গল্প: কেউ হারিয়ে যায়

গল্প: কেউ হারিয়ে যায়

কেউ হারিয়ে যায়
অরূপ কুমার পালিত

আজকে বৃষ্টি আসবে সে মেঘের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি খেলায় বোঝা গেল। প্রতিবারের মতো আজকে ছাতা আনতে ভুলে গেছি,বাসে উঠার জন্য বদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষন।
উপরে টিপ টিপ বৃষ্টিতে ভিজে, গায়ে জামাটা শরীরের সাথে একপাশ লাগিয়ে গেছে। কেমন নিজের উপরে রাগ হচ্ছে।
হঠাৎ করে পিছন থেকে একটা ছাতা আমার মাথায় উঠলো, হতভম্ব হয়ে ফিরতে দেখি এক বোরখা পরা মহিলা , কোলে ছোট আদরে ফুটফুটে বাচ্চা।
ছোট বাচ্চা কথা বলতে না পারলে কি হবে , আমার দিকে তাকিয়ে হৃদয় ছোঁয়া সুন্দর কোমল হাসি।মনে হলো সে যেন আমার অনেক দিনের চেনা।
দুর থেকে বাস আসতে মহিলা হাত দেখালো , মহিলা ছাতা বন্ধ করে বাচ্চার উদ্দেশ্য বললেন ,বাবা আঙ্কেলকে বা্ই বা্ই বল তোমাকে আমি অন্তত , আঙ্কেল এর মতো কাপুরুষ বানাবো না।
মহিলার কন্ঠটা অনেক পরিচিত মনে হলো, দেখতে দেখতে বাস অনেক দূরে মহিলাকে নিয়ে চলে গেছে,জানা গেল না কে তুমি?
নিজের ও বাস আসাতে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে উঠে গেলাম।
মেমোরি থেকে মুছে যাওয়া কন্ঠ স্বরের আওয়াজ টা অনেক চেষ্টা করে মনে পড়ছে না।আনতে ও ইচ্ছে করছে না, যে হারিয়ে যাবার সে তো গেছে।
ব্যাংকে আজকে অনেক ভীড় হবে ম্যাডাম কালকে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন, কিন্তু যেই দিন অফিসে তাড়াতাড়ি আসতে হবে বলেন , সেই দিনই আমার দেরি হয়।অফিসে ডুকতে গাল ফুলিয়ে ম্যাডাম বড় বড় চোখ করে বললো,
নিহার তোমাকে নিয়ে আর পারিনা, কালকে বন্ধ পরশু ঈদ, মানুষের দীর্ঘ লাইন , মাথা মুছে কাউন্টারে বসে যাও।
নিহার মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে কাজ শুরু করলো।মনে মনে বলল এই মহিলা এতো সহজে কথা না শুনিয়ে ছাড়বেন না।
কাউন্টারে এতো ভীড় দুপুরে আজ লাঞ্চ ও করে নি , নিজের উপরে খুব রাগ হচ্ছে নিহারের , মহিলা ম্যানেজার খেয়াল করে সবকিছু, পিওন এর দিয়ে সেন্ডুইস দুইটা পাঠিয়ে বললেন।
স্যার, আপনাকে ম্যাডাম ছুটির পর সালাম দিয়েছেন।
ঈদ আনন্দে কলিগরা হাসি মুখে বের হচ্ছেন, আমার এইবার যেতে হবে বসের রুমে।
:ম্যাডাম আমি কি আসবো?
আমি প্রথম দিন থেকেই বলেছি এই ব্রাঞ্চে তুমি একমাত্র ব্যক্তি , আমার রুমে আসতে কোন অনুমতি লাগবে না।
তোমাকে আমি ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করি, বস নিহার।
নিহার চেয়ার টেনে বসে পরে।
তোমার কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পার।
তুমি প্রায় দেখি আস সবার আগে, যাও ও সবার শেষে , কাজকর্মে তোমার কোন গাফেলতী দেখি না, কিন্তু মনমরা হয়ে থাক কেন সবসময়।
তোমার বাবার সাথে পরিচয় হয়েছে , বৃদ্ধ বয়সে তোমাকে রান্না করে খাওয়াতে কষ্ট হয়। তুমি কি আর বিয়ে করবে না বলে সিদ্বান্ত নিয়েছ,আমার হাতে ব্যাংকে জব করে সুন্দর মেয়ে আছে।
না ম্যাডাম আমি আর বিয়ে করবো না ঠিক করেছি।
কেন ?
তুমি কি কাউকে পচন্দ করতে।
হ্যাঁ ম্যাডাম ,আমি একজন কে পচন্দ করতাম , নাম মিলি।
মিলি এবং আমি চট্রগ্রাম ভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টই পড়তাম,মিলির অনুরোধে আমি ওর ছোট বোন সাইমা কে বাসায় গিয়ে পড়াতাম ,আমার উদ্দেশ্য ছিল মিলিকে রোজ একবার করে দেখা।
সাইমার এস এস সি পরীক্ষা চলাকালে হঠাৎ করে একদিন আমাকে বললো ।
স্যার পরিক্ষার পরে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে।আপনাকে আমার খুব পছন্দ, আপনাকে আমি ভালবাসি।
কথাটা শুনে আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে যায়।
মিলিকে কলেজে এসে সব বললাম , মিলি নির্দ্বিধায় বলে দিল, তুই এতোটা খারাপ ছেলে না যে, আমার বোনের পছন্দ হবে না।
কথা গুলো বলতে গিয়ে মিলির চোখ দুটো ছলছল করছে, হয়তো কলেজ না হলে কেঁদে দিত।
তবু ও বললো , আজকে থেকে আমাকে নাম ধরে ডাকবি না, বড়ো আপু বলবি। আমার বোনের পছন্দ হয়েছে তোকে, আমার বোনের পছন্দই সব।
হঠাং সে আমাকে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বলল , তোর গায়ের গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগে রে।
ওর কথাবার্তায় মনে হলো ,আমি ওর বোনের সুন্দর রুপ দেখে পচন্দ করে ফেলেছি।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, ওর কান্না দেখে আমি নিজেও কেঁদে ফেলেছি।তবুও সেই দিন আমি শত চেষ্টা করে ওকে বুঝতে পারি নাই ,আমি শুধুই তোকে ভালবাসি।
আমাকে আর ওর বাসায় না যেতে মানা করে, ওর কথা মতো আমি আর ছোট বোনকে পড়াতে ওই বাসায় আর যায়নি।বাসায় এসে আমার মোবাইলের সিম সহ পরিবর্তন করে ফেললাম , মিলিকে ভুলতে নয়।
অনেক পরে জানলাম মিলিরা সপরিবারে দেশের বাড়িতে চলে গেছে।
সেই দিনের পর আজ ও মিলিকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু আমার মনের বিশ্বাস ছিল, সে আমার আসেপাশে আছে,আমাকে ধরা দেয় না।
হাত দিয়ে ম্যাডাম একটা টিস্যু দিয়ে বললেন চোখ মুছে নাও, আজকে তোমার চোখের জলে বলে দিল, তুমি তোমার মনের কথা আমাকে বলে অনেকটা হালকা হয়েছ।
সত্যিকারের ভালোবাসা এমনি হয়। কেউ হারিয়ে যায় , কেউ হারিয়ে ফেলে,তুমি ও তাদের মধ্যে এতজন।