বই আলোচনা: শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড

বই আলোচনা:
এ কে এম আহ্দুল্লাহ’র কাব্যগ্রন্থ—
‘শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড’
আলোচনা:
-মামুন সুলতান
কল্পনার আশ্চর্য আল্পনায় আঁকা ‘শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড’
‘সচেতনা’, ‘মাটির মাচায় দণ্ডিত প্রজাপতি’, ‘যে শহরে হারিয়ে ফেলেছি করোটি’, ‘ইমেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ’ ইত্যাদি কবি এ কে এম আব্দুল্লাহর প্রকাশিত কবিতার বই। সর্বশেষ সংযোজন ‘শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড’ কাব্যগ্রন্থ। এ-গ্রন্থটি অনার্য পাবলিকেশন্স লি. থেকে ২০২২ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি হযরত আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কে উৎসর্গ করা হয়েছে।
প্রকাশক এ-গ্রন্থের ফ্ল্যাপবক্সে মন্তব্য করেছেন- “তিনি কবিতা লেখেন না। নতুন স্বাদ আর নিজস্ব প্যাটার্নে কবিতা সৃষ্টি করেন। সহজ শব্দে আমাদের জীবনকে তুলে আনেন গভীর অনুভূতির ছোঁয়ায়, কবিতার প্রতিটি পংঙতিতে। তিনি বিগত দশকগুলোতে আটকে থাকেননি। তাঁর কবিতায় ধরা পড়ে আগামি দশকের কথা। শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড’ শিরোনাম থেকেই বুঝা যায়, কীভাবে তিনি মানবসৃষ্টিকে ভেতর থেকে দেখেন। তাঁর কবিতায় শব্দের খেলায় ফুটে ওঠে প্রেম, হাহাকার, এবং মানুষের জীবনের হুবহু চরিত্র; যা আজকাল কবিতায় তেমন পাওয়া যায় না। গতানুগতিক ধারার বাইরে লেখেন নিজস্ব ধারায়। যা ইতোমধ্যে পাঠক সমাজে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। টেকনোলজির এই যুগে, তাঁর কবিতার পরতে পরতে পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে আধুনিক কবিতার প্রস্ফুটিত সৌন্দর্য।”’ সত্যিই কি তাই? প্রকাশক তাঁর মন্তব্যে অনেক কথাই বলে গেছেন। কবিতায় নতুনত্ব আছে। নিজস্ব প্যাটার্ন সৃষ্টি করেছেন। সহজ শব্দে কবিতা রচনা করেছেন। গভীর অনুভূতিতে জীবনকে তুলে এনেছেন। বিগত দশকের অনুসরণ অনুকরণ না করে আগামি দশকের কথা তুলে এনেছেন। তাঁর কবিতায় প্রেম, হাহাকার আছে। এই বিষয়গুলো কতটুকু সত্য বা তা আদৌ সত্য কি না আলোচনা ফাঁকে তা প্রমাণের চেষ্টা থাকবে।
৮৮ পৃষ্ঠার বৃহৎ একটি কবিতার বই ‘শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড’। এখানে ৭৬টি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রতিটি কবিতা নিয়ে এখানে আলোচনা করা কঠিন হবে। একজন পাঠক হিসেবে মুগ্ধ হওয়া কবিতাগুলো নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা থাকবে।
‘ইমেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ’ গ্রন্থের মতই এ-গ্রন্থের কবিতাগুলোতে উপমা হিশেবে কবি টেকনোলজিক্যাল শব্দ ব্যবহার করেছেন। ইংরেজি পারিভাষিক শব্দের প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়। তবে এই শব্দগুলো অপরিচিত কোনও শব্দ নয়। মানুষের ব্যবহার্য শব্দগুলোকে তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন। “ হয়তো মহামারি সময়ের মতো নিজের ভেতর নিজেই লুকোবো। আর বায়োস্কোপের অধুনা নেশায় হবে মৃত্যু। আমি সে মৃত্যুর কথা বলছি না। যে মৃত্যুর পর চোখের দুর্লভ আলো ভেঙে টাইমলাইন ভরে উঠে মাতমের শো’ডাউনে। যে মৃত্যুর পর অরণ্য ভরতি মানুষ –কপি পেস্টের প্রার্থনায় মেতে উঠে আঙুলের ডগায়।” (একটি স্ট্রেইটলাইন অথবা দৃশ্যের গল্প) এখানে বায়োস্কোপ, টাইমলাইন, শো’ডাউন, কপিপেস্ট ইত্যাদি ইংরেজির পরিভাষার পাশাপাশি প্রমিত বাংলা শব্দের সংমিশ্রণ নতুনই বটে। এ-কয়টি লাইনে যে মর্মবিদারী বিষয় ফুটে উঠেছে তা মোটেও অকাব্যিক নয়। বরং সংবেদনশীল হৃদয়কে দীর্ণ করার ক্ষমতা রাখে।
কবি এ কে এম আব্দুল্লাহর কবিতার নামকরণ নবসৃষ্টির নবীন উল্লাস। প্যারালাইজড ক্যানভাস ও ক্ল্যাসিক্যাল দৃষ্টি, ডাইনিং টেবিল কানেকশন, পেটিকোটলেনে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া, সেফটিফিনে আমাদের একটি স্লিভলেস গল্প, স্ক্যানিং কাউন্টার ও আমরা, একটি দীর্ঘপথের স্ক্রিপ্ট, ক্যাটওয়াক খুশবু, ক্যাটওয়াক স্টেজ, মাস্ক পরা চাঁদের গল্প, পিংক স্যামন, ভেরিফোক্যাল জীবন, জেনেটিক ট্যাগস, পলিটিক্যাল ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসের আত্মকাহিনি, বাবা অধ্যায় অথবা কম্বাইন্ড আঙুল, হাইকমান্ড সময়, রিংটোন জেনারেশন, সিস্টমের জীর্ণ সাঁকো, দীর্ঘরাতের স্ক্যাচ, ক্যাপসুল জীবন, সিজন্যাল আকাশ ও আমাদের গল্প, ম্যাচ অব দ্যা ইয়ার ও আমি, একটি আনরিচ্যাবল ডেস্টিনেশন, কি-বোর্ডে মৃত্যুর মার্কেটিং শেষে প্রভৃতি শিরোনাম সত্যিই অত্যাশ্চার্য। ইংরেজি শব্দগুলো যেন বাংলাশব্দের আত্মীয় হয়ে বসবাস করছে। দ্বিভাষিক দুর্বোধ্যতা কোথাও নেই। অন্তরের অব্যক্ত কথাগুলো সাবলীলকণ্ঠে যেন বলা যায়। অবলীলায় উচ্চারণ করা যায় মনের রঙিন বেদনা। আশ্চর্য চেতনা।
‘সেফটিপিনে আমাদের একটি স্লিভলেস গল্প’ কবিতায় কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ক্লাসমেটের আড্ডায় কবির চোখের সামনে নেমে আসে প্রতিটি সূর্যাস্তের একেকটি অধ্যায়। আড্ডায় হাত থেকে ফসকে পড়ে রোমন্টিক বিকেল। আঙুল থেকে বেয়ে নামে ছায়াময় নদি। সাঁতার শেখে অলিম্পিক মেডেল নিয়ে আসে এন্ড্রয়েড সংসার। গানগুলো হয়ে যায় হাইডপার্ক কনসার্ট। টিফিনের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে ওঠে হারিস মিয়ার ঘণ্টা। কমনরুম হাতে নিয়ে বিকেলের রাস্তা ভেঙে হেঁটে যায় মানিকের মা। কবি এভাবে শৈশবের কথাগুলোকে রূপকাশ্রয়ে জীবন্ত করে তুলেছেন। হারিস মিয়ার ঘণ্টা আর মানিকের মা কমনরুম হাতে নিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া চিত্র চোখের সামনে প্রাণজ হয়ে ওঠে। এটা কবির কাব্যিক শক্তি। কল্পনার আশ্চর্য আল্পনা।
“এসব দৃশ্য আজকাল ডাবলডেকার বাসে বসে স্ক্যানিং করে নিয়ে গেলে
ড্রোনশিকারী- আমরা জেগে ওঠি। আর আমাদের চোখের সম্মুখে অতি
স্লোমোশনে ডিসপ্লে হতে থাকে প্রেগন্যান্ট মধ্যরাত।” (যুগল সেলেব্রেটির গল্প)
‘প্রেগন্যান্ট মধ্যরাত’ এই শব্দযুগল অন্যরকম এক কাব্যিক মাদকতা এনে দেয়। শব্দের ব্যঞ্জনায় আটকে যায় পাঠকের চোখ। ভাবনায় এঁকে চলে কবির আশ্চর্য কবি-সত্তার আচানক শক্তিমত্ততা।
বাজেয়াপ্ত অরণ্যে খিল এঁটে কেউ হাতের আঙুলে তুলে দেয় চোখে গভীর অন্ধকার। মূলত মানুষ একদিন গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। বৃক্ষ থেকে যেভাবে রাস্তায় পড়ে থাকে বৃন্তচ্যুত পাতা ঠিক তেমনি ভাবে একদিন পৃথিবী নামক বৃক্ষ থেকে মানুষও ঝরে যায়। তখন কেবল বেঁচে থাকে স্মৃতি। পাঁজরভাঙা রক্ত একদিন শুকিয়ে যায়। মুছে যায় দীর্ঘচুম্বনের দাগ। ইচ্ছেমত সাজানো নির্মিত বাড়িটিও আত্মহত্যার ভঙিতে ঝুলে যায় বরই গাছের বড় ডালে। কেবল চারপাশে জ¦লজ¦ল করে স্বনির্বাচিত শিশুসমগ্র ও বাপদাদার কিছু ঘষামাজা ফোটেজ। অতঃপর কবি বলেন-
“এখন সন্ধ্যাসভ্যতায় যখন জ্বলে ওঠে বিগত ছায়ার ফোটেজ। ইলেকট্রিকের কুকারে লাফিয়ে ওঠে চাঁদের ভাঙা টুকরো। আর যে পথে আমি হারিয়ে গিয়েছি একদিন আমার পায়ের ছাপ মাড়িয়ে সে পথে চাঁদের টুকরোগুলোও হারিয়ে যেতে থাকে।” (সন্ধ্যা সভ্যতায় ছায়া ফোটেজ)
কবি এ-কবিতায় মানুষের অস্তিত্বের ক্ষীয়মান ক্ষণস্থায়ী জীবনের দীর্ঘশ্বাস কবির নিজস্ব ভাষাভঙি ও ভাবভঙি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘বাঁচার কপিরাইট’ কবিতায় কেবল একটি বাক্যের ভেতরে কী নিপুণ হাতে নির্মাণ করেছেন দেশের মোহাচ্ছন্ন মানুষের অবিকল চিত্র। ‘আর আমরা চুরি করে টাকা ভরে রাখি বালিশের ভেতর।’- এই চরণটি একটি সময়কে ধারণ করেছে। বালিশতত্ত্ব বাংলাদেশের একটি আলোচিত ঘটনা। সেই নির্লজ্জ তত্ত্বকে কবি কবিতায় সুনিপুণ দক্ষতায় প্রতিস্থাপন করেছেন। কোনও রাখঢাক নেই। স্বাভাবিক কথার ছলে অরঙিন লগ্নতায় অসাধারণভাবে প্রকাশ করেছেন। সেই ব্যক্তিরা আবার দূরদেশে পাড়ি জমায়। বধুবেশে বাঁচার প্রবোধ খোঁজে।
‘কারফিউ সময়ের শান দেয়া উপসর্গ’ কবিতায় কবি মানবতাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। মনে বড় জ্বালা নিয়ে কবি আগুনের অক্ষর সাজান। কিরণমালার প্রত্যাশায় বৃষ্টিতে ভেজেন। আবার জুলেখা গ্রিনরুমে চাকু হাতে অপেক্ষা করছে। জুলেখার হাতে চাকু কেন? ‘চাকু’ শব্দে জুলেখাদের বর্তমান অবস্থার জানান দেওয়া হয়েছে। নারী তার নিরাপত্তার জন্য আত্মরক্ষার জন্যই কবি এই চাকু শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আবার কবি সূরা ইউসুফ পাঠ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিপদমুক্তির জন্য এ-সূরা পাঠ করা হয়। আর এ সূরা পাঠের মাধ্যমে মানুষ যেন চরিত্রবান হয়। এ-কবিতায় জুলেখা এবং সূরা ইউসুফ ব্যবহার করার সাথে সাথে বর্তমান বিশে^ মানবজাতির সামগ্রিক চরিত্রকে প্রকাশ করা হয়েছে। মানুষ যে চরিত্রগতভাবে কত বিপদে আছে তারই একটি কাব্যপাঠ পাওয়া গেল। আর মানুষ মানবতার জন্য অপেক্ষা করতে করতে চামড়ায় ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে। আসুন কবি কবিতায় কী বলেছেন- শুনি-
“এখন আসুন আমরা ফেইসবুকে সূরা ইউসুফ পাঠ করি। আর চরিত্রবান হই। আর বাণিজ্যফটকের পাহাদার হই। সেলফির ফাঁকফোকর ভেঙে মানবতার পিঠ দেখতে দেখতে চামড়ায় ভাঁজ পড়–ক। আমাদের চামড়া ঝুলে যাক।”(‘কারফিউ সময়ের শান দেয়া উপসর্গ’)
মানবতা এখন আর বুক টান টান করে সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে না বরং পিঠ দেখাতে দেখাতে মানব সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তবুও কবি শোনাচ্ছেন আশার বাণী-
“এরপর সময়ের মধ্যাহ্ন ভেঙে দাঁড়াবো মানিক মিয়া অ্যাভিন্যু’র বিবস্ত্র বুকে। আর ‘বসট্রেড’ চশমা পরে- ভুলে যাবো পিছনের গল্প।’ (‘কারফিউ সময়ের শান দেয়া উপসর্গ’)
‘ভুলে যাবো পিছনের গল্প’ বলে কবি আশার আলো দেখানোর চেষ্টা করছেন।
‘বাবা অধ্যায় অথবা কম্বাইন্ড আঙুল’ কবিতায় একটি একান্নবতী পরিবারে একজন বাবা একটি সংসারে কত বড় ভূমিকা রাখেন এবং সেই পরিবারের সদস্যরা যাপিত জীবনে সুখ আনার জন্য ‘কম্বাইন্ড আঙুল’ থেকে কীভাবে ছিন্ন হয়ে পড়েন তারই কাব্যিক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘কমলারঙের ব্যাগ’ ভরা থাকে বাবার দায়-দায়িত্ব। সেই ব্যাগে ভরে সংসারের জন্য নিয়ে আসেন সবুজবিপনি, কাজিরবাজার থেকে সাংসারিক তৈজসপত্র। সাথে সন্তানদের খেলার সামগ্রী। বাবার বুকের মায়া আঙুল বেয়ে নেমে আসে পুত্রের আঙুলে। এভাবে পরিবারের মায়া মমতা আদর যতœ দায়-দায়িত্ব কম্বাইন্ড হয়। একসময়-
“এক অপূর্ণ রাতের ভাঁজে আমি স্টেশনের টিকেট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি। আর আমার শর্টসাইটেট ল্যান্স ভেঙে কেউ উঁকি দেয় গেইটের অদূরে- হাতে নিয়ে নতুন বুকমার্ক। ধীরে ধীরে আমার পুরানো হাত থেকে আলগা হতে থাকে কম্বাইন্ড আঙুল।” (বাবা অধ্যায় অথবা কম্বাইন্ড আঙুল’)
এখানে স্টেশন, টিকেট, কাউন্টার ইত্যাদি শব্দ দিয়ে সংসারত্যাগী বা পরিবারবিদায়ী অথবা ছিন্ন হওয়ার আবেগ বোঝানো হয়েছে। যে আঙুলগুলো একত্রে থাকতো সেই কম্বাইন্ড আঙুল থেকে একে একে আঙুলগুলো আলগা হয়ে যায়। আর এভাবে বাংলাদেশের পরিবারগুলো ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র হয়ে যায়।
কবি এ কে এম আব্দুল্লাহর কবিতায় হতাশাও প্রকাশ পেয়েছে আশা-নিরাশার দোলাচালে। কবির হৃদয়তন্ত্রীতে বেজে উঠেছে হাহাকারের বীণা। সামাজিক অবক্ষয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবিকতার বিকলাঙ্গতা, প্রেম-অপ্রেমের জ¦ালা, নগ্ন সংস্কৃতির বিষবাষ্পে কবি হতাশাগ্রস্থ। তাই তো কবি বলতে পেরেছেন-‘ সেই কবে আমাদের আকাশ থেকে হারিয়ে গেছে বিশুদ্ধ বাতাস। সেই কবে আমাদের অরণ্য থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সবুজ চিৎকার।’ (বুকে পোষি মধ্যরাতের বুদবুদ।)
‘শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড’ গ্রন্থের কবিতাগুলো মূলত করোনাকালীন সময়ে কিংবা এর আগ-পিছ সময়ে লেখা হয়েছে। তাই এ-গ্রন্থে বারোটি কবিতা আছে করোনাকাল-২০২১ নিজস্ব চিরকুট অথবা রোজনামচা- শিরোনামে। লকডাউন শিরোনামেও একটি কবিতা আছে। তাতেও ভয়াবহ সেই দিনগুলোর কিছু চিত্র পাওয়া যায়। ‘আমাদের পকেট গুছিয়ে রাখা সংসার লাফ দিয়ে নেমে যাচ্ছে সুপারস্টোরের দীর্ঘ লাইনে’- এতেই মনে পড়ে যায়, লকডাউন শুরু হলে যখন মানুষ প্রায় ঘরবন্দি হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তখন বিভিন্ন পৃথিবীর মানুষেরা সুপারশপে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিল। কবি সেই সময়ের সেই চিত্র তুলে এনেছেন। এজন্যই বলা হয় কবিরা সমাজের দর্পন। কবিচোখে দেখা সত্যচিত্র এভাবেই তুলে আনেন। কবি একেএম আব্দুল্লাহ সেই কাজটিই করেছেন। ঝুলন্ত স্বপ্ন, শুভাকাক্সক্ষী, ছয় ফুটের ফাঁক, আঁধার প্যাঁচানো সময়,নীলঘণ্টায় ঝুলছে জীবন, টিয়ার-৪ একটি সময়ের ফুল, একটি অর্গানিক প্রার্থনা, চাঁদের জন্মদিনে কুড়োই জোছনাপুড়া সুখ, মাস্কপরা চাঁদের গল্প, হুইসেল, ফোসকা ওঠা সময়, একটি রাতরং টানেলের গল্প ইত্যাদি কবিতাগুলো সরাসরি করোনার নির্যাস। সেই সময়ের নানান ঘাত-প্রতিঘাত, হতাশার মারাত্মক ছায়া, বিপন্ন জীবনের কবির আনুভৌমিক সুচারু দুঃখ-সুন্দরকে কবি তুলে এনেছেন। এক্ষেত্রে কবির অন্তরবেদনাকে পাঠকের সামনে আনার জন্য ‘ ফোসকা ওঠা সময়’ কবিতা থেকে বক্তব্যের সপক্ষে দাঁড় করা যাক-
উল্টো চোখে হেঁটে যাচ্ছে পৃথিবী
আমি দাঁড়িয়ে আছি
ডোবার জলে।
কচ্ছপের মতো সূর্য
গলা বের করে ঢুকে যাচ্ছে খোলসের ভেতর।
যে তীব্রতা অনুভব করবো বলে দাঁড়িয়েছিলাম;
বৃক্ষের ঝরে পড়া পাতায় ডুবে যাচ্ছে পা।
এখন-দেহের লোমকূপ হারিয়ে যাচ্ছে
ঢেকে যাচ্ছে হাতের রেখা বিষণ্ণতার ফেনায়।
সাবান হাঁটু গেড়ে শ্বাস নিতে নিতে
ভেতর থেকে ছুটে যাচ্ছে প্রেমিক ঘোড়া।
এখন শ্বাস উড়ে যাওয়া দৃশ্য দেখতে দেখতে
মুখস্থ করছি জীবনের স্পন্দন। শ্বাস উড়ে যাওয়া দৃশ্য”- আহা কী সহজে বলা হলো অথচ এখানে রয়েছে কবির মর্মবেদনা। এই মর্মান্তিক দৃশ্য সারা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। অথচ কবিই পেরেছেন তার কষ্টের কথা প্রকাশ করতে। কবি আব্দুল্লাহ এক্ষেত্রে সফল।
‘শাজরাতকাঠের ক্যারাভ্যান ও আত্মার ফ্লেক্সিলোড’ গ্রন্থের এখনো অনেক কবিতা বাকি। আলোচনা করার মতো আরো অনেক কবিতা আছে। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো উচিত হবে না। সময়ের অনাগত আলোচকদের জন্য বাকি কবিতাগুলো থাক।
কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ একজন অভিজ্ঞ কবি। কবিতার নানান বাঁক প্রতিবাঁক, অলিগলি মাড়িয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে নতুন ধারায় কবিতা লিখছেন। কবির ‘ইমেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ’ গ্রন্থে কবি নতুন অভীক্ষা করার প্রয়াস পান। আর এ গ্রন্থে এসে পূর্ণপথ খুঁজে পান। কবির এ ধারা অব্যাহত থাকুক। অনাগত কালে হয়তো কবির এধারাটি বাংলা কাব্যসাহিত্যে নতুন বন্দরের সন্ধান পাবে। কবির কলম অব্যাহত থাকুক। সজীব জীবনে কবি সুন্দর থাকুন। সচল থাকুক কবির কলম।
(মামুন সুলতান। কবি, আবৃত্তিকার ও প্রকাশক)