গল্প: সুখ ভাঙার সুখ

গল্প: সুখ ভাঙার সুখ

সুখ ভাঙার সুখ
আব্দুল বারী

মা যোগমায়া ছুটে চলেছে । আমি রোজকার মত পিছন থেকে দুটো সিটের আগের সারির জানালার ধারে বসে আছি। অমিতদা ,তাপসীদি, স্নিগ্ধা, আসলাম, প্রীতি, কুসুমিতা বসেছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কেউ কেউ দুটো সিটে পাশাপাশি কেউ বা একা। সামনে থেকে পিছন পর্যন্ত সমস্ত বাসটা যেন আমাদের মত নিত্যযাত্রীদের দখলে । বহরমপুর থেকে বাসটা ছাড়ে 9 টা 5 মিনিটে । আমরা অনেকেই বহরমপুর মোহনা বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠি ।কেউ কেউ ওঠে পঞ্চানন তলায়। জলঙ্গি গামী বাসে নিমতলা, চুনাখালী থেকে উঠতে থাকে আমাদের অনেকেই । তাপসীদি নিমতলা থেকে ওঠেন । অধিকাংশ দিন কুসুমিতা মোহনাস্ট্যান্ডেই টিকিট কেটে সিট বুক করে নেয়। তেমন কাউকে বসিয়ে নিমতলা পর্যন্ত নিয়ে আসে। তারপর তাপসীদি নিমতলায় উঠলে তাকে সিট ছাড়তে হয় । এভাবে আমরা নিত্যযাত্রীদের জন্য সিট ম্যানেজ করে নিই। আমি রোজই বসি পিছন থেকে দুটো সিট আগে। আজও বসেছি ।

বাস ছুটে চলছে আপন গতিতে । শুরু হয় আমাদের নিত্যকার কথকতা । বছর পঞ্চাশের সুরেনদা প্রথমেই অমিতদার পিছনে লাগেন। বলেন, এই সবাই শোনো, আজ অমিত কাঁচা পেঁয়াজ খেয়ে এসেছে । মুখ থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে ।অমিতদা সুরেন বাবুর থেকে বছর দুয়েকের ছোট । অমিতাদা সুরেন বাবু কে পিছনে লাগার জন্য সহ্য করতে পারেন না । বলেন বাজে না বকে চুপ করো। কুসুমিতা বলে এই সুরেনদা আজ তো মঙ্গলবার তার উপর পঞ্চমী । আজ পেঁয়াজ-রসুন বারণ। স্নিগ্ধা বলে তাহলে আজ সুরেনদাই পেঁয়াজ খেয়েছে সঙ্গে বৌদির কাছে আরও কিছু । বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে ওঠে ।বাসের সামনে পিছনে হেঁকে হেঁকে গল্প চলে। অন্য যাত্রীরা কেউ গল্প শুনে মজা পায়, কেউ বিরক্ত হয়।
কোন কোন দিন ডিএ নিয়ে জোর তর্ক শুরু হয় । এত গুলো চাকুরীজীবী এক গাড়িতে ওঠায় তর্কটা অন্য মাত্রা পায় । কেউ কেউ সরকারের পক্ষ নেয়, কেউ কেউ কর্মচারী সংগঠনের ।আমাদের জোর তর্কে অন্য যাত্রীরা যথেষ্ট বিরক্ত হয় । তবু কিছু বলতে পারেনা । আমরা যে সবাই ভদ্র , এলিট সম্প্রদায়ের লোক। অধিকাংশই শিক্ষক , কেউ স্বাস্থ্যকর্মী , কেউ বিডিও অফিসের কর্মচারী, কেউবা পঞ্চায়েতের । বাসের যাত্রীদের বেশ একটা অংশ স্বল্পশিক্ষিত,গরিব গুর্ব মানুষ। মাথাভর্তি সরষের তেল ,পুঁটুলি থেকে বের করা কোঁচকানো ভাঁজ পড়া জামা ।মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি । কারো মুখে বিড়িরগন্ধ । যারা নব্য যুবক তাদের পাছা থেকে খসে পড়া জিন্স, স্কিন টাইট গেঞ্জি ।পড়াশোনার দৌড় যে খুব বেশি নয় তা দেখলেই বোঝা যায় । তারা গরম গরম চোখে আমাদের দিকে তাকালেও মুখে কিছু বলে না । আর মহিলা যাত্রীদের কথা তো বলতেই নেই। বুবু বুবু করে গল্প করে, কেউ আবার বাজখাঁই গলায় নিজের উপস্থিতি জানান দেয় । কেউ কন্ডাক্টরের সঙ্গে বেশি ভাড়া নেওয়ার জন্য ঝগড়া করে। বলে কাল যাবার সুমায় 12 টাকায় গেলছি আজ 15 টাকা ক্যানে লিবা । তিনটাকা ঘুরিয়ি দাও ।কনডাক্টর যা ভাড়া তাই নিচ্ছি বলায় বেঁধে যায় ঝগড়া। কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়। তবে এতে আমাদের গল্প থামেনা। এ সব নিত্য দিনের ঘটনা। দেখে দেখে সয়ে গেছে। তাই আমাদের গল্প ননস্টপ।
শুভাকর ওঠে ঘূর্ণি থেকে । ও বাসে উঠলেই পরিবেশটা আরো উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। গাড়িতে উঠে শুভাকর আদি রসের ছোঁয়া দিয়ে কথা বলে । আজ বাসে উঠে বলে , ঋজু কি করছিস রে। এত মনোযোগ দিয়ে কি দিচ্ছিস । ঋজুুর চোখ তখনও মোবাইলের স্ক্রিনে । শুভাকর বলে কি দেখছিস বিদ্যাবালানের পালা… বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। ঋজু লজ্জা পায়।বলে শুধু আমাকেই দেখতে পেলে, স্নিগ্ধাকে দেখো ও তো বাসে উঠে থেকেই মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে আছে। শুভাকর বলে তাইতো , কি স্নিগ্ধা সালমানের নতুন কোন লুক বেরোলো নাকি ,প্যান্ট খোলা । স্নিগ্ধা লাজুক হাসে।
শুরু হয়ে যায় বলিউডের নায়ক- নায়িকা ,ভিলেনদের গল্প । মোবাইল এর কাছে মাথা নত করেই গল্প চালিয়ে যায় অনেকে । সুরেনদা টিভি সিরিয়ালের ভক্ত । এবার অমিতদা সুযোগ পেয়ে যান। বলেন কি সুরেন তোমার পারি খেপির খবর কি ? সুরেনদা পারির (অপরাজিত আঢ্য) ভক্ত । জল নূপুর সিরিয়ালে পারির অভিনয় দেখে মুগ্ধ । অন্য দিন পারির নাম শুনলে একটু হাসেন। আজ গম্ভীর । কারণ বাসে উঠেই ফিচেল স্নিগ্ধার একটা খোঁচা খেয়েছেন। তাই অমিতদার গুঁতোতেও রেগে উঠতে গিয়েও দমে যান। মাঝে মধ্যে তাপসীদির সঙ্গে এ বিষয়ে বেশ জমাটি গল্প হয় সুরেনদার।
অমিতদা সিরিয়াল দেখা একেবারে পছন্দ করেননা । সিরিয়ালের গল্প হলে বিরক্ত হন ।বলেন সেই একঘেয়ে গল্প । বনেদি পরিবারের একসঙ্গে বাস, বাড়ির কোনো বৌ বা জেঠিমা কাকিমা চক্রান্তের জাল বুনে যাওয়া ,পুরুষগুলোর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাওয়া, কিছু মুখরোচক সংলাপ, নায়ক এর এক্সিডেন্ট, স্মৃতি হারানো কিংবা দুটো বিয়ে। কোন পজিটিভ দিক নেই । শুধু কুটিলতা , ঘর ভাঙার গল্প। ঘরে ঘরে শাশুড়ি বৌমার ঝগড়া লাগিয়ে দেওয়া নয়তো গো-বেচারা স্বামীর উপর বউগুলোর সিরিয়ালের ডায়লগ ঝেড়ে টর্চার করা ।বিরক্তিতে অমিতদার মুখ বিরস হয়ে যায়। মাঝে মাঝে স্থান-কাল ভুলে তীব্র তর্ক বেঁধে যায়।
আসলে অমিতবাবুর বাড়িতেও টিভি দেখা নিয়ে মাঝে মাঝে তর্কাতর্কি , মনকষাকষি শুরু হয় । অমিতবাবু কোন বিশেষ অনুষ্ঠান, খবর বা খেলা দেখবো বলে বসলে রিমোট হাতে পাননা। রিমোট থাকে মিসেস অমিতের হাতে। মিসেস সিরিয়াল দেখেন আর বিজ্ঞাপন বিরতির ফাঁকে ফাঁকে অমিত বাবুকে খবর শুনতে হয় বা খেলা দেখতে হয় । আর তার জন্য সিরিয়ালের সব চরিত্র , তাদের কথাবার্তার সঙ্গে অমিতবাবুর পরিচয় হয়ে যায় । মাঝে মাঝে মিসেস এর সঙ্গে ঝগড়াও হয় । সেদিন যেমন ওভারে এক বল বাকি । আগের বলে বিরাট কোহেলি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। হাতের গ্লাভস খুলে টাইট করে বেঁধে নিতে নিতে মাঠটা দেখে নিচ্ছেন । নিশ্চিত আর একটা বড় শর্ট নেবেন। ভেতরে বেশ একটা উত্তেজনা। বোলার বল নিয়ে ছুটছে আর হুশ করে চ্যানেল চেঞ্জ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না অমিত বাবু । ঝগড়া বেঁধে গেল। মুখ দিয়ে বাল ছালও বেরিয়ে গেল।
বাসের মধ্যে যে শুধু গ্রাম্য খেটে খাওয়া মানুষ থাকে তাই নয়, থাকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী , অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী , কলেজপড়ুয়া তরুণ-তরুণী, বেকার যুবক-যুবতী ,সুবেশী ভদ্রলোক , মাঝবয়সী রাশভারী গৃহিণী । তারা সবাই আমাদের তর্ক-বিতর্ক ভালোভাবে নেয় না । অবসরপ্রাপ্ত ব্যাক্তি হয়তো নীরবে তার সময়ের সঙ্গে এসময়ের চাকরিজীবীদের তুলনা করেন। কলেজ পাস বেকার যুবক বাঁকা চোখে দেখে আর ভাবে শালারা সরকারের জামাই ,পাছায় তেল বেঁধেছে । তাই বাসের মধ্যে এমন সব ফটোর ফটোর । এরা আবার নিজেদের শিক্ষক বলে । এইতো রুচি, শেখাবে কি ছাত্রদের ।হয়তো তার বেকারত্বের জ্বালা এমন করে তাকে ভাবতে শেখায়। আর এটাও সত্যি যে আমরা ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করি ।
গত কয়েক মাস আমি এদের সহযাত্রী ।জানালার ধারে সিটে বসে বাইরের মাঠ নদী গাছপালা দেখি। ওদের কথায় কখনো যোগ দিই। বেশিরভাগ সময় চুপ থাকি। বাইরের উন্মুক্ত মাঠে বেড়ে ওঠা ফসল আর চাষীদের ব্যস্ততা আমাকে বেশি টানে । আর সেই বৃদ্ধ ।রোজ একবার করে বৃদ্ধকে দেখি । রাস্তার পাশের একটা বাড়ির সামনে গাছের গোড়ায় মাটির বেদিতে বসে থাকা বৃদ্ধ । নয়মাইল ঢোকার আগে বাসের গতি শ্লথ হয় । বৃদ্ধকে দেখি সামনে কাঁসার বাটি, তাতে মুড়ি । বেদির নিচে ছয় ফুট দূর দিয়ে মাটিতে বসে থাকে কুকুর বিড়াল ছাগল মুরগি হাঁস বকনা বাছুর । অর্ধবৃত্তে তারা বসে থাকে । বুড়ো যখন মুড়ি ছড়িয়ে দেয় তখন বৃত্তটা ভেঙে যায় । তবে প্রাণীগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বাধে না , একটু ঠেলা ঠেলি চোখরাঙানি চলে। তারপর কি এক জাদুমন্ত্রে আবার যে যার জায়গায় গিয়ে বসে । আমি ভাবি পৃথিবীটা যদি এমন হতো । মানুষ পশু-পাখি এমন অহিংস ভাবে সহবস্থান করতো তাহলে যেন পৃথিবীটাই স্বর্গ হয়ে যেত। এখানকার একখণ্ড স্বর্গ দেখে মনটা ভরে যায়। বাসটা এই জায়গায় একটু থামে।
সেদিন হঠাৎ বাসের পেছনের টায়ার ফেটে যায় । বাসটা গিয়ে থামে ওই ছোট্ট অলিখিত স্টপিজে । আমরা অনেকেই বাস থেকে নেমে দাঁড়াই। বিরক্ত হয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। ঠিক টাইমে স্কুল- অফিসে ঢুকতে না পারলে আরেক বিড়ম্বনা । রাস্তার পাশে চা পান বিড়ি মিষ্টির দোকান । আর ঐ পাশে সেই গাছের তলায় অপার্থিব দৃশ্য রচনা করে বসে আছেন আদি শিব । অর্ধবৃত্তে পশু পরিবৃত্ত বৃদ্ধ । আজ দেখি বৃদ্ধের দু’পাশে দুটি শিশু। দুই তিন বছরের শিশুদুটি । ঋজু বলে মৃগাঙ্কদা দেখ পশু আর মানুষ কেমন সুন্দর ভাবে বসে আছে । ঋজুর কথায় সকলেই বৃদ্ধকে দেখে। তাপসীদি বলেন এ দৃশ্য আমি গত এক বছর থেকে দেখে আসছি। তবে বাচ্চা দুটোকে আজ দেখলাম। তা মৃগাঙ্ক তোমার বাবার অসুখ বলছিলে না , এখন কেমন আছেন । মৃগাঙ্ক আমতা আমতা করে বলে ভালো , এখন ভালো আছেন । তাপসী দি বলেন কোন ডাক্তারকে দেখালে? মৃগাঙ্ক কিছু বলতে চাই না, এড়াতে চাই। স্নিগ্ধা বলে ছাড়ুন তো তাপসীদি। কথার মধ্যে একটু ঝাঁজ থাকে। তাপসীদি ব্যাপারটা জানতেন, তাই বলেন কেন ছাড়ব স্নিগ্ধা, বাবাকে বহরমপুর রেখে ডাক্তার দেখাতে পারেনি এইতো। বুঝলি আমাদের মেয়েরা অনেকেই খুব ছোট মনে হয় । তারা ভুলে যায় বাবা-মা কত কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছে ।
স্নিগ্ধা বলে শুধু মেয়েদের দোষ দিলে হবে না তাপসী দি। ছেলেরাও কম স্বার্থপর নয়। নিজের বাবাকে কাছে রেখে ডাক্তার দেখাবে এতে বউয়ের রাগের কি আছে ? আসলে ছেলেরাও অনেকেই চায়না বাবা-মা কাছে থাকুক ,তাদের সেবা করতে হোক । তারা চায় জীবনটা উল্টে পাল্টে উপভোগ করতে।
কথাটা মৃগাঙ্ককে বিঁধে । মৃগাঙ্ক বলে তাপসীদি ব্যাপারটা আপনারা যেমন ভাবছেন ঠিক তেমনটি নয় । আসলে আমাদের ফ্ল্যাট টা ছোট। দুই কামরার । একটাতে মেয়ে পড়াশোনা করে । এবার লা-মার্টিনে ক্লাস টু এর ভর্তি করেছি। নিচু ক্লাস হলে কি হবে পড়াশোনার খুব চাপ । রিতা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যায় , নিয়ে আসে । দুজন স্যার পড়াতে আসেন, তাদের চায়ের ব্যবস্থা করা, সন্ধ্যায় নাচের দিদিমণির কাছে নিয়ে যাওয়া । তাছাড়া সপ্তাহে দুদিন গানের ক্লাস । ও মানে রিতা একদম সময় পাইনা। আর আমি তো সেই নটার আগে স্নান-খাওয়া করে বেরিয়ে আসি। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। বাবা একা-একা ফ্ল্যাটে বোর হন । তাছাড়া খোলামেলা জায়গায় বড় হওয়া মানুষ , ফ্ল্যাট বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে ।প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই …
তাপসীদি বলেন ঠিক আছে মৃগাঙ্ক, আসলে আমরা প্রত্যেকেই জীবনকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি। আর যা কিছু সাজানো-গোছানো সেখানে বাড়তি জিনিস বেমানান , রাখা যায়না । তাছাড়া ফ্ল্যাট বাড়িতে বনসাই মানাই , প্রকৃতি লালিত বটবৃক্ষ নয় । তোমার জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলে তুমি ঠিকই আছো।
মৃগাঙ্ক কিছু বলেনা । ঋজুর ডাকে সাড়া দিয়ে সরে যায়। শুধু মৃগাঙ্কই নয় ,আসলাম ,অরুণ তারাও চাকরি পাওয়ার পর গ্রাম ছেড়ে বহরমপুরে চলে গেছে । তাদের বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়া আসা করা যেত কিন্তু তারা থাকেনি ।গ্রামের বাড়িতে থাকলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ভালো হবে না । সেখানকার পরিবেশ নাকি ভালো নয় । মাঝে মাঝে গ্ৰামে যায় । পুজো পার্বণে জমা কাপড় দিয়ে আসে । দেশের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার বেশ একটা আনন্দ হয় ।ছেলেমেয়েরাও গ্রাম দেখে মুগ্ধ হয় । পাখি দেখে, গাছ দেখে নানা প্রশ্ন করে। কাকা জ্যাঠাদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হয়।
টায়ার বদলানো হয়ে গেছে । বাসে হর্ন দেয় ।তাপসীদিরা বাসে উঠে যায় । তার আগে দেখে বৃদ্ধকে একজন মহিলা জল রুটি তরকারি দিল। তারপর ছেলে দুটো তুলে নিল। বৃদ্ধ বাচ্চা দুটির মাথায় হাত রেখে পরিতৃপ্তির হাসি হাসে । মহিলা বৃদ্ধকে মৃদু ও মোলায়েম সুরে কিছু অনুরোধ করে । এখান থেকে শোনা না গেলেও বোঝা যায় খাবার খেয়ে নেওয়ার অনুরোধ সেটা। বৃদ্ধ হাসে।তারপর একটা রুটি তুলে নিয়ে ছিঁড়েছিঁড়ে অর্ধবৃত্তাকার পশুদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়। বাসটি গড়াতে শুরু করে। শিশুদুটি মায়ের হাত ধরে বাড়ির ভেতরের পথ ধরে । দু চোখ জুড়িয়ে যায় আমাদের । তাপসীদির দিকে তাকালাম ।দেখি কেমন থমথমে মুখ । টায়ার বদলানোর পর থেকে বাসে উঠে আর সিটে বসেন নি ।আগের স্টপিজে একজন মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে উঠেছিল। ব্রেক কষলে বা বাস হঠাৎ গতি নিলে মহিলাটি বাচ্চা নিয়ে তাল সামলাতে পারছিল না । তাই তাপসীদি তাকে সিটটা ছেড়ে দেন । আমাদের সিটের সোজা বাসের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সিট ছেড়ে দিতে চাইলাম তিনি নিলেন না । তবে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না। পরের স্টপিজে আমার পাশের জন নেমে যায়। তাপসীদি সেখানে বসেন । আমি তাপসীদিকে জিজ্ঞেস করি কি হলো তাপসীদি , হঠাৎ এত মন খারাপ কেন ?
ততক্ষণে বাসের মধ্যে আবার শুরু হয়ে যায় খেজুরে আলোচনা। এবার রাজনীতি । সারোদা ,নারোদা ,রাফাল । যুক্তি প্রতিযুক্তি , বিশ্লেষণ ।বিশ্লেষণের বিশ্লষণ । হঠাৎ আসলামের মোবাইল বেজে ওঠে। রিসিভ করে । কথা শুনে মনে হয় হেডস্যার বাজার থেকে কিছু একটা নিয়ে যেতে বলছেন । তার স্কুলটা বাজার থেকে বেশ একটু ভেতরের গ্রামে। বাজার থেকে জিনিস নিয়ে স্কুলে পৌঁছাতে আজ এক ঘন্টা দেরি হলেও আর কোনো অসুবিধা নেই আসলামের । তাই ঋজু বলে যাক ভাগ্য করে তুই একটা হেডমাস্টার পেয়েছিস ভাই । এমন উপরওয়ালা না হলে চাকরি করে সুখ ।আর হেড স্যারের পেয়েছি আমি, পান থেকে চুন খসার জো নেই। অমিতদা বলেন তবু তো তোর স্যার ভালো । মাঝে মাঝে কামাই করলে টুক করে সই মেরে দিতে পারিস । আসলে তোদের অল্প স্টাফ , ছোট সংসার। চাইলে নিজের মত অনেক কিছু করে নেওয যায়। শুনতে পাই চারটের আগে নাকি স্কুল থেকে বেরোতে পাস । আর আমাদের হেড স্যার একেবারে খাড়ুস । শালা চারটে পনেরোর আগে ডিপারচার এর কোনো গল্পই নাই ।ব্যাটা সারাক্ষণ ক্লার্কের সঙ্গে মিড ডে মিল এর হিসাব নিয়ে ব্যস্ত। কি যে মধু আছে তা ওরাই জানে ।
সুরেনদা বলেন অলি হও মধুর স্বাদ তুমিও বুঝবে।
সুরেনদার কথা ছ্যাঁক করে লাগে অমিতের গায়ে। বলেন তুমি গুবরে হয়ে এখনি বুঝছ বুঝি।
স্থান-কালের বিচার না করে কি অবলীলাক্রমে নিজেদের কর্মস্থলের প্রাইভেসি ওপেন করে চলেছে এরা। আমার খারাপ লাগে ।ভাবি শিক্ষকদের সম্মান না পাওয়া ,জনসাধারণের সফট টার্গেট হওয়ার এগুলিও কারণ বটে ।
আমি আবার তাপসীদি কে জিজ্ঞেস করি কি হলো তাপসীদি হঠাৎ মুড অফ হল কেন ?
তিনি আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ।একটু হাসার চেষ্টা করলেন , তারপর বললেন আমরা অনেকে অতীতকে অস্বীকার করতে চাই সাজিদ । আবার অনেকে অতীতকে হারিয়ে ফেলার বেদনায় কাতর হই । ঐ বৃদ্ধকে দেখে আজ আমার ঠাকুরদার কথা মনে পড়ে গেল ।ছোটবেলায় আমরা আমতলার এক গ্রামে থাকতাম। আমরা ঠাকুরদার পাশে শীতের সকালে রোদ মেখে বসতাম । উঠোনে শীলতপাটি পাতা হত। পাটির উপর অনেকেই ঠাকুরদাকে ঘিরে বসতাম। খেজুরের গুড় দিয়ে ঠাকুরদা মুড়ি খেতেন । আমাদের খাইয়ে দিতেন । আমাদের বাড়ির চারপাশে প্রচুর গাছপালা ছিল। পাখি ডাকত, উঠোনে মোরগ ঘুরতো । ঠাকুরদা আমাদের কত গল্প বলতেন । আমরা ছড়া শোনাতাম । সে এক অন্য সকাল। গাছে গাছে কুয়াশা , ঘাসে ঘাসে শিশির । এক পাল মানুষে ভর্তি বাড়ি । সব সময় গমগম করছে। আমার যখন এগারো বছর বয়স তখন এক হেমন্তের দিনে ঠাকুরদা চলে গেলেন । মৃত্যুর সময় তার ঠোঁটে লেগে ছিল এক অনাবিল হাসি । কি পরিতৃপ্তির মৃত্যু। সংসারের সব সুখ ভোগ করে এক বিজয়ী হাসি ঠোঁটে নিয়ে তিনি চলে গেলেন । এই বৃদ্ধর ঠোঁটের হাসি দেখে আমার সেই ঠাকুরদাকে আজ মনে পড়ে গেল। মনটা ভার হয়ে গেল রে সাজিদ । ভাঙনের সংসারে দাঁড়িয়ে পাঁচজনকে ফাঁকি দিয়ে কত সুখ পাচ্ছি আমরা জানি না, তবু সেই ভাঙনের নেশায় বুঁদ হয়ে আছি । শিক্ষিত হৃদয় যেন আরো বেশি হিসেবী।

আমি তাপসীদির দিকে তাকায়। তার চোখের গভীরে অতীতের স্নেহ মায়া-মমতা ভেসে বেড়াচ্ছে ।সমস্ত ভাঙনকে রুখে দেওয়ার তীব্র শক্তি সেখানে সঞ্চিত । এখনো তাপসীদি শ্বশুর শাশুড়ি বিধবা ননদকে নিয়ে পরিপূর্ণ সংসারে বাস করেন ।
বাস ইসলামপুর ঢোকে। আমি আর তাপসীদি নেমে যাই।
অনেক তর্ক আর গল্প নিয়ে চাকা গড়িয়ে যায়
সামনের দিকে।