গল্প: সাইনবোর্ড

গল্প: সাইনবোর্ড

সাইনবোর্ড
হামিদ মোহাম্মদ

আলিম মিয়া পত্রিকা একটি কিনে বাসে চড়ে বসলেন। সিট এক্কেবারে পিছনে। শুটকি আর মাছের গন্ধ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চালু হয়েছে গেল সপ্তাহে। একশ সত্তর টাকায় টিকেট কিনে বসেছেন। সিলেট এসেছিলেন সকালে। বিকেলে ফিরছেন, বলা যায় ফিরতি বাসে। কিন্তু শুটকির গন্ধ আছেই। কোনভাবেই শীতাতপ বল, আর অন্য কোন বাস বল,কোন বাসের লগ ছাড়ে না এই গন্ধটি। সেই সঙ্গে মাছর আইছলা গন্ধ।
গত রাতে আবার বউ আছিয়া বিবির সঙ্গে ধুম তর্ক। তর্ক শুধু আছিয়া বিবির সঙ্গে তার যে হচ্ছে, তা নয়। মনে হচ্ছে প্রায় ঘরেই এই বিবাদটি ছড়িয়ে পড়েছে। বিবাদটির জন্য দায়ী স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয়। এই যে সুনামগঞ্জে বিমান বন্দর হওয়া নিয়ে তর্ক। মন্ত্রীর মুখ থেকে ছিটকে কথাটি বেরুনোর পর হতে নানান কিসিমের তর্ক হচ্ছে, অনেকটা ঘরে ঘরেই। পথে—ঘাটে,হাটে—মাঠে,বাসে। সকালেও বাসের কয়েকজন যাত্রী তর্ক জুড়ে দিয়ে এক ধরনের হাতাহাতি পর্যায়ে। যাত্রী জোসের চটে সিট থেকে উঠে তর্কটি চালান, হাতপা ছুঁড়তে থাকেন। বাসের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি।
পত্রিকায় ‘দুই মন্ত্রীর লড়াই রেলপথ নিয়ে।’
সংবাদটি পড়তে পড়তে শুটকির গন্ধে বিভোর হয়ে এক সময় পত্রিকার পাতায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আলিম মিয়ার। ঘুম নামে চোখজুড়ে। এক তো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, বিশেষ বিশেষ কাজে সিলেট শহরের জিন্দাবাবাজার থেকে বন্দর বাজার, কালিঘাট বৈষয়িক কেনাকাটায় দৌঁড়ঝাপ। শরীর ক্লান্তিতে ঝুলে পড়ে, ঘুম আর তাড়ানো সম্ভব হয়নি।
গত রাতে বউ বলেছিল— দেখারহাওর যে স্থানটিতে বিমান বন্দর হবে, সেখানে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলে আর কে সরায়?। তার যুক্তি ছিল–‘দেখছো না সিলেট সিটি কপোর্রেশেনের সামনের চত্বরে যুবলীগ টাঙিয়ে দেয় ‘কামরান চত্বর’ এবং গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্টে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে ‘ মুক্তিযোদ্ধা চত্বর’। কেউ সরাতে পারছে?
আমাদের হোটেল ‘জলকন্যা’ যেখানে হবে, নিজেদের জমির পাশে ‘দেখারহাওরমারা’ বিমানবন্দর,সুনামগঞ্জ–সাইবোর্ডটি টাঙিয়ে দিলেই আর কে সরায়? আছিয়া বলে—‘মাথায় একটু বুদ্ধি খাটালেই তো পারো। সারা জীবন বোকাই রয়ে গেলা। তোমার লাগি কিছ্ছু অইল না।’
ঘুমের মাঝে আবার বউ আছিয়ার গত রাতের তর্ক ফিরে আসে। ঘুমের দুলুনিতে সে তর্ক চলতেই থাকে।
–তোমারে কইছিনু আমারে মুরগর ঘর বানাইদিতে। আমি খামার করমু।
–ফালাও তোমার মুরগর খামার। আগে দেখি লও বিমান বন্দর অইবোনি।
–বিমান বন্দর অইলে আমরা ভাতর অটল দিমু, নাম রাখমু ‘জলকন্যা’। হাওরের মাঝে ত, নামটা ঠিক আছে না? হাওরের লগে মিল।
–রাখো তে, আগে বিমান বন্দর অইজিলাইক। নাম লইয়া লাগছে পাড়াপাড়ি, পাদুমপাদুম অবস্থা। অর্থাৎ পাদ ছুটিছে। মন্ত্রী খইরা শান্তিগঞ্জ। আর এমপিরা খইরা ‘আছানমারা’,দেখার হাওরের পশ্চিম পারো। আর সাংবাদিকরা খইরা ‘হাছন রাজার’ নামে। আর খেউ খেউ খইরা ‘দুর্বিনশাহ’র নামে। আবার হুনরাম, ভোটের লাগি ভালা অইব খইরা ‘রাধারমণ’র নামে।রাধারমণ হিন্দু, সুনামগঞ্জে ইন্দু বেশি। কী তিলিসমাৎ লাগছে। আমি তো খইছলাম—‘আছানমারা’ই অজাউক। এখন দেখছি মানুষের মন খারাপ অইব। মাইনসে মনে করবে বিমান বন্দর আবার আছানমারা—টারা অওয়া ঠিক না। মরার সাথে সম্পর্ক। উঠতে নামতে মনে হবে এই মরি যাইরামনি।
–তো দেখার হাওরোত যদি অয় বিমান বন্দর, তবে তো হাওর মাইরযাইবোগি। অউত দেখি মরা লগ ছাড়ের না। নাম তো অইযিবোগি ‘দেখার হাওরমারা’ বিমান বন্দর,সুনামগঞ্জ।
–আমি সামনর বার লন্ডন থাকি আইলে অখানো আইয়া নামতাম পারমু। এর ভিতরে বিমান বন্দর চালু অইজিবোগি, কিতা খও?
–অয়।
–মন্ত্রী খইছইন, আসির কিতা আছে, বিমান বন্দর আইজ অয় না খাইল অইব, নতুন প্রজন্ম দেখবো। এতে আসির কিতা আছে। কথাটি যখন এক সভায় মন্ত্রী তুলেন, তখন ফিক করে হেসে দেন কয়েকজন, নেতা—পাতিনেতা, এমপি—টেমপিরাও। শেষ পর্যন্ত হাসির রোল।
সুনামগঞ্জ ভাটির দেশ, খালি পানি আর পানি। ইকানো বিমান বন্দর করতে গেলে ভরাট করতে হবে বিশাল বিশাল হাওর। সুনামগঞ্জের লগে দেখার হাওর। ইংলিশ পত্রিকাঅওয়ালারা লিখে ‘ডেকার হাওর’। ঢাকার কোন কোন বাংলা পত্রিকাও লেখে ‘ডেকার হাওর’। নাম নিয়া আরেক জঞ্জাল। হাওর যখন ভরাট অইবে, তখন তো হাওরটা মারা—ই গেল।
‘দেখার হাওরমারা’ বিমানবন্দর নামটাই যুক্তিযুক্ত।
আছানমারা’য় অইবে ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মদনপুরে দিরাই রাস্তার মুখে হবে ‘বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ, আর হাসপাতাল অইবো শান্তিগঞ্জ। মন্ত্রীর জোর দেখে কে। বরাবর দেখে আসছি– মেডিক্যাল কলেজের পাশেই হয় হাসপাতাল, ছাত্রদের পরীক্ষা—নীরিক্ষা প্রেক্টিক্যাল ক্লাশ তো হাসপাতালেই চলে। কিন্তু মন্ত্রী হাসপাতাল বানাবেন তার বাড়ি-শান্তিগঞ্জ, আর মেডিক্যাল কলেজ পাঁচ মাইল দূরে সুনামগঞ্জের কাছে মদনপুর। তবে সবগুলোই দেখার হাওরের পশ্চিম পারো।
এখন লাগছে রেল লাইন লইয়া যুদ্ধ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর এমপিরা খইন অইব ছাতক থাকি দোয়ারাকাজার অইয়া সুনামগঞ্জ। আর পরিকল্পনামন্ত্রী খইরা তানর বাড়ি শান্তিগঞ্জ অইয়া সুনামগঞ্জ, কী তিলিসমাত।
তর্ক চলতেই থাকে, যে তর্কের শেষ নেই, সেই সকল লোক তর্কেই থাকুক। ভাবতে থাকেন আলিম মিয়া।
ঘুমের ভেতর আলিম মিয়ার চোখ পড়ে সাইনবোর্ডটি পোঁতার জায়গাটিতে। এক্কেবারে আছানমারার সামান্য উত্তরে, উঁচা স্থানটিতে। কাঁধ থেকে নামালেন ৬ফুট লম্বা ও ৪ফুট প্রস্থ বিশাল সাইনবোর্ড। দুটি বাঁশ পুঁতে নিলেন। নরম মাটি,বাঁশ পুঁততে দেরি হয়নি।
আছিয়াকে বললেন আলিম মিয়া,–একটু সোজা করে ধরো,বাঁশটা ভাল করে পুঁতে নিই, যাতে কেউ উপড়ে ফেলতে না—পারে।
আছিয়া বললো, সারা জীবনে এই একটা ভাল কাজই করলা তুমি। কাল থেকে শুরু করা যাক ‘জলকন্যা’ হোটেলের কাজ–কী বল।
দম দেও। একটু শ্বাস নিয়ে আছিয়া বললো, সাইনবোর্ড আর কে ফালায়? কোন বেটা আয় দেখি।