তীর্থঙ্কর মৈত্রের কবিতা

আমি তো পারিনা
আমি তো পারিনা চাবুক বসাতে ফুলে,
আমি তো জানিনা করুণ দু’গালে হাত !
স্রোতের ওপর নুয়ে পড়া মাথা তুলে
নির্ভয়ে দুটো কুড়াতে চেয়েছি ভাত।
টিনের থালারা বেজেছে যখন ক্রোধে;
গ্লাসেও জমেছে করুণা চোয়ানো জল।
ঢেলে দিয়ে তাকে গোলাপ চারার বোধে;
বলেছি — ‘এবার,মুছে যাক রসাতল !’
আমি কি ফিরে যাবো ফের !
ফিরে কি যাবো ফের ঘুড়ির সুতোর মতো সরু স্মৃতি ধ’রে
সোনালী ফুলের রূপে জেগে ওঠা বৈশাখী গ্রাম্য দুপুরে !
ঘুমের ভানের থেকে ফের, মায়ের বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে চুপি
ঢিল ছুঁড়ে নামাবো আমের মতো থোকা থোকা সরল জীবন।
ঘষা ঝিনুকের মতো ধার হ’য়ে উঠি ! কান পাতি ; পাঠশালার সরব পাঠে
কারা যেন ছুটি পেলো ; তালের চাটাই হাতে ছুটে যায়—
দিগন্ত মাড়িয়ে !
কারা যেন করবী ফুলের গাছে শিকার শিকার খেলে ; গুলির শব্দ…
কিশোরবেলার তারা মরে যায় হরিণের তীব্র আর্তনাদে?
আমি কি ধুলোর লুটানো সেই কিশোর হরিণ ? জিয়ল
পাতার পাখি বুনে বুনে সারাটা দুপুর; চলে যাই বিকেলের দিকে !
খেজুর পাতার চরকি মন্দিরের লুকোনো জানলায়;
চোখের কোণে তার খোঁজ, আমাকে কিশোর রাজা করে দেবে ফের?
আমার ঘুমের কাছে রাজকন্যার মুখ, নীল ঘোড়া ;
দৈত্যনিধনে যাবো ভ্রমরের পিছু ফের রাংতা জড়ানো তলোয়ারে !
আমি কি ফিরে যাব ফের ‘দুলাল’ নামের পাশে
মায়ের ডাকের মতো তীব্র টান পেয়ে ? আমি কি ফিরে যাবো ফের !
আমার আত্মার রূপ
কৈশোর দিনের মতো সরল সহজ কিছু পেয়ারার ফুল
সকাল উঠোন জুড়ে ছড়িয়েছে সাদা সাদা—পয়লা বৈশাখে ।
এতদিন পর বাড়ি ফিরে আজ, মনে হলো— ‘আমি ক্লান্ত নাগরিক ;
আমার-ই আত্মার পাশে আমি এসে দাঁড়িয়েছি ফের। ‘
ঐতো হাঁসের ঝাঁক, শিশুর পুতুল প’ড়ে মোরাইয়ের পাশে ;
জামের গাছের কাছে দু’দণ্ড দাঁড়ালে, যেন জন্মান্তর হবে ;
শীতল জলের মত মন পাবো তরতর ব’য়ে যেতে সারাটা জীবন !
টালীর মন্দির ঘর,ছড়ানো বাদাম পাতা —বারান্দা ডুবানো ।
দোয়েলের পালক প’ড়ে ; যেন আমি, বহুদিন আগের এক ;
র’য়ে গেছি, এই সব আমারি আত্মার রূপ ; রূপান্তরিত গ্রাম্য জীবনে ।
রান্না ঘরের চালায় ঝুঁকে পড়া বাতাবির ডালে প্রথম রোদ্দুর আমি ;
শালিকের ঠোঁটে খড়, সেও যেন আমাকে-ই নির্মাণের পুনরায়োজন।
গরুর গাড়ির চাকা, ভাঙা লাঙ্গলের ফাল, সব-ই যেন জীবন্ত আমি !
তবু , কোথায় যেন পাল্টে গেছি শরীরে ও মনে ! শহরের তীব্র হাওয়া নিয়ে
আমি কাক, উড়ে উড়ে ফিরি আজ পচাগলা জগতের খাদ্য সন্ধানে !
কতটা পাল্টেছি আমি? এখন আমার আর দড়িছেঁড়া বাছুরের উপমা সাজে না !
এখন আমার আর কাউওডিমি লতার মতন সরল নিঃশ্বাস নেই ;
নেই বৃদ্ধি, কবাডি কোটের পাশে বিকেলের নাড়িছেঁড়া টানে !
প্যান্টের দড়ির গিঁটে জগতের সব জটিলতা বুঝে ফেলা মন নেই !
আমি আজ শহরের ক্লান্তিকর সন্ধ্যার আলোয়, এঁটো চায়ের পাত্র যেন ;
কথাবার্তা হাবভাবে কৃত্রিম হাওয়ার দূষণ !
আজ এতদিন পর বাড়ি ফিরে বৈশাখের প্রথম সকালে,
মনে হ’লো— ‘রাজা ফিরে পেলো তার হারানো রাজ্য আর দুখিনী মাতাকে ! ‘