গল্প: হাজার পায়ের মানুষ

গল্প: হাজার পায়ের মানুষ

হাজার পায়ের মানুষ
ঋভু চট্টোপাধ্যায়

এ’লাইনে ট্রেনে এখন খুব ভিড়, অন্তত সুন্দরীর তাই মনে হচ্ছে।আগে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর পর সবাই উঠলে ধীরে সুস্থে লেডিস কামরাটাতে উঠত, ভিড়টা একটু কম থাকে।তাছাড়া প্রতিদিন যাতায়াত করবার জন্য অনেকের মুখ চেনা হয়ে গেছে, কেউ না কেউ হাতটা ধরে উঠিয়েও দেয়।ডেলি প্যাসেঞ্জার দিদিরা প্রায় সবাই সুন্দরীকে চেনে।অনেকেই ভালোবেসে কথা বলে, টাকা না দিলেও বিস্কুটের প্যাকেট বা রুটি কেক খেতে দেয়।দু’একদিন দেখতে না পেলে জিজ্ঞেস করে,‘কি’রে এত দিন কোথায় ছিলিস, দেখতে পাইনি?’সুন্দরী এক গাল হেসে একটা উত্তর দেয়,‘শরীল খারাপ।’
খুব স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না, জড়িয়ে যায়, জিবের সাথে দাঁতের, দাঁতের সাথে গলার একটা কেমন যুদ্ধ হয়, সুন্দরীর তখন আরো কষ্ট হয়।লেডিস কামরার দিদিরা বোঝে, বলে ওঠে,‘ঠিক আছে, তোকে আর বলতে হবে না, বুঝলাম।’
তবে সুন্দরীর নামটা প্রথম কে দিয়েছিল তা ভুলে গেছে।নিজের কি কোন নাম ছিল?সেটাও মনে পড়ে না।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সারাটা প্ল্যাটফর্ম এমনি ভাবেই পাছা ঘসে ঘসে ঘুরে বেড়ায়।কাউকে কখনও মা বা বাবা বলেও কোনদিন ডেকেছে বলে মনে পড়ে না।শুধু এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের একটা কোণে এক বুড়ি থাকত, ও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত,‘এই খেয়েছিস?চান করেছিস?’বুড়িটা কোন নাম ধরে ডাকত?মনে পড়ে না, এই মেয়ে এই মেয়ে বলত।বুড়িটাও একদিন মারা গেল।তারপর থেকে আর খেয়ে নে, চান কর, বলবার কেউ নেই।এটা সুন্দরী বুঝে নিয়েই সকাল হলেই পাছা ঘসে ঘসেই লাইনের ধারে গিয়ে হাগা মুতা, সেরে ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ে।স্নান করে, তাও সপ্তাহে এক আধবার।একটাই ফ্রক পরে, স্টেশনে কেউ একবার দিয়েছিল, মনে পড়ে না।বছরে এক দুবার কেউ না কেউ স্টেশনের বাইরে জামাকাপড় দিতে আসে।সুন্দরীও একটা জামা পায়,প্যান্ট পায়।প্যান্ট পরতে পারে না, হাগতে মুততে খুব কষ্ট হয়।মাসের কয়েকটা দিন পরতে হয়, না হলে জামাতে দাগ লাগে।লেড়িস কামরায় একটা দিদি দেখে একবার ছোট বালিশের মত কি একটা দিয়েছিল বেশ নরম বলেছিল,‘এই সময় ব্যবহার করবি।’
একগাল হেসে সুন্দরী জিজ্ঞেস করে,‘তু তলি গেলে?’
-আমি চলে গেলে এই কামরাতে যারা থাকবে তাদের কাউকে বলবি, কিনে দেবে।আমি যতদিন আছি ততদিন আমিই দেব। সেটাই প্রথম আর শেষ, তারপর থেকে দিদিটাকে আর দেখতে পাইনি সুন্দরী।মনে মনে গাল দিয়েছিল,‘কেই বা ভিখারির কথা মনে রাখে?’
একদিন আরেকটা দিদি জিজ্ঞেস করে,‘হ্যাঁরে, তোর বয়স কত হল, এবার বিয়ে কর।’
বিয়ের কথা শুনে সুন্দরীর হাসি আসে,‘বিয়ে কি?’
প্ল্যাটফর্মে নেমেই মোটা বউকে জিজ্ঞেস করতেই হেসে বলে,‘বিয়া বটে বরের সাথে থাকা, শোওয়া, ছেলে পিলে তুরও হবে একদিন।তুই বল কাকে ভালো লাগে ?’
সুন্দরীর মন খারাপ হয়।কে তাকে বিয়ে করবে, ভালো করে শুতেও পারে না।পা’দুটো সব সময় গুটিয়ে রাখতে হয়।তাও সেদিন রাতে ওয়েটিং রুমে শুতে যাবার আগে চুল ছাড়ায়, আয়নায় মুখ দেখে।পাশে বসে থাকা পুঁটুলি বুড়ি সব দেখে হাসে, তারপর নিজের পোঁটলা থেকে একটা কি বের করে কপালে লাগিয়ে দিয়ে বলে,‘দ্যাখ এবার নিজের মুখ খানা।’সুন্দরী সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আবার আয়নাতে দেখে।সত্যি কি দারুন দেখতে লাগছে।নিজের কাছে নিজেই অচেনা অজানা হয়ে ওঠে।প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে অনেকজন এভাবে সেজেগুজে যাতায়াত করে।ট্রেনেও অনেককে এভাবে যেতে দেখেছে।লেডিস কামরাতেও অনেকে এই রকম ভাবে সাজে।ভালো লাগে দেখতে।সুন্দরীরও নিজেকে ভালো লাগতে আরম্ভ করে।পোটলা বুড়িকে জিজ্ঞেস করে,‘কি বদে?’ -সিদুঁর, আমার বিয়েতে পাওয়া কৌটা, এখনও রেখে দিয়েছি, তুই কি হিন্দু না মুছলমান ?
সুন্দরী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
-সেতো সত্যি বটে আমিও তো এসে থেকে তোকে এমনি ভাবেই দেখছি।
সুন্দরী আর কিছু বলে না, দুটো পা মুড়ে শুয়ে পড়ে।ঘুম আসে না, সারারাত ওয়েটিং রুমের আলো জ্বলে, সুন্দরী সেই আলোর দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে।ট্রেন থেকে একজন নামে, চকমকে ড্রেস পরে আছে, মাথায় সুন্দর টুপি, হাতে খাবার।সুন্দরি পাছা ঘসে তার পাশে দাঁড়ায়। লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে বুঝতে পারে খুব খুশি।প্ল্যাটফর্মের আরো অনেকে আছে।মোটা বউ, কালো বউ, কালো মেয়ে, বাঙাল বউ, সবাই আছে।সবাই খাচ্ছে, ভারি মজা।সবারই খুব মজা, তারপর হাতে পায়ে জল ছেটায়, স্নান করে, সুন্দরীর গায়ে জল লাগে।ঘুম ভেঙে যায় সুন্দরীর, তাড়াতাড়ি উঠে বসে।ওয়েটিং রুম মুছতে এসেছে, খুব মেজাজ ছেলেটার। সব সময় খ্যাঁক খ্যাঁক করে।সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বলে,‘ওঠ, তুর বাপের জায়গা, ঘুমাচ্ছিস যে বড়?’ সুন্দরী কিছু বলে না।আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে যায়।বেরোতে তো হবেই, না হলে খাবে কি করে?ট্রেনে উঠতে হবে,তারপর পুরো ট্রেনটা ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা চাওয়া, তবে যে মুখে কিছু ওঠে।

ওয়েটিং রুমের একপাশটাতে একটা কাগজ পেতে চারদিকটা ফুল ছড়িয়ে সুন্দরীর ফুলশয্যা তৈরী করেছে প্ল্যাটফর্মের বাকি সবাই।সব টাটকা ফুল নয়, ফেলে দেওয়া বাসি ফুল, সঙ্গে কিছু পাতা আর তার সাথে রেলের বাগান থেকে তোলা কিছু টাটকা ফুল।এর বেশি কিছুর ব্যবস্থা হয় নি।করবেই বা কি করে?একটা চাকা লাগানো কাঠের পাটার ওপর বসে বসে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘোরা।হাঁটুর ওপর থেকে কাটা দুটো পায়ে এর থেকে বেশি আর কিছু হতেও পারে না।কয়েক বছর আগে ট্রেনে পা’দুটো দিয়ে দেওয়ার পর বউ ছেলে মেয়ে মিলে একদিন আসামের এক স্টেশন থেকে একটা ট্রেনে তুলে দেয়।সেখান থেকে আরো অনেক স্টেশন ঘুরে অবশেষে এখানেই পাকাপাকি ভাবে থাকতে আরম্ভ করে।এই স্টেশনে কেন নেমেছিল মনে করতে পারেনা।তবে স্টেশনের সবাই বেশ ভাল, মিরাজকে তারাই থেকে যেতে বলে।বৃষ্টি বাদলের দিনে সেডের নিচ অথবা ওয়েটিং রুম, দিব্যি থাকছে।স্টেশনের বাইরে একটা চায়ের দোকানের দাদা কাঠের পাটাতে চাকা লাগিয়ে মিরাজের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেয়।এখন বাঁ’হাতের কনুইএর নিচে একটা হাওয়াই চটি লাগিয়ে চলতে বেশ সুবিধা হয়।তবে এখনও ওভারব্রিজ উঠতে বা নামতে বেশ কষ্ট হয়।ট্রেনে চাপেনা, কোন একটা প্ল্যাটফর্মের একটা কোণে বসে যায়, নামতে উঠতে প্যাসেঞ্জাররা টাকা দেয়, মোটামুটি চলে যায়।এই স্টেশনে আসার পরেই সুন্দরীকে দেখে।সেও হাঁটতে পারে না, পাছা ঘসে ঘসে জায়গা পরিবর্তন করে, ভালো করে কথা বলতে পারে না, তাও মিরাজের ভালো লেগে যায়।দেখে মনটা কেমন যেন মোচড় দিযে ওঠে, দেশে নাদিরা কেমন আছে কে’জানে, আরেকটা নিকা করে নিয়েছে হয়ত।
মিরাজ এই স্টেশনে আসার কয়েকমাস পরেই সুন্দরীর কথা মোটাবৌ কে জিজ্ঞেস করে।এখানে এসে মিরাজ সব নাম শোনে, ভুতুর বৌ, বাঙাল বুড়ি, আর কারও নাম জানে না, তবে সবার সাথে কথা বলে।ভুতুর বৌকে জিজ্ঞেস করতেই বৌএর মুখটা চকচক করে ওঠে, জিজ্ঞেস করে,‘মনে লেগিছে?’মিরাজ তখনও উত্তর বুঝতে না পারলেও ভালো লাগা কথাটা বুঝতে পারে।কোন উত্তর দেয় না।পরেরদিন থেকে ভিক্ষা করবার ফাঁকে সুন্দরীকে দেখতে আরম্ভ করে।থাকা, কোথায় শোয়া, সকালে কোন লাইনের ধারে যায়, কোথায় খায় সব নজরে রাখতে আরম্ভ করে।তারপর একদিন কথা বলে ভালো লাগে, মিরাজও ঐ সুন্দরী নামেই ডাকতে আরম্ভ করে।কয়েকদিন পর প্ল্যাটফর্মের বাকি সবাই চেপে ধরে, নিকা।
প্ল্যাটফর্মে এর আগেও কয়েকজনের নিকা হয়েছে।নিকা বলতে একসাথে থাকা।কে হিন্দু, মুসলিম জানা নেই, প্ল্যাটফর্মে আসার পর থেকে মিরাজ শুধু নামটাই যা ধরে রেখেছে বাকি সব তো সেই আসামে, অবশ্য মাঝে মাঝে কথার ফাঁকে ‘হে খুদা, হে আল্লা’ বলে ফেলে।প্রথম প্রথম স্টেশনের কাছাকাছি কোন মসজিদে নামাজ পড়তে যাবার কথাও ভেবেছিল।
এখানে অনেকেই ছোট ছোট জায়গায় একসাথে থাকে, সংসার করে, ছেলে মেয়ে জন্মায় তার পর হয় বর পালায়, না হয় বউ, ছেলে মেয়ে মিশে যায় স্টেশনের ভিড়ে, নেশা করা আরম্ভ করে।প্ল্যাটফর্মের উপর অথবা ওভার ব্রিজের একটা কোণেই বেশির ভাগ সংসার পাতে।এদিকটাতে অত কেউ আসেনা।রাত নামলে আরো ফাঁকা হয়ে যায় চারদিক।মিরাজ আর সুন্দরীকে সেই অন্ধকারে রেখে দেবার সময় সবাই মুচকি হাসে।একজন বলে ওঠে, ‘দেখিস আবার নিচে পড়িস না।’মিরাজও দাড়ির ফাঁকে হেসে ওঠে।সুন্দরী মিরাজের পাশে বসে, গলায় একটা মালা।মিরাজের সামনে তার দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা এসে দাঁড়ায় তার মাঝে নাদিরা।তাও সুন্দরীর গালে হাত দেয়, নাদিরা মুচকি হাসে, সুন্দরী হাত সরিয়ে চাপা গলায় বলে,‘এই এমন করে কেউ গায়ে হাত দেয়?’
-সে’কিরে আমি যে তুর…..
-তুই বর তইলে আত দে।
মিরাজ গায়ে হাত দেয়, কাঠের পাটা থেকে নেমে শুয়ে পড়ে, পাশে সুন্দরী।অন্ধকার আঁকড়ে ধরে দুজনকে।কিন্তু সেই উত্তেজনা কই?নাদিরারও তো ছেলে মেয়ে আছে।মিরাজ তো মরদ ছিল, কিন্তু এখন?ওদিকে সুন্দরী তখন রেলগাড়ির মত, ঝমঝম ঝমঝম।মিরাজকে জাপটে ধরে, আঁচড়ায়।

ঘুমটা একটু তাড়াতাড়িই ভাঙল মিরাজের, অন্যদিন সুন্দরী ঘুম থেকে তোলে।নিজে রেল লাইনের ধার থেকে এসে দুজন মিলে কিছু খেয়ে নেয়, তারপর সুন্দরী ট্রেনে চেপে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়ায়, আর মিরাজ বসে প্ল্যাটফর্মের একপাশে।এভাবেই মাস দুই কাটে।সুন্দরী তো কোন দিন উঠতে দেরি করে না।মিরাজ কিছু সময় বসে থাকে, এদিক ওদিক তাকায়।না, সুন্দরীর দেখা নেই।চারদিকে হাল্কা আলো ফুটেছে।প্ল্যাটফর্ম আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে।মিরাজ এবার ওঠার চেষ্টা করে, অসুবিধা হয়।পায়ের নিচ থেকে দু’টো পা কাটা, একবার শুলে একা একা উঠতে পারে না।সুন্দরী চলতে না পারলেও মিরাজের হাতটা একটু ধরে।সেদিন একাই বহু কষ্টে কনুইটা মাটিতে রেখে উঠে বসে, কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে কাঠের পাটাটার উপর বসে।হাতদুটো মাটিতে ভর দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যায়।সিঁড়ি দিয়ে নামতে অসুবিধা হয়।একটা একটা করে সিঁড়ি ধরে ধরে নামে তারপর বসার কাঠটা নামায়।নিচে নেমে আর একবার ওদিকে যায়।প্ল্যাটফর্মের বাকি ভিখারিরা তখনও ওঠেনি।কয়েকটা কুলি মিরাজকে চেনে, তাদের দেখতে পেয়েই সুন্দরীর কথা জিজ্ঞেস করে।জিজ্ঞেস করে চায়ের দোকানে স্টেশনের বাইরে, বড় রাস্তায়।একটা বিদঘুটে কষ্ট মিরাজের শরীরের জমিটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।মাত্র এই দুমাস তারা এক সাথে থাকছে, রাতে হাল্কা হাওয়া আর তারার চাঁদোয়ার নিচে শুয়ে শুয়ে মিরাজ সুন্দরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, সুন্দরী গলা ধরে ঘুমিয়ে যায়।শরীরের ভিতরে একটা ভালো লাগার স্বপ্ন তৈরী হয়, শরীর ছুঁয়ে থাকে ভালোবাসা।স্টেশনে ফিরে আসতেই সামনের চায়ের দোকানের ছেলেটা মিরাজকে ডেকে বলে,‘সুন্দরীকে একটু আগে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’
-হায় আল্লা!কেন?
-কাল রাতে কোথায় ছিলিস?ওকে এরম করল, তুই বুজিস নাই?
-এমন করল মানে?কি করল?
-তুই কিছুই জানিস না?মরি ছিলিস নাকি?
-আমি তো পাশেই শুয়েছিলম।
-যা স্টেশনের ওদিকে যা উয়ারা রইছে।
মিরাজের শরীরের ভিতরটা গুমডে ওঠে, কাল কি বেশি ঘুমিয়েছে?কিন্তু ওদিকে যাবে কিভাবে ওভারব্রিজের ওপরে উঠে যেতে সুবিধা হবে, না হলে আবার ঘোরা পথ, কিন্তু ওভারব্রিজে কে ওঠাবে?মিরাজ চায়ের দোকানের ছেলেটার দিকে করুণ ভাবে তাকিয়ে বলে,‘আমাকে একটু পৌঁছে দিবি, ঘুরে যেতে অনেক সময় লাগবে।’
-তুই এখন ওদিকে গিয়েও বা কি করবি, তার থেকে কাউকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যা।
-তুই আমাকে লিয়ে যাবি ?
-এখন!সকালেই তো বিক্রি, কিভাবে যাব বল,তুই একটা টোটো ধরে চলে যা।হাসপাতাল বললেই সবাই নিয়ে যাবে।
মিরাজ কিছু সময় দাঁড়ায়, তারপর বলে,‘ঠিক আছে তবে আমাকে কিছু টাকা দে, যা হোক একশ, দুশ।আমার সব টাকাতো সব পোঁটলার ভিতর, আবার উঠতে হবে।’

তলপেটে খুব ব্যথা, বুকের দুদিকেও খামচানোর দাগ, ব্যথা, কেমন যেন জ্বালা ভাব।তলপেটের নিচটাও জ্বলছে।পিঠে হাতে ছড়েও গেছে।সারা শরীরে চাপা যন্ত্রণা।দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।হাত তুলে মোছার মত অবস্থা নেই।বাঁহাতে ইঞ্জেকসেনের কি সব পাইপ।চোখ দুটোও বন্ধ হয়ে আসছে।সারাটা শরীরে ঘুম।কাল রাতেও তো ঘুমিয়ে ছিল। তারপর কারা যেন স্টেশনের ওপারে নিয়ে গেল, কিছুই বুঝল না, যখন বুঝল তখন শরীরে কোন জামা নেই, দুজন দুটো হাত চেপে ছিল।আরেকজন শুয়েছিল শরীরের ওপরে।নিচ থেকে ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ছিল সারাটা শরীরে।খুব কষ্ট।অন্ধকার জাপটে রেখেছিল চারপাশ, চারদিকে লোকগুলোর মুখে কাপড় বাঁধা।কাউকে চিনতে পারেনা, চেষ্টাও করে না।চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়েছিল।ব্যথা ব্যথা, কেমন একটা শিরশিরে ভাব,তারপর আবার অন্ধকার।হাসপাতালে পুলিশ এনেছিল।রাস্তাতেও জিজ্ঞেস করে, কাউকে চিনতে পেরেছ?’
সুন্দরি ঘাড় নাড়ে, কষ্ট হয়, সারাটা শরীরে ব্যথা।হাসপাতালের দিদিটা ওষুধ লাগায়, জিজ্ঞেস করে,‘কাকে খবর দেব?’
সুন্দরী কথা বলতে পারে না, শরীরে ঝিমানি ভাব আসে, অন্ধকার ঘুম নেমে আসে।
যখন চোখ দুটো খোলে চারদিকে সন্ধা।একটা দিদিমণি সুন্দরীর চোখ খোলা দেখেই কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,‘কেমন আছো?’সুন্দরি জবাব দেয় না তবে চোখ মুখে একটু আরাম ফুটে ওঠে।ডাক্তার দিদি মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,‘দেখো কে এসেছে?’
সুন্দরী ঘাড় ঘোরায়, দেখে পায়ের কাছে মিরাজ,সেই কাঠের ওপর বসে আছে।চোখ দুটো সুন্দরীর দিকে।ডাক্তার দিদি সুন্দরীর গায়ের চাদরটা টেনে দিয়ে বলে,‘নাও তোমরা কথা বল।’অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে, তোমার বর,তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে।মিরাজ সুন্দরীর কাছে আসে।বেডটা অনেকটা উঁচু, ঘাড় তুলে সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হয়, তাও তাকিয়ে থাকে, একনাগাড়ে।কিভাবে, কত কষ্ট করে হাসপাতালে আসে, কিভাবে সুন্দরীকে খুঁজে বের করে, কিভাবে ঐ কাঠের পাটার উপর চেপে হাসপাতালের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছে, তার সবটা বলতে আরম্ভ করে।সুন্দরী অর্ধেক কথা শোনে, অর্ধেক কথা দু’কান ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়।শুধু চোখ দুটো থেকে মরণ ঘুম যেতে চায় না।

মাস দুই পেরিয়ে যায়।মিরাজ আর সুন্দরী আবার আগের মতই ভিক্ষা আরম্ভ করে, তবে সুন্দরী আর ট্রেনের ভিতর ঘুরতে পারে না।হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরেও তাকে আরেকবার ভর্তি হতে হয়েছিল, আচমকা বমি, আরম্ভ হয়।ভয় পেয়েছিল মিরাজ, তাড়াতাড়ি সেই হাসপাতালে যায়।ডাক্তারবাবু বলেন,‘একটা বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচলে।’ আর কাউকে কিছু বলেনি।তবে প্ল্যাটফর্মে অনেকে সুন্দরীকে অনেক কথা বলেছে, অনেক কিছু জিজ্ঞেসও করেছে।গুজিবুড়ি সোজাসুজি একদিন বলে,‘তোর যদি হাত পা ঠিক থাকত, কিছু টাকা পেতিস, এখানে তো সবাই টাকা নেয়, তুই মাঝে ফাঁকালি।’একজন বলে,‘পেটে কিছু আসেনি, নিয়ে বসলে বেশি ভিক্ষা পেতিস।’
সুন্দরীও এখন অনেক কিছু বোঝে।পা নেই কিন্তু কোমরের নিচটা আছে, ভালো করে কথা বলতে পারেনা, কিন্তু বুকের দুটো মাংস পিণ্ড আছে, এখনও কাটা দাগ, চাপা কষ্ট, শুকায়নি, এখন মিরাজও হাত বুলিয়ে দেয়, আর মাঝে মাঝে পেটে হাত দিয়ে ফোলা দেখে।সুন্দরী এখনও বেশি ক্ষণ বসে থাকতে পারে না,শরীর এখনও দুর্বল, একটা জায়গায় বসে, নড়া চড়া করতে করতে কষ্ট হয়।রাতে ওভারব্রিজের উপর দুজনা পাশাপাশি শুলেও আতঙ্ক তাড়া করে, ঘুমাতে পারে না, অন্ধকার ওভারব্রিজে আছড়ে পড়ে, নিচ দিয়ে ট্রেন চলে।মিরাজের পাশে প্রতিরাতে নাদিরা আসে,ওভার ব্রিজের উপর ছেলে মেয়েরা খেলতে আরম্ভ করে, মিরাজ নাদিরার দিকে তাকিয়ে সুন্দরীর গায়ে হাত দিয়ে অন্ধকারে ডুবে যায়।