গল্প: জীবনের জমাখরচ এবং যৌবন

জীবনের জমাখরচ এবং যৌবন
সালেহা চৌধুরী
বাড়িটাতে সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। মনজুর হোসেন ষোল বছর পর বাড়িতে ফিরে আসছেন, চিরদিনের জন্য। বেয়াল্লিশ বছর বয়সে পাঁচ বিঘা জমি বন্ধক রেখে, দালাল ধরে, তিনি মিডলইস্টে চলে গিয়েছিলেন। এখন তার বয়স আটান্ন। এর মধ্যে পাঁচ বিঘা জমি ছাড়াতে তার প্রায় পাঁচ বছর লেগেছে। এরপর আরো পনেরো বিঘা করতে প্রায় দশ বছর। এক বছর কেবল টাকা জমিয়েছিন দেশে গিয়ে একটা ব্যবসাপাতি করবার জন্য। এর মধ্যে একবারো তিনি দেশে আসেন নি। আসতে পারতেন। আসেননি। ভেবেছিলেন — সব হয়ে গেলে তারপর দেশে যাব, একবারে। যেখানে জমিতে এখন বছরে প্রায় চার রকম ফসল ফলে, জমি আর আগের মত বসে থাকে না, সেঁচ ব্যবস্থার কারণে জমিতে সারাক্ষনই কিছু না কিছু চাষবাস হয় সেখানে কুড়ি বিঘার আয় অনেক। একটা মেয়ে আর একটা ছেলে রেখে গিয়েছিলেন। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছে ওর মা। প্রায় চার লাখ টাকা পাঠাতে হয়েছে তাকে। এটা পাঠাতে না হলে হযতো তিনি আর একটু আগে আসতে পারতেন দেশে। মেয়েটা ভালোই আছে। পাঁচ বছর হলো বিয়ে হয়েছে তার। ছেলেটা পড়াশুনা অল্পদিনের ভেতর শেষ করে ফেলবে।
বাড়িটায় দুটো নতুন ঘর করেছে হালিম্।একটাতে ছেলেটা থাকে। আর একটা বৈঠকখানার মত। হালিমা সকাল সকাল উঠেছে। বেশ একটু খুশী খুশী মন তার। ফলে বাতের ব্যথার কথা তার তেমন মনে নেই। তবু কাজের মেয়েটা এসে এক ফাঁকে তার্পিন তেল মালিশ করে গেছে।
আপনি তো মনজুরভাইকে বলেননি আম্মা আপনার যে বাত ধরিছে। কেন বলেননি?
সেটা কোন বলার কথা হলো।
ইংকা দেখলে তার মন বেজার হবি না? খারাপ লাগবি না?
লাগলে কি করবো। কাজের মেয়েটা বাতের তেল মালিশ করে, চুল আঁচড়ে দিয়ে চলে গেছে।একটা মেয়ে লাগিয়ে সারা বাড়ি পরিস্কার করছে ওরা। ছেলে ঢাকা থেকে একটা বাড়ির নামের ফলক নিয়ে এসেছে। বাড়ির নাম — বায়াতে মনজুর। সেটাও মায়ের বাতের মত বাবাকে জানানো হয় নি। বাড়িটায় নতুন করে রং করিয়েছেন হালিমা। চাপকল এবং বাথরুমটাও নতুন। সব মিলিয়ে একটু সুন্দর পরিচ্ছন্ন ভাব আছে বাড়িটায়। বিশ বিঘা জমি। মাসে মাসে পাঠানো দশ হাজার টাকা। সেগুলো পাঠাতে মনজুরু হোসেন ওখানে কি পরিমান কষ্ট করেছে তা হালিমার বাতের মত চিরকালই গোপন রেখেছে ওর স্বামী। আজ গোশ আর পোলাও খেলাম। আগামিকাল বিরিয়ানি খাব। এমন কথাইতো বরাবর বলেছে মনজুর। বলেনি কতগুলো মানুষ একটা বাড়ি শেয়ার করতো সে কথা। বলেনি —কত সব অডজব করবার কথা। তারা এক্সপ্লয়টেড শ্রমিক। তারা বাংলাদেশ নামের এক গরীব দেশের শ্রমিক। সব কথা হালিমাকে বলা হয়নি। হালিমা জানে প্রতিদিন পরোটা, বিরিয়ানি, পোলাও, কোর্মা খাওয়া স্বামীর কথা। জানে যারা ছুটি ছাটাতে বেড়াতে যায়। ইদে পরবে খুব হৈ চৈ করে।
আমি গেলে আর আসবো না হালিমা। কাজেই আমি এখন যেতে চাই না। সব যখন হয়ে যাবে তখন যাব।
সব? মানুষের জীবনে সব কিছু হয়ে যাওয়া কি এতই সহজ? পাঁচ বছর পর যখন বন্ধক দেওয়া জমি গুলো ছাড়ানো হলো তখন একবার আসবার কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু কিন্তু মনে ভাবলেন— গেলাম জমি বন্ধক রেখে। পাঁচ বছর পর জমি ছাড়ালাম। এই দুই কারণে কি আমার বিদেশে আসা? না। অন্ততপক্ষে আরো দশ বিঘা জমি না হলে দেশে ফেরা ঠিক হবে না। তারপর আরো দশ বিঘা যখন হলো জানলেন ঠিক দশবিঘায় একটা সংসার ঠিকমত চলে না। বিশ বিঘা হলে ভালো। তখন লেগে গেলেন বিশ বিঘা জমির টাকা পাঠাতে। মেয়ের বিয়ের সময় দুই লাখ টাকা পাঠাতে হয়েছিল। যেটা শোধ দিতে দুই বছর গেল। এরপর কলপাড় পাকা করা, বাথরুম, স্যানিটারি পায়খানা, একটা রঙ্গিন টেলিভিশন, দুটো বাড়তি ঘর। এসব করবার টাকা সংগ্রহ হলে জানলেন পনেরো বছর পার হয়ে গেছে। তখন ঠিক করলেন দেশে আসবেন। হয়তো ঠিক করতেন না কিন্তু শরীরটা কেমন যেন আগের মত আর কথা শুনতে চায় না। বিল্ডিং সাইটে সব তরুণ শ্রমিকের ভিড়। তারমত এমন একজন ঠিক কাজ পায় না। চাকরি বদলালে বেতন যায় কমে। এই সব যখন খুব ভালো করে জানলেন তিনি দেশে ফিরবেন বলে মনস্থির করলেন।
আটান্ন বছরের একজন। একটা দোকান দেবেন। সংসারের ভেতরে থাকবেন মনজুর হোসেন। যেমন সবাই আশা করে।
হালিমাও বিরিয়ানি খাওয়ার মত নানা গল্প করেছেন স্বামীকে। বলেছেন — মেয়েটা সুখে আছে। ছেলেটা পড়ছে কমার্স। বি বি এ। এবার এম বি এ করছে। বাড়িতে দুটো নতুন ঘর হলো। বাথরুম পাকা করলাম। তোয়ালে রাখার জন্য সুন্দর একটা র্যাকও করা হলো বাথরুমে। কিন্তু বলেন নি —নতুন বাথরুমে আছাড় খেয়ে পা ভেঙ্গে গেছে। যেটা ঠিক হতে প্রায় দুই মাস লেগেছিল। বলেন নি সামান্য একটা টেলিভিশনের জন্য মেয়েটাকে কতপ্রকার গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। তারপর তিনি বেশ একটা কষ্ট করে মেয়েটাকে একটা ছোট টেলিভিশন দেবার পর মেয়েটা এখন ভালো আছে। বলেন নি ছেলেটা শহরের কোন এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ও হয়তো এম বি এ করবার পর মেয়েটাকে বিয়ে করবে। কত কথা বলেন নি হালিমা। শীতের রাতে মনে পড়েছে স্বামীর কথা। যখন বয়সটা বত্রিশ থেকে আটচল্লিশ হলো সেই সব জীবনের একা থাকার দুঃখের কথা। বলেন নি —যারা স্বামী নিয়ে সংসার করে তাদের সঙ্গে তার জীবনের পার্থক্যের কথা। ভেবেছেন ভাতের কষ্ট যখন থাকে না সেটাই আসল সুখ। হয়তো কথাটা সত্যি। তারপরেও জারি নামে, মেঘ হয়, বিষ্টির রাতে কাঁথার ভেতরে একা লাগে, অন্ধকারে শেয়াল ডাকে, কোথাকার জিনপরি মশ মশ করে রাতের আঁধারে ছাদের উপর দিয়ে হাঁটে, ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে কোন সব মৃত আত্মারা। অসুখে একা লাগে। নানা যন্ত্রনায় একা লাগে। কতসময় একা থাকা বুকের ভেতরে বাজে। ভাত আছে, তারপরেও এসব হয়।
ছেলে মোবাইল করেছে— মা আমি আব্বাকে আনতে এয়ারপোর্টে যাব। আমার দু একজন বন্ধুও যাবে। একজন বন্ধু তার মাইক্রোবাস আমাকে ধার দেবে। সেটায় চেপে সোজা গ্রামে। আজকালতো সব জায়গায় পাকা রাস্তা। মাইক্রোবাসে অসুবিধা হবে না। মা বলেন- সাবধানে আনিস বাবা। পথে যেন কোন কষ্ট না হয়।
সে নিয়ে তুমি ভেব না মা। ছেলেটা বলে— মধ্য প্রাচ্য থেকে চিরদিনের মত চলে আসা মানুষের কত সব জিনিসপত্র থাকে। মাইক্রোবাসে সুবিধা।
ছেলে আবার ফোন করে— মা আব্বা আজ রাতে যেতে পারবেন না। আগামীকাল যাবেন।
ওর শরীর ভালো তো?
একটু টায়ার্ড। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। কাল খুব সকালে রওনা দিলে দশটার মধ্যেই পৌঁছে যাব।
ঠিক আছে বাবা। যা ভালো মনে হয় তাই কর।
একটা খাট হয়েছে নিজেদের জন্য। সেখানে দুটো দুটো বালিশ পাশাপাশি রেখেছেন। বালিশে সুখে থাকা দুজন পাখি মুখোমুখি। সুজনির লালচে রংটা চোখে পড়ার মত। মেয়ের জামাইকে দিয়ে শহর থেকে আনিয়ে নিয়েছেন। জামাই মাঝে মাঝে নিজের কাজে শহরে যায়। তার সারের দোকান। এখন হাঁটুর বাতটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে। সারাদিন বড় হৈ চৈ এ গেছে। এখন হাঁটুটা সত্যিই কন কন করছে। এ খবর স্বামী জানেন না। মনে পড়ছে মনজুর হোসেনের সুঠাম শরীর। তার শক্ত শক্ত হাত পা। তিনি এখনো চমৎকার আছেন এমন কথাই তো বার বার জানিয়েছেন। বলেছেন —আমি খুব ভালো আছি। আমাকে নিয়ে ভাববে না। এমন একটা মানুষ পরিবারের ভাতের জন্য, ছাদের জন্য, একটু টাকা পয়সার সুখের জন্য একা জীবন কাটিয়ে দিল।
মা চুলে তেল দেব?
দাও। মাথা মেতে দিয়ে বসেন হালিমা। মেয়েটা সব চুল উঠে যাওয়া মাথায় চাপড়ে চাপড়ে তেল বসায়। তিনি বলেন – চুল নাই। দেখলে মন খারাপ করবে।
কাজের মেয়েটা হাসে। বলে -চুল নাই। রূপ নাই। সব গেছে। হামার স্বামীও ভিন দেশে মাটি কামড়ে পড়েছিল। তারপর যখন ফিরিছে হামি তখন থুরথুরা বুড়ি।
এত বক বক করবা না। আমি কি থুরথুরা বুড়ি নাকি?
সে কথা কইনি মা। আপনি এখনো সোন্দর।
কোনমতে পায়ে হেঁটে খাটের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। আজ রাতে নয়। আগামীকাল সকাল দশটার দিকে মনজুর আসছে।
পরদিন সকালে কি এক সুখের আবেশে ঘুম ভাঙ্গে তার। মনজুর হোসেন ষোল বছর পর বাড়িতে ফিরছে। বাতের কষ্ট ভুলে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নামতে গিয়ে পায়ের জয়েন্টে একটু ব্যথা পান। সে ব্যথা বাড়তে থাকে। মন খারাপ হয়ে যায় তার। এত বছর পর একজন আসছে এক বাত জর্জরিত স্ত্রীর কাছে? একটা অপরাধবোধে মন খারাপ লাগে তার। ছেলে বলে- মা ্এক ঘন্টার ভেতরে আমরা বাড়িতে আসছি।
তোর বাবা তোকে চিনতে পারলো মোহসিন?
না মা। রেখে গিয়েছিলেন পাঁচ বছরের একজনকে। এখন সে একুশ প্রায় শেষ করেছে। চেনা শক্ত। তবে খুব বেশি কষ্টও হযনি।
তুই চিনতে পেরেছিস?
না। তবে ধরে নিয়েছিলাম উনিই আমার আব্বা। লম্বা, ময়লা গায়ের রং। ও গুলো ঠিকই আছে। কথা শুনে হাসে হালিমা। বলেন- মিনা আগামীকাল আসবে। ও চিনতে পারবে না। ওর বয়স ছিল আট বছর। মোহসিন বলে- তোমারে চিনতে পারবে তো?
পারবে।
তুমি চিনতে পারবে?
না চেনার কি আছে?
সেটা দেখা হলে জানতে পারবে।
তার মানে কি?
ষোল বছরে একজন মানুষ একইরকম থাকবে সেটা কি করে ভাবতে পারলে?
তার মানে?
মানে আবার কি? তোমার হিরো বাড়িতে ফিরছে। নিজের চোখে দেখ।
ঠিক দশটায় বাড়িতে প্রবেশ করেন মনজুর হোসেন। এক রাশ বাক্স পোটলার সঙ্গে। বায়াতে মনজুর নামের বাড়ির নামটা বার বার দেখেন। বলেন – কে লাগালো এটা?
আমি আব্বা। মোহসিন বলে। বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে চাপ কলের পাশে নতুন বাথরুম। বারান্দায় বসে আছে হালিমা। এই নারীকে কি রেখে গিয়েছিলেন তিনি? মাথার চুল পাকা। গালটা তোবড়ানো। শরীর কেমন জীর্ন শীর্ন। যার স্বামী বিশ বিঘা জমি করেছে, মাসে দশ হাজার করে টাকা পাঠায় তার স্ত্রী এত শীর্ন আর মলিন হয় কি করে? আর হালিমা তাকিয়ে দেখে — একজন বুড়ো মানুষ। দাড়ি লম্বা। শরীর শুকনো। মাথার চুল সাদা পাকা। দীর্ঘ দিনের বিল্ডিংসাইট তার হাত ও পায়ে এনেছে অযাচিত রুক্ষতা। এ ছাড়া একটা বড় শক্ত লাঠি ভর করে ধীরে ধীরে কাছে এসে দাঁড়ালো একটি মানুষ। এইটাই কারণ বাড়িতে ফিরে আসবার। দুই পায়ের বাত নিয়ে একজন মানুষ দুবাইএর দালান বাড়ি বানানোর কাজ করে কেমন করে? মোহসিন জেনে গেছে। সে তাড়াতাড়ি একটা গদি মোড়া চেয়ার বাবার জন্য এনে দেয়।
কতগুলো ইলেকট্রিক জিনিসপত্র। টেলিভিশন। রেডিও। রাইস কুকার। বড় বড় বাক্সে কাপড় চোপড়। হাতের ছোট ব্যাগে কিছু সোনা দানা। বড় বড় চারটে লেপ। চাদর। বালিশের কভার।
তোমার পায়ে বাত?
মনজুর হোসেন হাসে।
তুমি আমাকে বলনি তো?
তুমিও তো তোমার বাতের কথা বলনি।
এরপর দুজন পাশাপাশি বসে থাকে। সকলে খাবার আনে। বিছানার চাদর বদলে দেয়। বাক্স থেকে ওষুধ বের করে। মালিশ বের করে। সারাদিন গ্রামের নানা সব মানুষ আসতে থাকে। মনজুর হোসেনের আনা খেজুর আর শুখনো মিষ্টি খেয়ে চলে যায়। কেউ তসবি পায় কেউ জায়নামাজ।
অনেক রাতে ঘুমাতে আসে হালিমা। চার পাশে বস্তা বস্তা চাল। ডাকাতের ভয়ে চাল শোবার ঘরেই রাখে সকলে, গোলা ঘরে নয়। নতুন বস্তার চালে ঘরের এক পাশ পূর্ণ। খাটটা সেই সব বস্তার মধ্যে সুন্দর করে পাতা। নয়া ফুলফুল স্যাটিনের চাদরে ঘুমিয়ে আছে বাতগ্রস্ত মনজুর। নিজের পা দুটোও ফুলে গেছে। কোন মতে ঝুপ করে শুয়ে পড়ে। চারপাশে চালের গন্ধ। মশারির ভেতরে দুজন মানুষ কেউ কাউকে চেনে না। বাতের ভারে ক্লান্ত দুই জন।
হিসাবনিকাশ, টাকা পয়সা, বাড়ি, জমি, ভবিষ্যত কবে কখন যৌবন বিদায় নিয়ে চলে গেছে। চারপাশের ধানের গন্ধে আপাতত দুজন ঘুমিয়ে।
ওদের আর কোনদিন ভাতের কষ্ট হবে না।