গল্প: শিয়াল গুলোই ভালো ছিল

শিয়াল গুলোই ভালো ছিল
আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস
॥এক।।
ব্লাড টেস্ট রিপোর্টে রিসেন্টলি রক্তে সুগার ধরা পড়েছে প্রমিলার।ডাক্তার হাঁটাহাঁটি আর ওষুধ চালাতে বলেছেন।প্রমিলা তাই সকাল-সন্ধ্যা দু-বেলা নিয়ম করে হাঁটে।
মাস দেড়েক আগে প্রমিলা তার শরীরে বেশ কিছু অসুবিধা টের পেয়েছিল।অসুবিধা বলতে ঘুম কম হচ্ছিল,চোখ জ্বালা করছিল আর জিভ শুকিয়ে গিয়ে ঘনঘন জল তেষ্টা লাগছিল।আবার খাবার বেশি খাচ্ছিল। খাবার খেয়ে সে খাবার মোটেও গায়ে লাগছিল না তার;শরীর শুকিয়েই যাচ্ছিল।ফলে কাজে মন বসছিল না প্রমিলার।অলসতা ভাব আর হাত,পা জ্বালা করা তো ছিলই।সেই সাথে মাথা ঘোরাটাও। একসাথে এতগুলো অসুবিধা নিয়ে প্রমিলা গ্রামের ডাক্তারের কাছে দু-দিন ওষুধ কিনে খেয়ে কাজ না পেয়ে বড় ডাক্তার ডা: অরূপ রতন বিশ্বাসের কাছে গিয়েছিল।পাঁচশো টাকা যাঁর ভিজিট।তা ভিজিটের ভয় করলে তো আর অসুখ সারানো যাবেনা।
প্রমিলা ডাক্তারকে তার সব অসুবিধার কথা খুলে বলেছিল।ডাক্তার তার সব অসুবিধার কথা শুনে চিকিৎসা করে দেখে রক্তের কয়েকটা রিপোর্ট করে এনে দেখাতে বলেছিলেন।রিপোর্ট ছাড়া তিনি কোন ওষুধ লিখেছিলেন না।
প্রমিলা রক্তের রিপোর্ট করে ডাক্তারকে দেখিয়েছিল।ডাক্তার বলেছিলেন,”আপনার রক্তে সুগার ধরা পড়েছে।”
শুনে প্রমিলা ভয় পেয়ে গিয়ে চমকে উঠেছিল,”কী!আমার রক্তে সুগার ধরা পড়েছে!”
“হ্যাঁ।তবে এর জন্য ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আজকাল প্রায় মানুষেরই রক্তে সুগার।বাচ্চাদেরও রক্তে সুগার ধরা পড়ছে।”ডাক্তার প্রমিলাকে সাহস দিয়েছিলেন।
“কিন্তু আমাদের বংশে যে কারও রক্তে সুগার নেই।তাহলে আমার হল কীভাবে?”
ডাক্তার প্রমিলাকে এর উত্তরে বলেছিলেন,”সুগার কোন বংশগত রোগ নয় যে,বংশে কারও নেই বলে আপনার হবেনা।সুগার হল,একটি বিপাকজনীত রোগ।অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের ফলে এই রোগ হয়।সব কিছু নিয়মের মধ্যে থাকলে এই রোগ হয়না।এই রোগ একবার হয়ে গেলে মানুষকে খুব ভোগায়।তবে নিয়মিত ওষুধ ও হাঁটাহাঁটি করলে কিচ্ছুটি করতে পারেনা এই রোগ।কিচ্ছুটি না।
প্রমিলার এর জন্য কী কী খাওয়া নিষেধ আছে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলে ডাক্তার মিষ্টি, চর্বি ও মশলাদার খাবার খেতে নিষেধ করেছিলেন প্রমিলাকে।ও এক মাসের ওষুধ লিখে দিয়ে ওষুধ গুলো সব কিনে খেয়ে শেষ করে একমাস পর আবার রিপোর্ট করে আসতে বলেছিলেন।ওষুধ খেয়ে সুগার কী রকম থাকে সেটা দেখবেন।
।।দুই।।গতকাল ডাক্তার দেখিয়ে আসা প্রমিলার একমাস পূর্ণ হয়েছে।চেকআপে যাওয়ার আগে প্রমিলা তাই আজ রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়ে এসেছে সকালে।কিন্তু রিপোর্টের জন্য বিকেলে যেতে বললে শরীরটা ভালো না লাগায় মেয়ে টুম্পাকে পাঠাল সে।টুম্পা প্রমিলার একমাত্র মেয়ে।তার তিন বছর যখন বয়স ব্লাড ক্যানসারে তার বাবা মারা গেছেন।স্বামীর চাকরিটা প্রমিলা পেয়েছে।
।।তিন।।
রিপোর্ট নিয়ে টুম্পা যখন বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ওর কলেজের বন্ধু রীতার সাথে।
“আরে টুম্পা, তুই!”
টুম্পা বলল,”মায়ের রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিতে এসেছিলাম।কিন্তু তুই কী করছিস এখানে?”
স্মিত হেসে রীতা বলল,”এটাই তো আমাদের বাড়ি।”
“তারমানে “রক্ত পরীক্ষা সেন্টার” তোদেরই?”
“না।সব ভাড়ায় দেওয়া আছে।আমরা উপরে থাকি।”বলে রীতা বলল,”রিপোর্ট পেলি?”
“হ্যাঁ,পেলাম।”
“চল তাহলে আমাদের বাড়ি!”
টুম্পা যেতে চাইল না।বলল,”আজ নয়,পরে একদিন সময় করে এসে যাবো।”
রীতা জানতে চাইল,”আজ নয় কেন?”
টুম্পা বলল,”আজ গেলে দেরি হয়ে যাবে।আর দেরি করলে বাড়ি যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”
“ধুর!স্কুটি তো আছেই।সন্ধ্যা হলে হবে।”রীতা প্রায় টানতে টানতে বাড়ির ভিতর নিয়ে চলে গেল তাকে।
রীতার মা চা-বিস্কুট ও ডিম সেদ্ধ করে দিল।খেয়ে গল্প করতে করতে ওখানেই টুম্পার সন্ধ্যা হয়ে গেল।ফলে রীতারা তাকে থাকতে বললেও থাকল না সে।স্কুটি চালিয়ে চলে আসতে আসতে পথেই তার অন্ধকার হয়ে গেল।অন্ধকারে একটা জনহীন রাস্তায় তার স্কুটিটা খারাপ হয়ে গেল।টুম্পা পড়ল বিরাট সমস্যায়।
॥চার।।
রাস্তার দু-ধারে সারিসারি গাছ আর ঝোপঝাড়।তারমধ্যে অনেক গুলো শিয়াল খুব কাছেই এক সঙ্গে ডেকে উঠল।হুক্কা হুয়া, হুয়া হুয়া….।দু-একটা শিয়াল তার সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল ছায়ার মতো।ভয়ে টুম্পার প্রাণ তখন কণ্ঠাগত।মনে সাহস আনার জন্য সে তখন মোবাইলটা জ্বালাতে গেল।কিন্তু জ্বলল না।ফোন লক হয়ে গেছে কখন।টুম্পা ভাবল,এবার হিংস্র শিয়ালের দল বুঝি তাকে ছিঁড়ে খাবে।এই অন্ধকারে তাকে কেউ বাঁচাতেও আসবে না এখানে।
এই সময় দূরে একটা মোটরবাইকের লাইট দেখে টুম্পা মনে আবার সাহস ফিরে পেল।যাক,মানুষের দেখা মিলবে।শিয়ালের দল তাকে আর খেতে পারবেনা।টুম্পা হাত প্রসারিত করে দাঁড়াতে বাইকটা কাছে এসে থেমে গেল।ও লাইট নিভে গেল।অন্ধকারের মধ্যে তিনজন নামল বাইক থেকে।
“কী ব্যাপার,কে তুমি?”
টুম্পা বলল,”আমার বাড়ি সীতাপুর গ্রামে।আমার নাম টুম্পা।আমি ভীষণ বিপদে পড়েছি।আপনারা আমাকে বাঁচান,প্লিজ!”
“কী বিপদে পড়েছ?”
“স্কুটির চাকা পাংচার হয়ে গেছে।…”টুম্পা জানাল।
“সীতাপুরের কোন পাড়ায় বাড়ি তোমার?”
টুম্পা বলল,”হিন্দু পাড়ায়।বাবার নাম অভীক দাশ।”
ওরা ওর প্রয়াত বাবাকে চেনে।প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।তার মা বাবার চাকরিটা পেয়েছে সেটাও জানে।
টুম্পার মন থেকে তখন সব ভয় কেটে গেল।কারণ,এরা তার মা-বাবা সবাইকে চেনে।
।।পাঁচ।।
মানুষের কথার শব্দ পেয়ে শিয়াল গুলো এখন দূরে চলে গিয়ে ডাকছে।টুম্পা সেই ডাক শুনে বলল,”আপনারা আসার আগে শিয়াল গুলো এখানেই ডাকছিল।”
“আমরা না এলে তো তোমাকে খেয়ে নিত তাহলে।”
“তা খেয়ে নিত বৈকি!”
“আর খেতে পারবে না।তুমি এসো আমাদের সঙ্গে।”
টুম্পা জানতে চাইল,”কোথায়?”
বিরক্ত হয়ে তারা বলল,”সব সময় প্রশ্ন করো কেন?আসতে বলছি আমাদের সঙ্গে এসো না!”টুম্পার হাত ধরে একজন টান দিল।টানতে টানতে রাস্তার একেবারে নিচে নিয়ে গেল তাকে।মুখ চেপে ধরল একজন। বাকি জন তাকে….
টুম্পা তখন ভাবল,মানুষ গুলো নয়,শিয়াল গুলোই ভালো ছিল।শিয়াল গুলোই…