণে হরিহোড়ের বাড়ি ছেড়ে নিষ্ঠাবান মানুষ ভবানন্দ মজুমদারের বাড়িতে চলেছেন বসবাস করতে। যিনি অন্নদা, তিনিই দুর্গা।
পূজা সংক্রান্ত আরও একটি তথ্য পেলাম…কলকাতায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ।
পূর্বে পারিবারিক পুজোমণ্ডপে অব্রাহ্মণের প্রবেশাধিকার ছিল না। জমিদার ও রাজাদের মধ্যেই পুজো সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে ইংরেজ তোষণ ও তাদের উপহার দেবার মধ্যে পুজোর প্রতিযোগিতা ছিল রাজা ও জমিদারদের মধ্যে। পুজোটা আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সেসময়। ইংরেজ কর্তাব্যক্তিদের তোষণ করলেই তাদের দয়াদাক্ষিণ্য মিলত, রায়বাহাদুর ইত্যাদি খেতাব জুটত। এককথায় জাতে ওঠা যেত। বলতে দ্বিধা নেই যে বিত্তবানদের হাত ধরেই এদেশে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।
সেসময় মানে ব্রিটিশ আমলে একাধিক জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো মূলত ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের তোষণ করতে।
পুজোগুলো তখন একান্তভাবেই পারিবারিক ছিল। বারোইয়ারি বা সর্বজনীন পুজো ছিল না। সর্বজনীন পুজোর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত।
আর একটি তথ্য বলছে বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা ১৬১০ সালে বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো করেছিলেন। সবই তো তখন পারিবারিক পুজো। তখন অবশ্য বেহালার বড়িশা বৃহত্তর কলকাতার অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
১৭৫৭-তে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ বণিকদের হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটল। সেসময় ভারতের স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হবার আনন্দে আমাদের শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপুজো করে লর্ড ক্লাইভকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। তিনি এত টাকা খরচ করেছিলেন যে লোকে ধন্য ধন্য করেছিল। সেকালে কোম্পানিকে তুষ্ট করতে সুদূর বর্মা থেকে বাঈজী আনা হতো। নাচ গান চলত সারা রাত। মদের ফোয়ারা উঠত। দিশি সাঙ্গোপাঙ্গোরা প্রসাদ পেতেন বৈকি। সেকালের সেই নাচগান একালে যাত্রা, থিয়েটার, জলসার রূপ পেল। বাঈজী আনা হতো না অবশ্য। ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় ভেদে সমাজের সকল স্তরের মানুষ আজ পুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন। সেকালে সেটা সম্ভব ছিল না।
পরবর্তীকালে কোনও কোনও জমিদার পুজোয় প্রজাদের আমন্ত্রণ জানাতেন। সেখান থেকে রাজার সঙ্গে প্রজার সৌহার্দ্য একটু একটু করে বাড়তে থাকে। বলা যায় বাঙালির সমাজ সম্প্রীতির সূচনাতে দুর্গাপুজোর ভূমিকা বেশ খানিকটা ছিল।
১৭৯০-তে দেখা গেল হুগলীর গুপ্তিপাড়ার জনা বারো যুবক ধুয়া তুললো…মা কী শুধু রাজা গজা বড়লোকেদের? আমরাই বা কম কী! মা আমাদেরও।
তারা বারোজন মিলে প্রথম বারোইয়ারি পুজো শুরু করল। তবে তখনও মা সর্বজনীন হননি।
দুর্গাপুজোর সঙ্গে কত শতকের ইতিহাস যে জড়িয়ে আছে! এর নেপথ্যে কতই না লোকগাথা, পৌরাণিক গল্প আছে! আর কে না জানে ইতিহাস মানে খানিক সত্য, খানিক কল্পনা মিথ।
কলকাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে বারোয়ারি পুজো কবে শুরু হয়েছিল, সে নিয়েও মতদ্বৈধতা আছে। জানা যায়.. ১৯১০ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে বারোয়ারি পুজো শুরু হয় কলকাতায়।
কারুর কারুর মতে কলকাতায় সর্বপ্রথম বারোয়ারি পুজো হলো বাগবাজারের পুজো, বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব। কিন্তু, অনেকের মতে কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট স্ট্রিটের ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’-র দুর্গোৎসব। পুজোতে সাহায্য করেছিল স্থানীয় বাসিন্দারা। মানে চাঁদা তুলে পুজো। প্রমাণিত তথ্য এই যে এদের কাছ থেকে দশকর্ম ভাণ্ডারের ফর্দ নিয়ে বাগবাজারের ১৯১৮-র পুজোর বাজার শুরু হয়। আদিগঙ্গা সংলগ্ন ঘাটটি গোবিন্দপুরের সতীস্থল বলে চিহ্নিত। আজও সেখানে বিদ্যমান সেই সাক্ষ্যবহনকারী ফলকটি। মজে যাওয়া আদিগঙ্গার সংলগ্ন পুজোস্থলের অনতিদূরেই কালীঘাট। ফলে স্থানমাহাত্ম্যে সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকখানি। কিন্তু উদাসীনতার কারণেই হোক বা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই হোক এই বারোয়ারি পুজো গুরুত্ব হারিয়ে ওই মজে যাওয়া আদিগঙ্গারই রূপ নিয়েছে।
অন্যদিকে স্থানমাহাত্ম্যের সামাজিক গুরুত্ব হেতু বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব কিন্তু এতবছর পরেও জৌলুসহীন হয়ে পড়েনি।
বারোয়ারি পুজোর আয়োজন আক্ষরিক অর্থে একরকম বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত বলা যায়। প্রাথমিক ভাবে যুবসমাজকে উদ্ধুদ্ধ করার কাজে পাঁচদিনের পুজো আয়োজনের ভূমিকা ছিল বিরাট। ফলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে, শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ রাজনৈতিক নেতারা পুজোর প্রধান কর্ণধার রূপে অবতীর্ণ হতেন। বাগবাজার, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব থেকে শুরু করে দক্ষিণের সমাজসেবী, বালিগঞ্জ কালচারাল সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র, সহযাত্রী, মুক্তদল, ফরওয়ার্ড ক্লাব, যুবমৈত্রী – সর্বত্রই চিত্রটা একইরকম ছিল। আজও বাগবাজারে ধুমধাম করে বীরাষ্টমী পুজো হয়, গ্রামীণ মেলা বসে, লাঠি খেলা ইত্যাদির প্রদর্শন নিয়ম করে হয়।
এই যে পুজোর ছলে যুবসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করে রাখা, এও একপ্রকারের থিম আর সেই থিমকে ঘিরে আচার অনুষ্ঠান এবং পুজোর আবহ নির্মাণ। ব্যাপারটা এখনও চলছে। মাতৃ আরাধনায় এসে গেল থিম পুজো।
এরপর থেকে গোটা বাংলা জুড়ে দুর্গাপুজোর প্রচলন বাড়তে থাকে। তবে দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই জগজ্জননী দনুজদলনী মা নিঃসংকোচে জমিদার ও রাজারাজড়াদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করে জনগণের মধ্যে নেমে এলেন।
এত এত তথ্য জোগাড় করে আমার এখন মাথা গুলিয়ে যাবার উপক্রম। এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি যে কে প্রথম। তবে নিশ্চিন্ত হই দেবী দুর্গা প্রাচীন দেবী। তাঁকে নিয়ে নানান মিথ। সিন্ধুসভ্যতার যুগ থেকে তিনি আছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগে বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাপূজা বিষয়ক গ্রন্থ “দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী”-তে দেবী আছেন।
বৈষ্ণব পরবর্তী যুগে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে একদা সামাজিক, রাজনৈতিক ডামাডোলে জর্জরিত মানুষ কৃষ্ণের ওপর ভরসা রাখতে আর পারল না। কেননা, ততদিনে কৃষ্ণ ঘরের ছেলে ননীচোরা গোপাল হয়ে উঠেছেন। দেবতাকে ঘরের আঙিনায় এনে ফেলেছে মানুষ। তিনি হামাগুড়ি দিচ্ছেন। মায়ের কোল যার নিশ্চিন্ত আশ্রয় তার ওপর কী বিপদেআপদে ভরসা করা যায়?
এবার মায়ের কোলে নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেতে শক্তির আরাধনা শুরু করেছিল বাংলার মানুষ। ফলত, সেই শক্তিদায়িনী এসেছেন দুর্গা রূপে এবং কালী রূপে। এবার খানিক গল্প শোনাই…
হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী বসন্তকাল হল দেবদেবী আরাধনার উপযুক্ত সময়। কেননা, এই সময় উত্তরায়ণ। সূর্য উত্তর গোলার্ধে অবস্থান করে। দিন বড় ও রাত ছোট হয়। দেবদেবীদের কাছে দিন। তাঁরা এইসময় জাগ্রত থাকেন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী চৈত্রমাসে দুর্গা আরাধনা নির্ধারিত।
অন্যদিকে দেবদেবীদের বিশ্রামের সময় হলো শরতকাল। এসময় সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করে। এসময় দেবতাদের রাত্রি। দিন ছোট ও রাত বড় হয়। পুরাণ অনুযায়ী দক্ষিনায়ণের সময়টি আবার অসুরদের আধিপত্যের সময়। এই সময় পুজো করার আসল সময় নয়। কিন্তু সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণ বধে দেবীর আশীর্বাদ চাই। তার জন্য রামচন্দ্র অকালে আবাহন করেন দেবী দুর্গাকে। রাম যে দুর্গাকে পুজো করেছিলেন তাঁর দশটি হাত এবং তিনি মহিষাসুরকে বধ করছিলেন। বরাবর আমরা যে উৎসবকে দুর্গোৎসব বা শারদীয় উৎসব বলে জেনে আসছি সেটার আর এক নাম হল অকালবোধন।
অকালবোধনের উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালিতে । বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণে বা অন্য কোনও রামায়ণে অকাল বোধনের উল্লেখ নেই।
বসন্তকালে দুর্গাপুজোর সূচনা সম্পর্কে শ্রী শ্রী চণ্ডী থেকে জানা যায়..
রাজা সুরথ ছিলেন হিন্দুপুরাণে উল্লিখিত প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের যদুবংশী সম্রাট। তাঁকে চিত্রগুপ্তবংশী রাজা (চিত্রগুপ্তের বংশধর) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে দুর্গা সপ্তশতী দেবী মাহাত্ম্য এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণে। তিনি হিন্দুধর্মের একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল বলিপুরে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বোলপুর। তিনি ছিলেন দেবী দুর্গার ভক্ত। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে তিনি মর্ত্যের অধিবাসীদের মধ্যে দেবী মাহাত্ম্য প্রচার করেছিলেন এবং তিনি বঙ্গে দুর্গাপূজার প্রথম আয়োজক ছিলেন।
গল্প হলো…সুরথ প্রতিবেশী রাজার আক্রমণে তাঁর নিজের রাজ্য হারান। সেই সুযোগে তাঁরই সভাসদগণ তাঁর সম্পত্তি লুঠ করে। সবকিছু হারিয়ে তিনি ভাগ্য ফেরাতে তাঁর রাজধানী বলিপুর (বর্তমানে বোলপুর) ত্যাগ করেন। পথে বণিক সমাধি বৈশ্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি তাঁর পরিবার ও পুত্রের কারণে গৃহত্যাগ করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁদের সঙ্গে মেধস মুনির দেখা হয়। মুনি তাঁদের ভাগ্য ফিরে পাওয়ার জন্য দেবী দুর্গার পূজা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য অজয় নদীর তীর থেকে মাটি সংগ্রহ করে গড় জঙ্গলে মেধস মুনির আশ্রমে দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পূজা করেছিলেন। গড় জঙ্গলটি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে অবস্থিত। তাঁরা বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন বলে এই উৎসবকে বলা হয় বাসন্তী পূজা বা বসন্তকালীন দুর্গোৎসব। পুজোর পর সুরথ তাঁর হারানো সম্পত্তি ফিরে পান এবং তিনি তাঁর রাজধানী বলিপুরে ফিরে আসেন। সুরথ বসন্তে তাঁর রাজধানী বলিপুরে বা বোলপুরে দুর্গাপুজো করেছিলেন। এই পুজোয় তিনি বলি দেন লক্ষ লক্ষ পশু। এই “বলি” থেকে, এই স্থানকে “বলিপুর” বলা হয়। বলিপুর থেকে বর্তমানে বোলপুর নামকরণ হয়েছে।
মেধসাশ্রমে এখনও দুর্গাপুজো হয়। আগে পুজোর সময় তোপের শব্দে জঙ্গল থেকে সিংহ ঢুকে পড়ত। কিন্তু তারা কাউকে আক্রমণ করেছে বলে শোনা যায়নি। মানুষ পশু পাখির সহাবস্থান ছিল। পূর্বে হরিণ ময়ূরে ভর্তি ছিল জঙ্গল। রাজা সুরথ আশ্রমের চারধারে প্রাচীর দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। এখনও শালের জঙ্গলে আশ্রমটি আছে। যজ্ঞকুণ্ড অনির্বান আজও। জায়গাটি গড়চণ্ডীধাম নামে পরিচিত।
গড়চণ্ডীধাম বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছিল। যেমন…মেধসাশ্রম, সুরথগড়, গড়চণ্ডীধাম, দেবীগড়, ধর্মগড়, ঢেকুরগঢ়, ত্রিষষ্ঠীগড়, কালকেতুগড়, কর্ণগড় ইত্যাদি। গড়চণ্ডীধামের ইতিহাসে আদিকাল থেকে পুরাণ ও ইতিহাসের মুনি, ঋষি, কবি ও রাজাদের নাম পাওয়া যায়। মেধস মুনি, সুরথ রাজা, সমাধি বেশ্য, রামচন্দ্র, হনুমানজী, পঞ্চপাণ্ডব, লাউসেন, ধর্মপাল, কবি জয়দেব, কাপালিক, কর্ণসেন, ইছাই ঘোষ, ভবানন্দস্বামী, কালকেতু, ফুল্লরা, চাঁদসদাগর, দেবীচৌধুরাণী, ভবানীপাঠক, ধনপতি, চিত্রসেন, রঘু ভষলে, চন্দ্রসেন ইত্যাদি। এই গড়ধাম ১১ শতাব্দী পূর্বে জঙ্গলে ঢেকে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়। ইংরেজি ১৯৯২ সালে শ্রী ব্রহ্মানন্দগিরি উদ্ধার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
এখানেই ছিল ধর্মমঙ্গল কথিত লাউসেনের রাজ্য। ইছাই ঘোষের সঙ্গে লাউসেনের যুদ্ধ হয়েছিল এখানে। ইছাই ঘোষের দেউল আছে এখনও। আমি তেপান্তরে নাট্যগ্রামে গিয়ে শাল মহুয়ার জঙ্গলের ভিতর গড়চণ্ডীধাম, ইছাই ঘোষের দেউল দেখে এসেছি।
বসন্তকালের দুর্গাপুজো কিন্তু সর্বজনীনতা পায়নি। এখন কয়েকটি বাড়িতেই শুধু হয়।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গাপুজো স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “ভারতমাতা” দেবী দুর্গার আদর্শেই কল্পিত। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো..ঐতিহ্যগত ভাবে বসন্তকালে সুরথ রাজার পুজো সর্বজনীনতা পেল না কেন? আমরা অকালবোধনকেই বা বেশি মান্যতা দিলাম কেন? দেবদেবীর বিশ্রামের সময় তাঁদের বিরক্ত করছি কেন? তেমন সদুত্তর আমার পরিচিতরা দিতে পারলেন না।
আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে কিন্তু শরৎকালে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে।হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, “…অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।”
সে যাই হোক, আমার মনে হয় হেমন্তে ফসল ওঠার আনন্দে কৃষিভিত্তিক বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। কৃষকের হাতে সময় থাকে। বর্ষা ধোয়া প্রকৃতি এসময় অত্যন্ত মনোরম। দুর্গা পুজোতে তো প্রকৃতিকেও বন্দনা করা হয়। ফসল ওঠার আনন্দে পূর্বাহ্নে মাতৃবন্দনা। মায়ের মধ্যে বাঙালি মা কন্যাকে খোঁজেন। পার্বতী তো গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার কন্যা। মায়ের মন এই সময় কন্যার জন্য ব্যাকুল হয়। তিনি গিরিরাজকে বলেন…
“যাও যাও গিরি আনিতে গৌরি
উমা আমার কত কেঁদেছে।”
স্ত্রীর কথা অমান্য করার মত বুকের পাটা কোনও কালে কোনও স্বামীর ছিল না, আজও নেই। তাই…
তাছাড়া, কৃত্তিবাসী রামায়ণ যেভাবে আমাদের জনজীবনে ওতপোতভাবে জড়িয়ে আছে, দেবোপম রাম আমাদের কাছে যত প্রিয়, তেমন আর কিছু না। তিনিই আমাদের আদর্শ। তিনি ভালো পুত্র, প্রজানুরঞ্জক, তিনি ভালো স্বামী, ভালো দাদা, তিনি দুষ্টের দমন করেন। (নিন্দুকরা অবশ্য অন্য কথা বলেন।) তাই রামের কর্মকান্ড প্রাধান্য পাওয়ারই কথা। সুরথ রাজা সেভাবে আমাদের আকর্ষণ করতে পারেননি। তাঁর তেমন জনপ্রিয়তা নেই।
আরও একটি কথা জানলাম আমার বান্ধবী এবং একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মানসী নস্করের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে। কথাটি বেশ যুক্তিগ্রাহ্য মনে হলো।
কথাটি হলো…বসন্তকালের দেবী মূলত অন্নদাত্রী। তিনি অন্নদা। আমাদের জীবনে অন্নের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না ঠিকই, কিন্তু জণজীবনে নিরাপত্তা দরকার ততোধিক। রাম সেই দুর্গতিনাশিনী দেবীর পুজো করে দুষ্টের দমন করেছিলেন। আমরা দুর্গতি থেকে পরিত্রাণ পেতে অকাল বোধনকে আঁকড়ে ধরেছি।
সম্ভবত এই সব কারণের জন্য অকালবোধন আমাদের জীবনে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
সেকালে প্রতিমা গড়া শুরু হতো আষাঢ় মাসে রথের দিন থেকে। ওইদিন চণ্ডীমণ্ডপে একচালার সাবেকি কাঠামোটিতে মাটি দিয়ে বিগ্রহ গড়ার কাজ শুরু। কারিগররা বিশ্বাস করতেন ওইদিন যোগমায়া আবির্ভূত হয়েছিলেন। প্রতিমা গড়া শুরু করার পক্ষে দিনটি শুভ। তা আমাদের জেলা মেদিনীপুরের সব গ্রামে তো আর পুজো হতো না। বারোয়ারি পুজো তখন এক আধটা। আমি আমার ছোটবেলা সেই ষাটের দশকের কথা বলছি। কাঠামো পুজোর কথা শুনিনি সেসময়।
এখন যে খুঁটিপুজো দেখি, পুরাণে সেই খুঁটিপুজোর উল্লেখ কিন্তু নেই। নিতান্ত আধুনিক কালে আড়ম্বরের সঙ্গে একালে খুঁটি পুজো শুরু হয়েছে। খুব বেশিদিনের কথা নয়।
সেকালে মণ্ডপে থেকে কারিগর প্রতিমা গড়তেন অনেকদিন ধরে। তখন থেকে আমাদের মনে উৎসবের শুরু। এখন তো সে গল্প নেই। চণ্ডীমণ্ডপ আর কোথায়! কুমোরটুলি থেকে বা অন্য কোথাও থেকে বিগ্রহ আসে লরিতে। উৎসব প্রিয় বাঙালি কয়েক বছর ধরে দেখছে পুজোর স্থানে পার্কে খুঁটি পুতে পুরুত ডেকে খুঁটিপুজো হচ্ছে। ঢাক কাঁসর শাঁখ বাজছে। খুঁটিপুজোর দিন পাড়ার মহিলাদের নাচগান হচ্ছে, আড়ম্বর হচ্ছে ওই একদিন। ওই একদিনের জন্য। সেকালের মত ধীরে ধীরে মানবজমিন সরস করে নয়। আমরা যারা ঘরকুনো, তারা শাঁখ কাঁসর ঢাকের শব্দে বুঝে যাই…ওই রে, আজ থেকে ঢাকে পড়ল কাঠি। দুগ্গিমায়ের আসার সময় হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা নেত্রী মন্ত্রীদের জনসংযোগ বাড়ে, সেলিব্রেটিদের দেখতে পাড়া থেকে লোক ঝেঁটিয়ে জড়ো হয়। বামুনপুরুত ঢাকীদের কিঞ্চিৎ বাড়তি উপার্জন হয়। এলাকাবাসী মুফতে বাড়তি কিছু আনন্দ পায়। আনন্দটাই মূল কথা। তারপর ভুলে যায় গেরস্থ।
শ্রদ্ধেয় মধুসূদন লাটুদাদা জানালেন…
“আগে অর্থাৎ আমার ছোটবেলা ষাটের দশকের শুরুতে খুঁটি পূজা ছিল না ঠিকই, কিন্তু ধ্বজা পূজা হতো। গ্রামে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে মানে ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো যে অমুক দিন প্রতিমার কাঠামোয় মাটি দেওয়া হবে। সেদিন একটি লম্বা বাঁশের ডগায়, যার মাথাটা মুড়োনো হতো না, কিছু পাতা থাকতো, সেখানে চেলি কাপড়ে, যতদূর মনে পড়ে, হরিতকী, বহেড়া, সুপারি, একটি মুদ্রা, দুর্বা প্রভৃতি দিয়ে বেঁধে, বারোয়ারি তলায়, যেখানে পূজা হবে, সেখানে পুঁতে দিয়ে পুরোহিত দিয়ে পূজা করা হতো। ওইদিন গ্রামের সবাই নিরামিষ আহার করত। এর নাম ধ্বজাপূজা। সম্ভবতঃ এই ধ্বজাপুজোরই পরিবর্তিত রূপ খুঁটিপূজা।
আর একটি কথা হলো..
অনেক পূজা মণ্ডপে রথের দিন গঙ্গামাটি সহ বিশেষ স্থানের মাটি মিশিয়ে প্রথম কাঠামোয় লেপন করা হয়।”
দ্বিতীয় বিষয়টি জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি শুনে আসছি। অনেক পরে কারণটি জেনেছি। সিধুজ্যাঠাকে জিজ্ঞেস করে এখন মিলিয়ে নিলাম।
সেখানে বলা আছে দেবীর আদলকে ফুটিয়ে তুলতে গাভীর মূত্র, গোবর, ধানের শিস, পবিত্র গঙ্গার জল আর নিষিদ্ধপল্লীর মাটি অত্যাবশ্যক৷ পুরাকাল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। কিন্তু সমাজে যাদের ঠাঁই নেই, তাদের ঘরের মাটি দেবীমূর্তির জন্য অপরিহার্য কেন? বলা হয়, পুরুষ মানুষ পতিতালয়ে গিয়ে যখন যায়, তখন সে তার জীবনের সঞ্চিত সমস্ত পুণ্য সেখানে ফেলে আসে৷ পরিবর্তে পাপ নিয়ে আসে৷
সমাজ যাদের এভাবে দূরে ঠেলে রেখেছে, আদিশক্তি মা তাদেরই কাছে টেনে নিয়েছেন। তাঁর কাছে সবাই সমান। অকালবোধনের সময় মহিষাসুরমর্দিনীকে গড়তে হবে পতিতাপল্লীর মৃত্তিকাতেই। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে এই মাটি লাগবে চিন্ময়ীর কাঠামোয়। বহু পুরুষের পুণ্যে সেখানকার মাটি পূর্ণ। তাই পুজোর মাতৃমূর্তি গড়তে পতিতালয়ের পুণ্য মাটি প্রয়োজন।
কারণ যাই হোক পতিতাপল্লীর মাটি দিয়ে গড়া যে মূর্তি, তার সামনেই নতজানু হয় স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবছর এভাবেই প্রতিটি ঠাকুরদালানে বা পাড়ার মণ্ডপে হয়ে যায় এক নিঃশব্দ বিপ্লব।
আমাদের গ্রাম মেদিনীপুরে একসময় রথের দিনের পরিবর্তে দুর্গা ষষ্ঠীর আগের চাপড়া ষষ্ঠীতে বেলগাছের তলায় ঘটপুজো করে বেলতলার মাটি দিয়ে বিগ্রহ গড়ার কাজ শুরু হলো। মানে একমাস আগে থেকে কাঠামোতে মাটি লেপা শুরু হলো। এখন অবশ্য গতির যুগে গ্রামেগঞ্জে পনেরোদিন আগে মাটি লেপা শুরু হচ্ছে। আমাদের গ্রাম মেদিনীপুরেও তাই।
তো যে কথা বলছিলাম…চাঁদার বিল হাতে পাড়া বেপাড়ার উদ্যোক্তাদের আসাযাওয়া শুরু হয় খুঁটিপুজোর কদিন পরে। তখন মনে পড়ে…
ওই রে, এবার সত্যিকারের শুরু হলো। পাশের বাড়ির গেটে গৃহকর্তার সঙ্গে বচসা শুনে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে পর্দার আড়ালে মুখ লুকিয়ে শুনতে চেষ্টা করি…কতটি হাঁকলো। খসলো কতটি।
শিক্ষক এবং সাহিত্যিক ভ্রাতৃপ্রতিম কৃষ্ণেন্দু দেব বলছিলেন…সেকালে পুজোর উদ্যোক্তারা পুজোর খরচ কমিয়ে বন্যাত্রাণে সাহায্য করতেন বা দুস্থদের শীতবস্ত্র বা নতুন জামাকাপড় বিতরণ করতেন পুজোপ্যাণ্ডেল থেকে। হাতে বস্ত্র নিয়ে কিছুক্ষণ স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে হাসি হাসি মুখে চেয়ে ছবিটবি তুলে লোকজানানোর জন্য ফেসবুকে পোস্ট করা ছিল না। ফেসবুকের রমরমা তো ছিল না সেকালে। ডানহাত যে কাজ করে, বাঁহাত জানতে পারতো না। একালে ত্রিভুবনের দেব দৈত্য মনুষ্য সবাইকে সবকিছু জানানো হয়ে যায় মুহূর্তে… দ্যাখো, আমি কত মহৎ।
এখন পুজোর উদোক্তাদের অনুদান দেয়া হয় সরকার থেকে। তখনও চাঁদা তুলে বড় বড় পুজো হতো আড়ম্বরের সঙ্গে। টাকার অভাবে নমো নমো করে নয়। এখনও হয়। অনুদানের টাকা কী হয়, কোথায় যায় কে জানে! জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকেই অনুদান। আবার জনগণ চাঁদাও দেয় বিনা প্রতিবাদে। হাঁদারাম আমরা ভাবি সরকার টাকা ছাপিয়ে সরকারের নিজস্ব ভাণ্ডার থেকে বিতরণ করছে। সুতরাং প্রতিবাদ কেন, তার চেয়ে অনুগত হই।
যে কথা বলছিলাম…শহরতলির খালেবিলে, গ্রামগঞ্জের পতিত জমিতে একদিন কাশফুল মাথা তুলে নিজেকে মেলে ছড়িয়ে হাওয়ায় দোল খায়, নীল সাদা লাল শালুকে শালুকে কালো ডোবা হাসে। সকালের দুব্বোয় মণিক জ্বলে, ভোরবেলা শিউলি তলায় পল্লীবালারা জড়ো হয়, বাতাস হিমেল পরশ ছোঁয়ায়। এসব দেখে বেশিরভাগ মহিলা এবং দু চারজন পুরুষের মনে ঐশ্বরিক খুশি জাগে। ছুটে যায় গঞ্জের ঘাটেবাটে। পাটপচানো ডোবার ধারে প্রজাপতি ব্রহ্মার মাথার চুলের মত কাশের মেলা সেখানে। এ বিষয়ে দুই বাংলার মহিলারা সমান। ফেসবুকের কল্যানে আমরা নীরস কাটখোট্টা কিছু মানুষ Wow, So cute, Lovely ইত্যাদি মন্তব্য করি, ওই যেগুলো ফেসবুকে আপনিই এসে যায়। কষ্ট করে লিখতে হয় না। তবে দেখতে খারাপ লাগে না। মনে একটু ঈর্ষা জন্মে বৈকি। যাব যে সঙ্গী কোথায়!
সেকালে চণ্ডীমণ্ডপে বসে কাঠামো বিন্যাস, খড় জড়িয়ে প্রতিমার আকৃতি তৈরি, পাটকুচি মিশিয়ে মাটি ছানা, এক মেটে, দো মেটে করা, ছাঁচে ঠাকুরের মুখ তৈরি সব চলত একসঙ্গে। ছানার গুণে মাটি হয়ে উঠত মাখনের মত। আমরা ছোটরা সে মাটির কিছুটা ভাগ পেতাম। সেই দিয়ে পুতুল গড়ার হাতেখড়ি হতো আমাদের। প্রধান কারিগর তার সঙ্গী একজন বা দুজন নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে ক-মাস থাকত। যাদের পুজো, তারাই খাওয়াদাওয়া দিত। বাঁশের কাঠামোয় কবন্ধ মূর্তিগুলো ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকত। ছাঁচে তৈরি মুখগুলো চটের ওপর সারি সারি শুকোত। গনেশ, মহিষাসুর ছাড়া সবার একরকম মুখ। পরে দাড়ি গোঁফ চুলে পুরুষ মহিলা বোঝা যেত। মালসায় হরেকরকম রং গোলা থাকত। কালো রঙে শন চুবিয়ে চুল তৈরি হতো। দেবদেবী সব মাটির কাপড় পরতেন। মাটির কাপড়ের ওপর রঙের কারুকাজ বেনারসিকে হার মানাত। চালচিত্র তৈরি করত সহযোগীরা। বড় কারিগর একদিন সকালে স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্রে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথমে দুর্গার চক্ষুদান করতেন। তারপর অন্যদের। আমরা ছোটরা স্কুলের পরে চুপচাপ এসব কাজের সাক্ষী থাকতাম।
একালে ছোটরা ভিড় করে দেবদেবীদের হয়ে ওঠা দেখতে পায় না। অনেক কিছু তারা জানতে পারে না। ভারতীয় সংস্কৃতির কিছুই তাদের ছোঁয় না। অথচ পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান ওদের মগজে। এরা সব এক একটা বিদ্যের জাহাজ। বাবা মা নিজেদের ইচ্ছে ওদের ওপর চাপিয়ে চটপট বড় করে দেয়। সুন্দর শৈশব হারিয়ে যায়।
সেকাল থেকে একালে দুর্গা প্রতিমার বিবর্তন ঘটেছে অনেক। আজ আমরা যে রূপে বিগ্রহ দেখি, তেমনটি পূর্বে ছিল না। সেকালে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গা পূজিত হতেন একলা। পরবর্তীকালে সিংহবাহিনী রূপে দেখা গেল। তারও কারণ আছে। পরে বলছি।
এখন বাংলায় দেবী দুর্গার দু ধরণের মূর্তি দেখা যায়। একটি সপরিবারে এক চালার দেবী মূর্তি। এখানে দেবী মধ্যমণি, সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ, বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিক। কথিত আছে…বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে সপরিবার দুর্গার পূজা প্রচলন করেন। কেউ বলেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মায়ের পারিবারিক রূপটির প্রথম প্রবর্তক। এ নিয়েও ধন্দের শেষ নেই।
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর সংলগ্ন অঞ্চলে এক বিশেষ মূর্তিতে দেবীকে দেখা গেল। সেখানে এক চালায় দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন।
কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকের সঙ্গে স্থান বদল করতে দেখা যায়। আবার কোথাও দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতে দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের মূর্তি চোখে পড়ে।
সাহিত্যিক ও সমাজসেবক অরূপ চ্যাটার্জী বলছিলেন কৃষ্ণনগরে মান্ধাতা আমল থেকে তাঁদের যে পারিবারিক পুজো হয়, সেখানে দেবী দুর্গার গাত্রবর্ণ নীল। অন্য দেবদেবীদের গাত্র বর্ণ অন্যত্র যেরকম দেখা যায়, সেরকমই। আর মায়ের ডানদিকে সরস্বতী, কার্তিক, বাঁদিকে লক্ষ্মী ও গনেশ। নবপত্রিকা তো সব সময়ই গনেশের পাশে থাকে। পুত্র কন্যাদের স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে অরূপবাবু বললেন..এই রীতিটি পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে। যে পরিবারে দেবীর এরকম বিগ্রহ দেখবেন, বুঝবেন যে পরিবারটি পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে।
বলছিলাম কৃষ্ণনগরে অরূপবাবুর বাড়িতে পূজিত দেবী দুর্গার গায়ের রঙের কথা। তিনি জানালেন..বহু প্রাচীন পরম্পরায় চলে আসা দেবীর মূর্তি তৈরির সময় কারিগর এক বছর ভুলক্রমে দেবীর গায়ে নীল রঙ দিয়ে ফেলেন। গৃহকর্তা রেগে গেলেন। কিন্তু তিনি সেই রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন যে দেবী নিজেই চাইছেন নীল বর্ণ। সেই থেকে ওঁদের বাড়িতে দেবী দুর্গার গায়ের রঙ নীল হয়ে আসছে আজও। কারণটি অরূপবাবু ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন। ওঁদের বাড়িতে নবমীর পুজোতে শত্রু বলির প্রথা আছে। চালের গুঁড়ো দিয়ে পুতুল তৈরি হয়। ওটি শত্রুর রূপক। তাকে কলাপাতায় শুইয়ে দেবীর সমুখে রেখে বাড়ির বয়স্ক পুরুষগণ একসঙ্গে খাঁড়া হাতে দেবীর দিকে পিছন ফিরে বলি দেন। অন্তরের পাশব প্রবৃত্তিগুলোর বিদায় হয় এভাবে।
অরূপবাবুদের পারিবারিক পুজোয় দেবীর গায়ের রঙের কথা আসায় আমার মনে প্রশ্ন এলো দেবীর গাত্রবর্ণ লালচে বা হলুদ কেন?
বহু বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় নানা রূপে, নানা রীতিতে। প্রতিটি বাড়ির পুজোয় নিজস্ব নিয়মরীতি চলে। দুর্গা শতরূপা। তাঁর বিভিন্ন রূপের পিছনে লুকিয়ে আছে নানা ধরনের গল্প। তাই দুর্গার গায়ের রঙ নিয়ে নানা মুনির নানান মত প্রচলিত।
জানা যায়…বেশিরভাগের মতে দুর্গার গায়ের রঙ হবে লালচে। এই রঙ রাগ, শক্তি আর জয়ের প্রতীক। দেবী দুর্গা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পীতবর্ণ কিংবা হরিদ্রাবর্ণ অথবা অতসী ফুলের রঙ। রঙ নিয়ে রহস্য লুকিয়ে আছে সনাতন বিধানে। সেখানে বলা হয়েছে, দেবীর গায়ের রঙ অতসী ফুলের মতো।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, অতসী ফুল আমাদের দেশের একেক জায়গায় একেক রঙের ফোটে। বেশির ভাগ জায়গাতেই তার রঙ হয় হলুদ, তাই আমাদের দুর্গা মূর্তির রঙও হলুদ। আবার কিছু কিছু জায়গায় অতসী ফুল ফোটে নীল রঙের। সেইসব জায়গায় দুর্গা মূর্তিও নীল। এই রঙ নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে।
আবার বলা হচ্ছে দেবী দুর্গা যখন যোগমায়া রূপে মধু ও কৈটভ নামক দুই দৈত্যকে বধে বিষ্ণুকে সাহায্য করেছিলেন তখন তাঁর গাত্রবর্ণ হয়েছিল নীল।
আপনারা দেবী দুর্গার বাহন সিংহের দু রকম মুখ লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই। কোথাও আসল সিংহের মতো, তো কোথাও সিংহের শরীরে মুখটি ঘোড়ার আদলে।
সিংহের এই নানা রূপের পিছনে রয়েছে নানা কাহিনি। শোনা যায় ঘোটকমুখী সিংহের প্রচলন করেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তিনি নতুন রীতির দুর্গা পুজো শুরু করেন। মহালয়ার দিন থেকে রাজ্যের মঙ্গল কামনায় শুরু হত যজ্ঞের। সেই যজ্ঞ চলত টানা নবমী পর্যন্ত। এই সময় যজ্ঞের আগুন নিভত না। দেবীকে এখানে পুজো করা হত রাজরাজেশ্বরী শক্তির প্রতীক রূপে। দেবীর সাজেও তাই যোদ্ধার বেশ। যোদ্ধারা তো ঘোড়াতেই সচ্ছন্দ। সেই কারণেই দেবীর বাহন এখানে ঘোটক মুখের। আজও সেখানে দেবীর বাহনের মুখ ঘোড়ার মতোই। যোদ্ধা বেশেই পূজিত হন দেবী।
অন্য মতে শাক্ত আর বৈষ্ণবদের কোন্দলের একটা কারণের উল্লেখ পাওয়া যায়। ফলে শক্তির উপাসকদের সিংহ স্বাভাবিক। কিন্তু বৈষ্ণবদের সিংহের মুখ হয়ে গেল দাবার ঘোড়ার মত।
বলছিলাম দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী থেকে সিংহবাহিনী হয়ে ওঠার গল্প।
সমস্ত পুরাণ থেকে দেবী দুর্গা বিষয়ক যে তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলোর রচনাকাল ষষ্ঠ শতকের আগে নয়। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন জায়গার মাটির তলা থেকে যেসব দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে, তার মধ্যে যীশুখ্রিস্টের জন্মের আগের সময়ের মূর্তিতেও দেবীর বাহন হিসেবে সিংহের উপস্থিতি আছে। দুর্গার মূর্তিগুলির দুটি রূপ পাওয়া যায়.. মহিষমর্দিনী এবং সিংহবাহিনী। গবেষকরা বলছেন..এর মধ্যে সম্ভবত মহিষমর্দিনী রূপটিই প্রাচীন। অনুমান করা হয়, সিংহসহ মহিষমর্দিনী মূর্তি এসেছে সপ্তম শতাব্দী থেকে। অর্থাৎ, বুদ্ধযুগ থেকে হিন্দুযুগে প্রত্যাবর্তনের গোড়ার দিক থেকে মহিষমর্দিনী মূর্তি আস্তে আস্তে সিংহবাহিনী হয়ে উঠেছেন।
আর একটি ঘটনা হলো…প্রাচীন কালে বাংলায় যেহেতু সিংহ দেখা যেত না তাই শিল্পীরা এখানকার চেনা ঘোড়াকেই কেশর লাগিয়ে সিংহের আদল দিতেন। পরে আঁকা ছবিতে সিংহের আসল চেহারা দেখে শিল্পীরা আসল সিংহের মতোই দেবীর বাহনকে গড়তে আরম্ভ করেন।
দেবীপুরাণ মতে, বিষ্ণুই দু্র্গার বাহন হিসেবে সিংহের রূপ ধারণ করেছিলেন। জঙ্গলের রাজা তো বটেই, দেবদেবীদের বাহনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয় সিংহকে।
তাছাড়া, আরও একটি পৌরাণিক কাহিনি হলো…
মহাদেবকে স্বামী হিসেবে পেতে হাজার বছর ধরে কঠিন তপস্যা করেছিলেন দেবী পার্বতী। তপস্যার কারণে দেবী অন্ধকারে একসময় মিশে গিয়েছিলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব পার্বতীকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যান। তবে বিয়ের একদিন পর পার্বতীকে কালী বলে সম্বোধন করায় অপমানিত হয়ে কৈলাস ত্যাগ করে ফের তপস্যায় মগ্ন হয়ে যান তিনি। তপস্যারত দেবীকে একা দেখতে পেয়ে শিকার করার ইচ্ছায় এক ক্ষুধার্ত সিংহ ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু দেবী এমন কঠিন তপস্যায় মগ্ন থাকেন যে দেবীর সামনে চুপ করে বসে পড়ে সিংহ। বসে বসে ভাবে তপস্যা ভেঙে দেবী উঠলেই দেবীকে হত্যা করে খিদে মেটাবে।
এরমধ্যে বহু বছর কেটে যায়। সিংহ তার নিজের জায়গা থেকে একবিন্দু নড়ে না। এদিকে দেবী পার্বতীর তপস্যা সম্পন্ন হওয়ার পর মহাদেব আবির্ভূত হয়ে পার্বতীকে গৌরবর্ণা বলে সম্বোধন করেন। তাই দুর্গার অপর নাম গৌরী। তবে গঙ্গায় যখন পার্বতী স্নান করে ওঠেন, তখন অন্ধকারের দেবী শ্যামা বা কালী রূপে আবির্ভূত হন। তাঁকে কৌশিকী বলা হয়ে থাকে। পাশাপাশি এতবছর ধরে দেবীর পাশে সিংহ অপেক্ষা করে বসেছিল। দেবীর দয়া হয়। সেই সিংহকেই বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন দেবী পার্বতী।
শাস্ত্র অনুসারে, সিংহ হল রজোগুণের এক শক্তিশালী উচ্ছ্বাসের প্রতীক। শুধু তাই নয়, সিংহ হল মানুষের পশুত্ববিজয়েরও প্রতীক।
আমরা লক্ষ্য করেছি বাংলায় পারিবারিক পুজোর দেবীমূর্তি এখনও একচালার। পিছনে চালচিত্র থাকে। কিন্তু সর্বজনীন পুজোতে এখন আর একচালার মূর্তি হয় না। পাঁচটি আলাদা আলাদা কাঠামো হয়। মূর্তির আকার আয়তন বড় বড়। অনেক শৈল্পিক হয় মূর্তি নির্মান। চিরাচরিত মাতৃমৃর্তি যেভাবে ভেবে এসেছেন বা দেখে এসেছেন দর্শক, সেভাবে হয় না।
মাটির জামাকাপড় এখন অচল। কুমোরদের হাতেও একচেটিয়া মূর্তি গড়া নেই। সরকারি আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ডিগ্রিধারী শিল্পীরা এসে গেছেন। নতুন নতুন ভাবনা, পরিকল্পনা করে কত পরীক্ষানিরীক্ষা করে থিম পুজো ব্যাপক আকারে চালু হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মণ্ডপ সজ্জা, প্রতিমা গড়া আর আলোর রোশনাই এসে গেছে আমাদের একালের পুজোয়।
এক চালা থেকে কবে মা পাঁচ চালা হলেন, সে ইতিহাসে জড়িয়ে আছে একটি দুর্ঘটনা। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কুমোরটুলি সর্বজনীন পুজো প্যাণ্ডেলে সেবার পঞ্চমীর দিন বিকেলে আগুন লেগে গেল। সব পুড়ে ছারখার। সেসময় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সেই পুজোর সভাপতি। তাঁর মাথায় হাত। রাত পোহালে ষষ্ঠী, দেবীর বোধন। কী হবে! সেই সময়কার পৃথিবীখ্যাত স্বনামধন্য শিল্পী ছিলেন গোপেশ্বর পাল। তিনি জড়িয়ে রয়েছেন একাধিক ঐতিহাসিক ও দুঃসাহসিক কাজের সঙ্গে। সুভাষচন্দ্র তাঁকে ধরলেন..রাতের মধ্যে প্রতিমা গড়ে দিতে হবে। কিন্তু সেও কী সম্ভব! শেষে অনেক আলোচনার পর শিল্পী বললেন…অসম্ভব সম্ভব হবে যদি এক চালা থেকে আলাদা আলাদা পাঁচটি চালা করা হয়। রাজি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। গোপেশ্বর পাল দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করলেন। অন্য চারজন শিল্পী বাকি মূর্তিগুলি তৈরি করলেন। পরের দিন পুত্র কন্যাসহ মা এলেন মণ্ডপে। দেবীর জমকালো পোষাক দেখে বেঁকে বসল পুরোহিত সম্প্রদায়। শিল্পীর সঙ্গে অনেক আলোচনার পর পুরোহিত পুজো করতে রাজি হলো। ১৯৩৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র সভাপতি থাকাকালীন দেবীর পরণে সত্যিকারের বাঘছালও উঠেছিল। তা দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়েছিল প্যান্ডেলে। থিম পুজোর ব্যাপক চল শুরু তখন থেকে।সেই দিক থেকে দেখতে গেলে প্রথম থিমের প্রতিমা এবং পাঁচ চালার ঠাকুর গোপেশ্বর পালের হাতেই গড়ে ওঠে।
দেবী দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামো বিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলার দুর্গোৎসবে সর্বত্র দেবী দুর্গা সপরিবারে পূজিতা।
চালচিত্র বিষয়ে সিধু জ্যাঠা যা বলল তার খানিক হল…সাবেকি দুর্গা প্রতিমার মাথার ওপরে পিছনে দেবদেবীর কাহিনিমূলক পটচিত্র হল চালচিত্র। এটি অর্ধগোলাকৃতি এবং এতে পঞ্চানন শিব, মহিষাসুর বধ, নন্দী-ভৃঙ্গী, শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ প্রভৃতি কাহিনির ধারা আঁকা হয়। এই চিত্রকলার একটি নিজস্ব রূপরেখা ও শৈলীগত দৃঢ় বুনিয়াদ আছে। শিল্পীদের ভাষায় এই চালচিত্র হল ‘‘পটলেখা’’। এটি বাংলার পটচিত্রের একটি বিশেষ ধারা।
ফিরে যাই দেবীর সাজপোষাকে। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে দুর্গা প্রতিমার সাজপোষাকের বিবর্তন ব্যাপক আকার ধারণ করে। কেবল প্রতিমাশিল্পেই নয়, পুজোর পুরো চেহারাটাই বদলাতে শুরু করে। নয়া বিবর্তনের হোতা ছিলেন বিত্তবান জমিদার তালুকদারেরা।
রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো করলেও পুজোয় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। সেই সময় ডাকের সাজ ছিল আধুনিক। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথম ডাকের সাজে সাজিয়েছিলেন মা-কে। মতান্তরে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি শোভাবাজার রাজবাড়িতে ডাকের সাজের প্রচলন হয় প্রথম।
এই সাজ একেবারই পছন্দ ছিল না কালীপ্রসন্ন সিংহের। তিনি তাঁর “হুতোম পেঁচার নকশা”-য় নিন্দেও করেছেন। ১৮৬২ সালে প্রকাশিত নকশায় হুতোম লেখেন, “বিলেত থেকে অর্ডার দিয়ে সাজ আনিয়ে প্রতিমা সাজানো হয়। মা দুর্গা মুকুটের পরিবর্তে বনেট পরেন, স্যান্ডউইচের শেতল খান, আর কলাবউ গঙ্গাজলের পরিবর্তে কাৎলী-করা গরম জলে স্নান করে থাকেন, শেষে সেই প্রসাদী গরম জলে কর্মকর্তাদের প্রাতঃরাশের টি ও কফি প্রস্তুত হয়।”
কাৎলী-করা গরম জল হলো কেটলিতে গরম করা জল।
সেকালে পুজোয় ব্রিটিশরা অংশগ্রহণ করত। দুর্গাপূজার সূচনা হতো আমিষ ভোজন থেকে সুরা পরিবেশন পর্যন্ত। বাঙালির সঙ্গে ইউরোপীয়দের আত্মিক যোগ স্থাপিত হয় তখন থেকে। তখন থেকেই দুর্গা প্রতিমা সজ্জিত হয়ে আসছে ডাকের সাজে।
পারিবারিক পুজোয় এবং কিছু বারোয়ারি পুজোয় আজও সাবেক আমলের ডাকের সাজ পরানো হয় প্রতিমাকে। অন্যরকম সুন্দর এক রূপ খোলে প্রতিমার। প্রতিমার মাথার পিছনে ওপর দিকে চালচিত্রেরও ওপরে শোলার কারুকার্য ঘিরে থাকে। প্রতিমার রূপ তাতে বেশ খোলতাই হয়। ডাকের সাজ বলতে শোলা দিয়ে বানানো ওই প্রতিমার পিছন দিকের কারুকার্য, মুকুট এবং অলঙ্কারের কথা বলা হচ্ছে। আজকে ডাকের সাজ সেকেলে হলেও একদিন এই সাজ জগৎ জয় করেছিল। তখন বিগ্রহে ডাকের সাজই মুখ্য ছিল। সেটাই আধুনিক।
ডাকের সাজ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করলেও খুবই ভঙ্গুর। কাজ করতে হয় সতর্কতার সঙ্গে। তাই পরবর্তীকালে শোলার কাজে রাঙতা, জরি ইত্যাদির ব্যবহার করলেন শিল্পীরা। সেই রাঙতার নাম ছিল বিটেন সিলভার। আমাদের দেশে পাওয়া যেত না বলে বিদেশ থেকে ডাক মারফত আনাতে হতো। বিদেশ মানে জার্মানি এবং নেদারল্যান্ড থেকে। ডাক মারফত আনা হতো বলে তাকে “ডাকের সাজ” বলা হয়। অপভ্রংশে কেউ কেউ “ঢাকের সাজ” বলেন।
শোলাও আনানো হতো জার্মানি থেকে।
পরবর্তীকালে দেখা যায় কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা এ বিষয়ে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছেন। দূরদূরান্ত থেকে উদ্যোক্তারা কৃষ্ণনগরে আসতেন শোলার কাজ কিনতে। থার্মোকল, জরি, চুমকি, তার ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো তাতে। এক সময় বিদেশেও রপ্তানি করা হতো ডাকের মাধ্যমে।
পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার বনকাপাসি গ্রামের অনেক শিল্পী শোলার অনন্য সুন্দর কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন।
বাংলা হলো গল্পের রাজ্য, রূপকথার রাজ্য। এখানে গল্প তৈরি করেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও। ডাকের সাজ নিয়ে লোককথা হলো এই… হিমালয়-কন্যা পার্বতীর বিয়ে স্থির হয় দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে। মহাদেবের ইচ্ছে হলো বিয়েতে হাল্কা এবং সাদা মুকুট পরবেন। কটিমাত্র বাঘছালে আবৃত শরীর কী আর জবরজঙ পোষাক সইতে পারে? কিন্তু কী সেই বস্তু যা হাল্কা এবং সাদা? ত্রিভুবনে খুঁজে পাওয়া গেল না। মহাদেব তাঁর দৈবী শক্তি দিয়ে নরম এক জাতীয় উদ্ভিদের সৃষ্টি করলেন। যা পরে শোলা গাছ নামে পরিচিতি পায়।
কিন্তু দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা নরম ও সূক্ষ্ম শোলার কাজে অভ্যস্ত ছিলেন না। সমস্যার কথা তিনি মহাদেবকে জানান। মহাদেবের ইচ্ছেতে জলাশয়ে সৃষ্টি হয় এক যুবকের। যিনি সুকুমার মালাকার নামে পরিচিত হন। তাঁর থেকে আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ করে মালাকার সম্প্রদায়। বর্তমানে যাঁরা শোলার শিল্পী নামে পরিচিত, তাঁরা সুকুমার মালাকারেরই বংশোদ্ভুত। সুকুমার মালাকারই মহাদেবের বিয়ের মুকুট তৈরি করেছিলেন। শোলার কারুকার্যময় হাল্কা অলঙ্কার দেবীর পছন্দ। শিল্পীরা কাজটি লুফে নিলেন। ডাকের সাজে মাকে অনবদ্য মানায়। এখন হিন্দুদের বিয়েতেও ওই শোলার হাল্কা মুকুটই পরতে হয়। এই হলো ডাকের সাজ।
ভেবে অবাক হই…বিশ্বকর্মা, মহাদেব, মালাকার, দুর্গা সব আমাদের দেশের। শোলাও এদেশের আবাদে প্রচুর। অথচ, ডাকের সাজ আনাতে হত বিদেশ থেকে!
একালে নকল গয়না প্রচুর পাওয়া যায়। দেবীকে সেসব পরানো হয়। ডাকের সাজে খরচ বেশি বলে এড়িয়ে যান অনেকে। তবে আসল সোনার গহনাও কোথাও কোথাও পরানো হয়। ফলাও করে সেসবের বিজ্ঞাপন দেয়া হয় দর্শক বাড়ানোর জন্য। ভীড় উপচে পড়ে সেসব প্যাণ্ডেলে। জোরদার প্রহরা থাকে অবশ্য।
কলকাতার একডালিয়া, সন্তোষমিত্র স্কোয়ার, শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব, ত্রিপুরার আগরতলা ছাত্রবন্ধু ক্লাব এ বিষয়ে অগ্রণী।
তবে এই সোনার গয়না দিয়ে সাজানো বিষয়টির অবতারণা প্রথম করেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর দাঁ পরিবারের শিবকৃষ্ণ দাঁ। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে দুর্গাপুজো নিয়ে শিবকৃষ্ণ দাঁর বেশ রেষারেষি ছিল। সেকালে কলকাতার প্রবাদ প্রতিম বিখ্যাত ব্যবসায়ী শিবকৃষ্ণ দাঁ ১৮৪০ সালে দুর্গাপুজো শুরু করেন। নিজে খুবই শৌখিন মানুষ ছিলেন, সোনার গয়না পরতে ভালোবাসতেন। দেবীকেও সোনার গয়নায় সাজাতেন।
অভিজাত পরিবারে দুর্গাপুজোয় বিগ্রহের মাথার ওপর এ্যাপ্লিকের সুন্দর কারুকাজ করা একটি চাঁদোয়া টাঙানো থাকে। এটি আভিজাত্যের প্রতীক। জরিটরি দিয়ে অপূর্ব সে কাজ দেখার মত। সম্ভবত উড়িষ্যার পিপলি গ্রাম থেকে এই শিল্পটি এসেছে। উড়িষ্যাতে বলা হয় পিপলিকতা। এখন পুরুষ কিংবা মহিলাদের পোষাকেও এই কাজ দেখা যায়।
বলছিলাম প্রতিমার কথা…
বৈদিক যুগ থেকে আজকের মাতৃরূপে পৌঁছোতে লম্বা ইতিহাস ডিঙোতে হয়েছে বাংলার প্রতিমাশিল্পকে। যদিও থিম পুজোর যুগে মণ্ডপসজ্জার আকর্ষণই সব চেয়ে বেশি। তবু কথায় বলে ‘ঠাকুর দেখা’। প্রতিমাও একটা বড় ব্যাপার। সেই ঠাকুরের অভিনবত্বও যে একটা দেখবার জিনিস, তা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। যেমন, করোনাকালে ত্রিশূল হয়ে গিয়েছে ভ্যাকসিন দেওয়ার ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ, অসুর হয়েছে করোনাসুর। জনপ্রিয় হিন্দি ছবির ভিলেনের মত হয়ে ওঠে অসুরের মুখ। ছবির নায়িকার মুখ বসানো হয় দুর্গার অবয়বে। পারিবারিক পুজোয় বাড়ির আদরের ছেলেটির মুখ বসে কার্তিকের শরীরে। সে নিয়ে বাগবিতন্ডাও হয়। এই তো সেদিন অসুরের মুখে গান্ধীজীর মুখ বসিয়ে আতান্তরে পড়ল শহরের এক পুজোর কর্তৃপক্ষ। জনগণের চাপে বদলাতে বাধ্য হলো। এমনি কত কী! কখনও আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুখ বসে অসুরের শরীরে।
এখন দেবীমূর্তিতে শৈল্পিক দিকটি প্রাধান্য পায়। শাড়ি,গহনা, বিগ্রহ প্রভৃতির মধ্যে অনেকে মাতৃভাব খুঁজে পান না। মা মানে কস্তাপাড় শাড়ি পরে দুঃখী দুঃখী মুখ করে বা মোটা চোখে অসুর দমন করবেন, সন্তান সামলাবেন, মাতাল স্বামী সামলাবেন, তবেই না তিনি মা! যেমন, জিনস-টপ শোভিত দিদিমণিকে লোকে ভালো চোখে দেখে না। দিদিমণি সাদা শাড়ি আর ছেঁড়া চটি পরে চলাফেরা করবে দুঃখী দুঃখী মুখে। তবেই না তিনি শ্রদ্ধা পাবেন! তা নিন্দুকে যাই ভাবুক, মা দুর্গা কিন্তু একালে বেশ স্মার্ট, এখনকার স্মার্ট দিদিমণিদের মত।
এখন মূর্তি গড়ার মাধ্যম শুধু মাটি নয়, ফেলে দেওয়া, ছড়ানো ছিটানো কত কিছুর ব্যবহার করা হয়। পাটকাঠি, দেশলাইকাঠি, মাটির খুরি, কলকে, বাঁশ, বেত, কাঁচ, লোহা, ছেঁড়া কাপড়, ব্লেড, কাগজ, পাট সবই ব্যবহার করা হচ্ছে।
মণ্ডপ সজ্জাতে বা মণ্ডপের প্রবেশপথে আলোকসজ্জাতে সমকালীন বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে। কোথাও সাক্ষরতা অভিযান, কোথাও পরিবেশ দূষণ, কোথাও ধুমপানের কুফল, কোথাও লুপ্তপ্রায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, চা শ্রমিকের সমস্যা, কৃষকদের সমস্যা, নারীশক্তির উজ্জীবন, আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি, অস্বাভাবিক কিংবা ভালো কোনও ঘটনা ইত্যাদি বিষয় এনে পূজাকমিটি জনসচেতনতা প্রসারে সামিল হন। প্রতি বছর নতুন নতুন বিষয় দেখা যায়। হিতোপদেশের গল্পও স্থান পায়। মণ্ডসজ্জার কারিগরির দিকটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। মন্ডপ সাজাতে থার্মোকলের থালা বাটি, মাটির থালা বাটি গ্লাস, ছেঁড়া কাপড়, কাগজ, ঠোঙা, কলের গানের ডিস্ক, বাঁশ, পাটকাঠি এবং আরও কত কী যে ব্যবহার করা হয় তার ইয়ত্তা নেই। এক বছর বেহালার কোথায় যেন ফুচকার প্যাণ্ডেল হয়েছিল।
মণ্ডপ তৈরি হয় কোনও বিশেষ মন্দির বা ইতিহাসখ্যাত বিল্ডিংয়ের আদলে। সারা পৃথিবী থেকে বিখ্যাত সব থিম তুলে আনা হয়। ডিজনিল্যান্ড থেকে শুরু করে পর্ণকুটিরও বাদ যায় না। বেশ লাগে দেখতে! কত রকম উচ্চাঙ্গের ভাবনা! মণ্ডপ তৈরিতে সম্প্রতি থার্মোকল বা প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকছে পূজাকমিটি। মূলত পরিবেশ দূষণের কারণে। প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করা হচ্ছে। যেহেতু প্রাকৃতিক জিনিস সহজ-দাহ্য, তাই সহজে যাতে অগ্নিসংযোগ না ঘটে তার জন্য কেমিক্যাল স্প্রে করা হয়ে থাকে। আবার অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্হাও রাখা থাকে। এসব আধুনিক এবং নিরাপদ ভাবনা সেকালের পুজোয় দেখা যেত না। আমি খালি ভাবি…চারটিদিন পরে এসব বিসর্জন দিতে হবে!
ভাবতে অবাক লাগে, অবয়ব গড়ে দুর্গাপুজো বা অন্য মাতৃপুজো দীর্ঘকাল চলে এলেও অতিপ্রাচীনকালে প্রতিমা জিনিসটাই ভূভারতে ছিল না। বৈদিক যুগে মূর্তিপুজোর রেওয়াজ ছিল না একেবারেই। কেবল যজ্ঞের শেষে পূর্ণাহূতি দেওয়ার পর ধ্যান করার নিয়ম ছিল। বৈদিক যুগে দেব-দেবীদের মন্দিরও ছিল না। শাস্ত্র মতে, দুর্গা, কালী, তারা, কমলা, জগদ্ধাত্রী সকলেই ছিলেন ধ্যানের দেবতা। তারা একই মহামায়ার বিভিন্ন রূপ। তন্ত্রতে স্পষ্ট করে বলা আছে, মা হলেন শতরূপা। জগতে যত সাধক, মায়ের রূপও তত রকমের। এই কারণেই ভারতবর্ষের কোনও প্রাচীন মন্দিরে দেবতার রূপবিগ্রহ মেলে না। বিগ্রহের পরিবর্তে সেখানে আছে পাথরখণ্ড। যেমন, কাশীর অন্নপূর্ণা আসলে একখণ্ড পাথর মাত্র। সেই পাথরের মাথায় বসানো আছে সোনার মুখ। আর আছে দুই পাশে দুইখানা সোনার হাত। বৈষ্ণোদেবীতেও তাই। তাহলে পূর্ণাঙ্গ মূর্তিপুজো কীভাবে শুরু হল তবে?
ইতিহাস বলছে …মূর্তি পূজার প্রবর্তক হলেন বৌদ্ধরা। প্রতিমাশিল্পের সূচনাও হয় ওই বৌদ্ধ আমলেই। তবে আধুনিক যে প্রতিমাশিল্প, তার জন্ম কিন্তু মাত্র ৮০০ বছর আগে। নেপথ্যে ছিলেন রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায়। তিনিই প্রথম মায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন। এর পর ভাদুড়িয়ার মহারাজা জগৎনারায়ণ রায় ঘটা করে দুর্গাপুজো করেন। সেকালে পুজোর আয়োজনে নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন তিনি। তবে কিনা জগৎনারায়ণের পুজো ছিল বাসন্তীপুজো।
পরবর্তীতে যে সময়টাকে শ্রীচৈতন্য সেবকদের অভ্যুদয়কাল বলা হয়, সেই সময় বাংলায় মাটির প্রতিমা গড়ে পুজোর প্রচলন হয়। ব্যাপক আকারে তা বিস্তার লাভও করে।
এর পরবর্তী কাহিনি অবশ্য বেশিদিন আগের কথা না।
গনেশের পাশে যে কলাবউ থাকে, সেটি গনেশের বউ না। যদিও আমরা তাকে গনেশের বউ বলে থাকি। এটি নবপত্রিকা। ন-টি পাতার কথা বলা হলেও আসলে ন-টি গাছকে শাড়ি পরানো হয়। সপ্তমীর ভোরে (কোথাও ষষ্ঠীর দিন) এই কলাবউ বা নবপত্রিকাকে গঙ্গায় বা প্রতিষ্ঠা করা পুকুরে স্নান করিয়ে মণ্ডপে আনা হয়, দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে পূজা আরম্ভ হয়। যেখানে গঙ্গা নেই, সেখানে প্রতিষ্ঠা করা পুকুর বা দিঘিতে নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়। ন-টি গাছ হলো..
“রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ।
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।।”
অর্থাৎ, কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান।
সব গাছ বোঝা গেলেও জয়ন্তীকে ঠিক বোঝা গেল না। এটি বিলুপ্তপ্রায় একটি গাছ। সাধারণত নদীর ধারে বনেবাদাড়ে জন্মে। তেঁতুলপাতার মত পাতা, তবে আকারে একটু বড়। ভেসজগুণ সমৃদ্ধ। কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ব্যথায় পাতার কাথের লেপন উপশম করে। হলুদ ফুল হয়।
দুর্গাপুজোর জন্য বেনের দোকানে শুকনো ডাল পাওয়া যায়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে কী গাছ।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। স্ত্রীরূপের জন্য দু-টি বেল দিয়ে করা হয় স্তনযুগল। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে গনেশের পাশে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়।
পুজোর নিয়ম দুই কালে সমান হলেও একালে পূর্বের মত তেমন নিষ্ঠা দেখা যায় না বলেই মনে হয়। গতির যুগে সবাই ছুটছে। চাইলেও কর্মকর্তাদের ঠেলায় পুরোহিত শঠেশাঠ্যং করতে বাধ্য। নইলে সামনের বছর ডাক পাওয়া যাবে না। আমি অঞ্জলি দিইনি কখনও বা পুজোর সময় মণ্ডপের ধারে কাছে থাকিনি। দূর থেকে মানুষ দেখি কেবল।
অষ্টমীর দিন সাজগোজ করে যুবকযুবতীদের অঞ্জলি দেবার ঘটা দেখার মত। মায়ের সমুখে অঞ্জলি দেবারচে সেলফি তোলার ঘটা খুব। সেকালে বাবামায়ের কড়া নিষেধের চোটে যুবকযুবতীদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ ছিল না, মোবাইল ফোনও ছিল না। এখন বাবামায়েরা সেই নিগড় থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁরা নিজেরা মনের অবদমিত ইচ্ছে পূরণ করেন, ছেলেমেয়েদেরও ঢালাও স্বাধীনতা দেন। এটা খারাপ কী ভালো তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে সকলের অবাধ হুল্লোড়ে আমারও মিশে যেতে ভালো লাগে। সকলের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পারলে আর উৎসব কী!
একালে ফেসবুকের কল্যানে নিজের সাজগোজ দূরদূরান্তে থাকা সবাইকে দেখাতে পারি সবাই। নিজেকে মেলে ধরার একটা জায়গা চাই তো। আমি এত সুন্দর করে সাজলুম, প্রিয়জন যদি না দেখল, না প্রশংসা করল, তবে সাজটাই তো বৃথা গেল। ফেসবুকের জন্য পৃথিবীর শেষপ্রান্তে থাকা স্বজনও আমাকে দেখছে। এ তো সেকালে কেউ ভাবতেই পারত না। সেকালে জাঙ্কজুয়েলারি ছিল না। একালে কত রকমের পোষাক, কত রকমের ব্যাগ, জাঙ্কজুয়েলারি! সেকালে ছিল..
“আপ রুচি খানা
পর রুচি পরনা।”
একালের শ্লোগান হলো..
“আপ রুচি খানা
আপ রুচি প্যাহেনা।” যা ইচ্ছে পরব, তুমি বলার কে হে! দেখতে ইচ্ছে না হলে দেখো না।
একালে বাড়ির মহিলারা শুধু যে ঘর সামলায় তা নয়। জাঙ্কজুয়েলারির গয়না তৈরি করে কিছু উপার্জন করতে পারছে নিজের হাতখরচের জন্য। কেউ নিজস্ব বুটিক করেছে। নিজের আঁকাজোকা দিয়ে শাড়ি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি তৈরি করছে। বিক্রি করছে নিজেরা। পুজোর সময় তাদের হাতে বেশ কিছু টাকা আসছে। সেকালে এটা কেউ ভাবতেই পারত না। সেকালে মহিলারা পরনির্ভরশীল ছিল। একালে তারা স্বাবলম্বী। অবশ্য সরকারও ঠুঁটো জগন্নাথ করতে মহিলাদের ভাণ্ডারে শান্তির জল ছিটোচ্ছে।
পোষাকের ক্ষেত্রে পৃথিবীজুড়ে যে বিপ্লব এসেছে, পুজোয় তার চূড়ান্ত রূপ দেখি। তবে আমাদের মত বুড়োবুড়িদের চোখে সবটাই যে শোভনসুন্দর তা নয়। আমার ব্যক্তিগত মত হলো..পোষাক হবে আরামপ্রদ, শোভনসুন্দর, রুচিশীল। তবে এসব ক্ষেত্রে বুড়োবুড়িদের কেই বা কবে মান্যতা দিয়েছে!
সেকালে পুজোয় একটি পোষাকই যথেষ্ট ছিল। একালে গৃহস্থের হাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ থাকায় অনেক জামাকাপড় কেনা যায়। সকাল বিকেল সাজ বদল হয়। এটা বেশ লাগে!
সেকালে পুজোতে গৃহিনীরা সারাদিন হেঁশেলে ব্যস্ত থেকে প্রচুর খাবার বানাতেন। শহরমুখী আত্মীয়পরিজন ঠাঁই পেতেন শহরের আত্মীয় বাড়িতে। সারাদিন রান্নার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রান্না ছিল। একালের গৃহিনীরা পারতপক্ষে পুজোতে হেঁশেলমুখী হন না। জোমেটো, টমেটো, কলাপাতা ইত্যাদিতে একটি ফোন করে দিলেই পছন্দমত খাবার হাজির। শুধু একটি ফোন।
এখন আত্মীয়স্বজন বড় একটা আসাযাওয়া করেন না। গ্রামেগঞ্জেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আমাদের ছোটবেলা গ্রামে ইলেকট্রিকের আলো ছিল না। গ্রাম অন্ধকারে ডুবে থাকলেও পুজোমণ্ডপে হ্যাচাক জ্বলত সারারাত। এখন গ্রামগঞ্জও পুজোতে আলোয় সেজে ওঠে।
সেকালে পুজোয় দুটি কী তিনটি শারদীয় পুজোসংখ্যা প্রকাশিত হতো। একালে রাশি রাশি পুজোসংখ্যা প্রকাশিত হয়। শিল্পচর্চা সাহিত্যচর্চা হয়। এটা বেশ লাগে।
সেকালে পুজোর বেশ আগে “পুজোর গান” বলে গানের বই প্রকাশিত হতো। পরে কলের গানের বড়বড় কালো রেকর্ড বাজারে আসত। গানগুলি আগেই মুখস্ত হয়ে যেত। আকাশবাণীর অনুরোধের আসরে রোজই বাজানো হতো সেসব। আমরা শুনে শুনে গানের সুর গলায় তুলে নিতাম। একালে তো গান শোনার জন্য অনেক মাধ্যম বেরিয়ে গেছে। আকাশবাণীর দিন চলে গেছে। ভোরে উঠে মহালয়া শোনার গল্প অনেকদিনই নেই। এখন ইউ টিউবে সবই সুলভ। যখন তখন শোনা যায়। ভোরে উঠতে হয় না। পুজোর গানটা বেশ মিস করি আজও।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল পুজোয় পশুবলির কথা। শাস্ত্রে অন্তরের পাশব প্রবৃত্তিকে বলি দেবার কথা বলা আছে। পূর্ব ভারতের আসাম, ওড়িশা, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ এবং
নেপালে পশুবলি দেওয়া হয়। ছাগল, মুরগি, পায়রা এবং পুরুষ মহিষ বলি দেয়া হয়। বেদে কিন্তু বলি নিষিদ্ধ। এখন দুর্গাপুজোতে চালকুমড়ো, আখ, শশা বলি দেয়া হয় নিয়ম রক্ষার্থে। কোথাও কোথাও ছাগবলি দেয়া হয় এখনও।
আমাদের বাংলায় যখন দুর্গাপুজো চলছে, তখন ভারতের কোথাও কোথাও নবরাত্রি এবং দশেরা উৎসব পালিত হয়। বাংলাতেও অন্যরকম এক পুজো হয়। সবই অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভশক্তির উদ্বোধনের জন্য।
সেই অন্যরকম এক পুজোর কথা বলি…
চারদিকে যখন অসুরদলনী দেবী দুর্গার বন্দনায় মুখর গোটা বাংলা, তখন অসুর বন্দনায় মেতে উঠেছে বর্ধমানের আদিবাসী সমাজ! আদিবাসী সমাজে মহিষাসুর হল তাদের রাজা হুদুড় দুর্গা। তাই হুদুড় দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করে আজও প্রথা মেনে হয় দাঁসাই নাচ। ষষ্ঠীর দিনই উদ্বোধন।
‘হুদুড় দুর্গা’-র শোকে মগ্ন শালবনীর কেন্দাশোল গ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। রাঢ়বঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় পুজোর কদিন স্মরণ করা হয় হুদুড় দুর্গা বা মহিষাসুরকে। সপ্তমীর সকাল থেকে দশমী পর্যন্ত হুদুড় দুর্গার সামনে চলে ‘দাঁসাই’ ও ‘ভুয়াং’ নাচ। সাঁওতালি লোকসাহিত্য অনুযায়ী ‘হুদুর’ বা ‘হুদুড়’ কথার অর্থ প্রচণ্ড জোরে বয়ে চলা বাতাস কিংবা ঝড়।
আদিবাসী সমাজ বিশ্বাস করে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধের পর নিখোঁজ হয়ে যান অনার্য জাতির রাজা হুদুড় দুর্গা। তাই দুর্গাপুজোর এই চারদিন ধরে দাঁসাই নাচের মধ্যে দিয়ে খুঁজে বেড়ানো হয় সেই রাজাকে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস তিনি এখনও বেঁচে আছেন, কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন। আর তাঁকে খুঁজে পেতেই সেখানে পুরুষেরা মহিলার বেশে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে তাদের প্রিয় রাজা হুদুড় দুর্গাকে খুঁজে বেড়ায়। আর দাঁসাই নাচের মধ্য দিয়ে হুদুড় দুর্গার প্রতি শোক জ্ঞাপন করে তারা। এই নাচের সঙ্গে প্রতিটি গানের শুরুতেই ‘হায়রে হায়রে’ বলে শোক জ্ঞাপন করা হয়। বলা যায় সাঁওতাল ও কুর্মি সম্প্রদায়ের দাঁসাই নাচ জঙ্গলমহলে প্রতিটি মণ্ডপে তাদের সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ।
অনেকেই মনে করেন, হুদুড় দুর্গা হল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা এবং তাঁকেই হিন্দুধর্মে মহিষাসুর হিসাবে দেখানো হয়েছে। একসময়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে সেকালে দেবী দুর্গার মুখ দেখাও নিষিদ্ধ ছিল। বর্তমানে অবশ্য সেই বিধিনিষেধ অনেকটাই শিথিল হয়েছে। ‘আদিবাসীরা কেউই দুর্গার পুজো করে না। করতে পারে না। তারা মহিষাসুরকেই তাদের দেবতা হিসাবে দেখে। তাই একালে কেউ কেউ গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানোর মত দুর্গাপুজোয় জড়িত হলেও মনেপ্রাণে জড়ায় না।
আদিবাসী সংস্কৃতির অন্যতম দাঁসাই নাচ ও হুদুড় দুর্গা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে সকলেই একালে তৎপর হয়েছে। এটা বেশ ভালো।
আসি বিজয়া দশমীতে। আমাদের সাধনা “দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতার সাধনা।” যার জন্য কৃষ্ণ অনায়াসে হয়ে ওঠেন গোপাল। আমাদের আঙিনায় হামাগুড়ি দেন এই ননীচোরা। মহিষাসুরমর্দিনী, দনুজদলনী সিংহবাহিনী দুর্গা হয়ে ওঠেন আমাদের ঘরের মেয়ে। চারটি দিনের জন্য তিনি বাপের ঘরে আসেন পুত্রকন্যাসহ। নবমীনিশি থেকে মা মেনকার মন ব্যাকুল হয়…
“ওরে ও নবমী নিশি, না হইও রে অবসান
তুমি অস্তে গেলে নিশি, অস্তে যাবে উমাশশী
হিমালয় আঁধার করে।”
তবু নবমীর নিশাবসানে মহাদেব উপস্থিত হন
“বিছায়ে বাঘের ছাল
দ্বারে বসে মহাকাল
বেরোও গনেশমাতা
হাঁকে বার বার।” এ হল কবির কথা।
সেকালে দশমীতে ভাসানের আগে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দিতেন জমিদারগণ। কিন্তু কেন?
শিবের আর এক নাম নীলকণ্ঠ। নীল বর্ণের জন্য নীলকণ্ঠ পাখিকে শিবের দোসর বলে মনে করা হয়। নীলকণ্ঠ পাখি আগে কৈলাসে গিয়ে মহাদেবকে পার্বতীর আগমন বার্তা দেবে বলে মনে করা হয়। বিষয়টি কী আধুনিক না? স্ত্রী বাপের বাড়িতে গেলে বিবাহিত পুরুষরা ঘর দোরের অবস্থা যা করে রাখে তা আর কহতব্য নয়। খালি বোতল ঘরের মেঝেতে গড়ায়, জামাকাপড় বিছানা সব এলোমেলো। নীলকণ্ঠ বন্ধুর মতই মহাদেবকে রক্ষা করে।
বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনে এখন আর ওটি করা হয় না। দু এক জায়গায় লুকিয়েচুরিয়ে হয়তো হয়।
ভাসানের আগে দুর্গাসহ সব দেবদেবীকে এবং তাঁদের বাহনকে বরণ করার রেওয়াজ আছে। পান দিয়ে মুখ মুছিয়ে সন্দেশ ঠুসে দেয়া হয় সকলের মুখে। তবে সিংহের মুখে যখন সন্দেশ দেয়া হয়, তখন কী যে অস্বস্তি হয় কী বলব! বেচারা কদিন অভুক্ত থেকে প্যাণ্ডেলে চার পা ছরকুটে মাকে পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে লোকের মনোরঞ্জন করে শেষে কিনা মাংসের বদলে সন্দেশ! নেহাত মাটির সিংহ!
তারপর সিঁদুরখেলা। অবিবাহিত এবং সধবা মহিলারা প্রতিমা বরণ এবং সিঁদুর খেলার জন্য লাইসেন্স প্রাপ্ত। বিধবা এবং পুরুষ সেখানে ব্রাত্য। সেও দোলখেলার মত উৎসব। বাংলায় মেয়েদের এ এক বিশেষ অনুষ্ঠান। দেবীকে সিঁদুর দানের পাশাপাশি একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেওয়ার রীতি। শুধু সিঁথিতেই নয়, গালে, কপালে, হাতে সর্বত্র সিঁদুর লেপে দেওয়া যেন আর শুধুই ধর্মীয় আচার নয়, সামাজিক পরব। নাকে সিঁদুর মেখে ফেসবুকে ছবি পোস্টানোর ঘটা দেখার মত। দূর থেকে উপভোগ করি আমি। সামিল হইনি কখনও।
তারপর নদীতে ঠাকুর বিসর্জনের পালা। সেও এক এলাহী কাণ্ড। শোভাযাত্রার জন্য ব্যান্ডপার্টি, তাসা, ইংলিশ বাজনা ইত্যাদি ভাড়া করা হয়। ডায়নামো, না না জেনারেটর দিয়ে সাইকেল ভ্যান ভাড়া করে, আলোর দেখনদারি নিয়ে, মাইকে হাঁকতে হাঁকতে, পাড়া জানিয়ে মিউজিক বাজিয়ে শোভাযাত্রা পথ পরিক্রমা শেষে নদীর ঘাটে যায়। রাস্তায় বাজি পোড়ে, পাড়ার যুবক মাতালের মত নাচে, কোথাও সত্যি মাতালকে দেখা যায়। যুবকেরা কতরকম নাচের কেরামতি দেখায়। মেয়েরাও এখন রাস্তায় নাচে। ধীরে ধীরে শোভাযাত্রা নদীর নির্দিষ্ট ঘাটের দিকে এগোতে থাকে। আজকাল আবার দশমীতে ঠাকুর বিসর্জন হয় না। মাকে যতদিন কাছে রাখা যায় আরকি!
এই বিষয়টি সেকালে দেখা যেত না। বিসর্জনে এত ঘটাপটা আড়ম্বর ছিল না তখন। দশমীর দিনই প্রতিমা বিসর্জন হতো। নেহাত বৃহস্পতিবার দশমী পড়লে পরেরদিন বিসর্জন।
এরপর বিজয়ার প্রণাম আর কোলাকুলি। গ্রামে এসব ছিল না। নাড়ু সন্দেশের গল্প নেই, প্রণামও নেই।
শহরে এসে প্রথম প্লেটে দুটি নাড়ু আর তার পাশে একমুঠো কুচো নিমকি পাই। অমৃত লেগেছিল নিমকি। পরে একটু উন্নত হয় বিজয়ার আপ্যায়ণ। কোথাও মিহিদানা, সীতাভোগ, ঘুগনি পাওয়া যেত।
একালে বিরিয়ানি পোলাও, আরও আরও সব নামীদামী খাবার পাওয়া যায় প্রণাম শেষে।
বিজয়া সম্মেলনীতে নাচ গান হয় জোর কদমে। সবই বেশ বেশি বেশি।
যেতে গিয়ে আবার একটু বলি…দশমীর দিনে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়কে শ্রদ্ধা জানাতে “বিজয়া” বলা হয়। এখানে দেবী দুর্গার অসুর বিনাশিনী শক্তিকেই স্বাগত জানানো হয়।
শরৎকালে সীতা উদ্ধারের জন্য শ্রীরামচন্দ্র অকালবোধন করে দেবীর পুজো করেছিলেন। দেবীর আশীর্বাদে রাবণকে নিহত করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। তাই প্রচলিত প্রথা অনুসারে “বিজয়া” শ্রীরামচন্দ্রের বিজয়ের দিন। বিজয় উৎসব থেকেই “বিজয়া” কথাটি এসেছে।