ডেভিড হেয়ার

ডেভিড হেয়ার
মুসা আলি
বেলা বারোটার দিকে ঘটনাটা ঘটেছিল। রাজিবুলের কানে তা পৌঁছালো একটার দিকে। শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ভদ্রলোক সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকতা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। শুনে অবিশ্বাস্য ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে দুপুরের গনগনে রোদ ঠেলে পাশের গ্রামের উদ্দেশ্যে বাইকে ছুটে চলেছেন। সেখানেই বিরজুকুমার তোগাড়িয়ার বাড়ি। পেশায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তিনিই ঘটনাটা ঘটিয়েছেন।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও যথারীতি স্কুলে উপস্থিত হয়ে দেখেছিলেন, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আসলাম মুখ ভার করে বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে আছে। বিরজুকুমারের প্রিয় ছাত্র কিন্তু কেন যে তার মুখে মেঘলা আকাশের ছবি ভেসে ছিল, তখনও তা অনুমান করতে পারেন নি। জোরে বৃষ্টি নামার পরেই জমে থাকা ধূসর মেঘের গভীর তাৎপর্য ধরা পড়ার মতোই।
প্রথম পিরিয়ড শেষ হতেই হাতে লেগে থাকা চকের গুড়ো বালতির জলে ধুতে গিয়ে আবার মনে পড়ল আসলামকে। ছেলেটা বড়ো ভালো। পিরিয়ড শেষ হলেই বালতি থেকে মগে জল নিয়ে সুড়সুড় করে ঢেলে দিত আসলাম। তাতেই বিরজুকুমার দুহাত কচলে চকের গুঁড়ো ধুয়ে ফেলতেন। এ অভ্যেস যেমন আসলামের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, তেমনি বিরজুকুমারের মধ্যেও। আসলাম মনের খুশিতে ভাসত স্যারের হাতে জল ঢেলে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে। ক্লাস শেষ হলেই সে শিক্ষকরুমের সামনে এসে দাঁড়াতো। বিরজুকুমার বলতেন, এসেছিস? তা নে জল ঢাল, হাত মুখ ধুয়ে নিই।
সেই আসলামকে দেখে সেদিন বিরজুকুমারের পক্ষে মাথা ঠাণ্ডা রাখা অসম্ভব হয়ে উঠল। কেবল মনে হতে থাকল, ও ছাড়া অন্য কেউ এ কাজ করতে সাহস পাবে না। ততক্ষণে আসলাম পায়ে পায়ে স্টাফরুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। জলদগম্ভীর স্বরে বিরজুর প্রশ্ন, তাহলে তুই জলের বালতিটা ভেঙেছিস?
কী বলছেন স্যার? স্কুলে এসেই দেখেছি, বালতিটা ভাঙা। সেজন্যে মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলুম।
তোর আসার আগে আর কী কেউ স্কুলে ঢুকেছিল?
আমিই প্রথম স্কুলে এসেছি স্যার।
তাহলে বালতিটা ভাঙল কে?
আসলাম গোঁ ধরে বলল, আমি তো বললুম, আমি ভাঙি নি। রোজ আমিই আপনার হাতে জল ঢেলে দিই। আপনি হাত মুখ ধুয়ে নেন।
এসবের সঙ্গে বালতি ভাঙার সম্পর্ক কী?
স্যার, জল না থাকলে তো আপনার হাত মুখ ধুতে খুব অসুবিধা হবে। এ কথা ভেবে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
পাল্টা যুক্তি দিয়ে তো বলা চলে, আমার অসুবিধার কথা ভেবে তুই বালতিটা ভেঙে ফেলেছিস।
আমি ভাঙি নি স্যার।
আবার মিথ্যে বলছিস?
স্যার, আমি মিথ্যে বলি নি।
মুখে মুখে তর্ক করছিস? দাঁড়া, তোর মজা দেখাচ্ছি।
আসলাম বিহ্বল মুখে বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে থাকল। গত বছর ঈদের ছুটির পরে স্যারের জন্যে খিড়পায়েস এনেছিল সে। খেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন বিরজুস্যার। সেই স্মৃতি ভুলতে পারে নি সে। মা খুব যত্ন করে পায়েস করে দিয়েছে, সেই খিরের পাত্র তার ডান হাতের তালুতে। বাড়ি থেকে ভাবতে ভাবতে এসেছে, খিরের পায়েস খেলে স্যার খুব খুশি না হয়ে পারবেন না। এ নিয়ে স্যারের কাছে একটা উজ্জ্বল স্মৃতি রয়েছে। কিন্তু উদ্ভুত ঘটনা এত জটিল রূপ নিল যে আসলাম স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হল। এত ভয় পেলো যে খিরের পাত্রটা বিরজুস্যারের হাতে তুলে দিতে পারল না।
ডাস্টার হাতে ক্রুদ্ধ মূর্তিতে টিচার্স রুম থেকে বিরজুস্যার স্কুলের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। —তাহলে তোর সামনে কে বালতিটা ভেঙেছে, সেটাই তোকে বলতে হবে।
এসে দেখেছি স্যার, বালতিটা ভাঙা। কাউকে ভাঙতে দেখি নি, তাহলে কার নাম বলবো?
আসলাম সম্পর্কে বিরজুর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল। কেবল মনে হতে থাকল, আসলাম ছাড়া অন্য কেউ এ কাজ করতে পারে না। স্টাফরুমের সামনে বারবার আসতে আসতে সাহস বেড়ে গিয়েছে বলেই—। বিরজুর মনের আকাশের সন্দেহ শ্রাবণের ঘনঘোর মেঘে রূপান্তরিত হল। আসলামকে মারধর করতে শুরু করলেন। মুখের ভাষায় একটাই তড়পানি, আমার সামনে মিথ্যে বলার সাহস দেখাতে পারলি কী করে? জানিস, আমি তোকে কত কঠিন শাস্তি দিতে পারি?
আসলামের কান্নাবিজড়িত কাকুতিমিনতি, আমি কিস্সু জানি নে স্যার, আমাকে এভাবে মারবেন না।
তোকে আজ মেরে ফেলব রে মিশকি শয়তান। আমাকে কী ভেবেছিস তুই?
ততক্ষণে বিজয়কুমার ভকত্ নামে আরেকজন শিক্ষক এসে শাসনে যোগ দিয়েছেন। তাঁর তাৎক্ষণিক মন্তব্য, এভাবে মারলে ও কিছুতেই মানবে না। বড়ো ডানপিটে ছেলে। আমি বরং ওর মাথাটা নিচু করে ধরি, আপনি ডাস্টার দিয়ে শয়তানটার ঘাড়ে আর শিড়দাঁড়ায় ঘা’কতক দিন।
কচি কাঁচা আসলামের কোমল শরীরে এসব মেনে নেওয়া সম্ভব হল না। সহ্য করতে না পেরে বারান্দায় লুটিয়ে পড়ল। সারা স্কুলে অভিনব চাঞ্চল্যের বিস্তার। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের বাইরে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল। তারাও জানতে চায়, ঠিক কী ঘটেছে আসলামকে নিয়ে। স্যার তো ওকে খুব ভালোবাসতো। গত বছর ঈদের পরে আসলাম যে খিড়ের পাত্র স্যার-এর জন্যে এনেছিল, তা অনেকের জানা ছিল। একটু পরে অভিভাবকদের কেউ কেউ স্কুলে এসে হাজির হল। শুনতে শুনতে তারা হতবাক না হয়ে পারল না। এক অভিভাবকের মন্তব্য, তাহলে দ্বিতীয়গৃহের পিতারা এতটাই নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছেন?
অবস্থা বেগতিক দেখে আসলামকে নিকটবর্তী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। স্কুল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানেই তড়িঘড়ি চিকিৎসা শুরু হল। বেডে শুয়ে আসলাম একটানা ভুল বকছে, স্যার, খিরের পাত্রটা বারান্দার উপর রয়েছে, মা আপনার জন্যে খুব যত্ন করে তৈরি করেছে।
আরেকটু পরে আর কোনো কথা বলতে পারল না। টানা নিশ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। হাঁপের টান শুরু হল আর কিছু সময় যেতেই। ভিতরের যন্ত্রণার তীব্রতা তখন বেড়ে বেড়ে পর্বত হয়ে উঠেছে। ফুলের মতো মুখে বার বার খিঁচুনির ছায়া ভেসে উঠছে।
সাংবাদিক রাজিবুল বিরজুকুমার তোগাড়িয়ার দোতলা বাড়ির সামনে ব্রেক কষে বাইক থামিয়ে দিলেন। নেমপ্লেটে বড়ো বড়ো করে লেখা— বিরজুকুমার তোগাড়িয়া, শিক্ষক, প্রাক্তন প্রধান।
রাজিবুল কিন্তু ভিতরে যাবার কোনো সুযোগ পেলেন না। সদর গেটে লক করা। বুঝতে বাকি থাকল না যে উদ্ভুত ঘটনার জেরে স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছেন বিরজুকুমার কিন্তু নিরাপত্তার কারণে গেটে লক করে ভিতরে বসে আছেন। মনে মনে বন্দি হয়ে পড়লে মানুষের এমনিই দশা হয়। রাজিবুল ভাবলেন যে আসলামকে নিয়ে বিরজুকুমার সত্যি সত্যি ভীষণ আতঙ্কে রয়েছেন। বিরজুকুমার তখনও ভুলতে পারেন নি কীভাবে এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেল। বিছানার উপর চোখ বুজিয়ে বসে আছেন। কানে বাজছে আসলামের শেষ কথাগুলো, খিরটুকু খেয়ে নেবেন স্যার, খুব যত্ন করে মায়ের হাতে তৈরি।
সাংবাদিক রাজিবুলের মাথায় তখন অন্য খেলা শুরু হয়ে গেছে। তোগাড়িয়ার ছবি সহ খবরটা দিব্যি প্রথম পাতায় চলে যেতে পারে। শিক্ষকের হাতে ছাত্রের মৃত্যু—এমন হেডিং দেব বলে ভাবছেন। সদর গেটে আঙুলের টোকা দিয়ে ডাকলেন, খবরের কাগজ থেকে এসেছি, একটু কথা বলতে চাই, বিরজুবাবু আছেন?
বিরজুকুমার দক্ষিণের ঘর থেকে রাগে গর গর করতে করতে দোতলার বারান্দায় এসে বললেন, কী জানতে চান বলুন?
শাসন করাটা কী একটু বেশি হয়ে গেল না স্যার?
আপনি কী কখনো শিক্ষকতা করেছেন?
আগে করতাম, এখন সাংবাদিকতা করি।
তাহলে কী করে বুঝবেন, কোন্ ঘটনায় কোন্ শাসন কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
তাই বলে একটা ফুলকুঁড়িকে এভাবে?
কুঁড়ি ফোটাতে গেলে এটুকু খুব প্রয়োজন।
শুনছি, হাসপাতালে এখনও ছেলেটার জ্ঞান ফেরে নি।
ও সব মিথ্যে গুজব।
একটু আগে ফোন করে এসব জানতে পেরেছি।
অভিভাবকের গাঁটি খোসানোর জন্যে ডাক্তারবাবুদের অহেতুক কারসাজি।
তাহলে আপনি নিজের ভুল স্বীকার করবেন না?
ভুল করলে তবে তো স্বীকারের প্রশ্ন আসে।
Kindly সদর গেটটা খুলে দিলে একটা ছবি নিতে পারতুম। ক্যামেরা সঙ্গে এনেছি।
বিরজুকুমার আর রাগ সামলাতে পারলেন না। রাসভ স্বরে বললেন, নীচে নামতে হলে ঘাড় ধরে মাথাটা দেওয়ালে ভালো করেই ঠুকে দেব। খবরের কাগজে আছেন বলেই সকলের মাথা কিনে রেখেছেন নাকি? এক্ষুণি বাড়ির সামনে থেকে চলে যান, নতুবা আমাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন যে বেকার সিন-ক্রিয়েট করতে এসেছেন?
ভয়ে রাজিবুল জড়োসড়ো হয়ে যেতে বাধ্য হলেন। মল্লবীর শিক্ষক, মানসিক সংবেদনশীলতার চেয়ে শরীরের সক্রিয়তা অনেক বেশি, বিড়ালের ভয়ে ভীত ইঁদুরের মতো অবস্থান নিয়ে পায়ে পায়ে সরে গিয়ে একটা বড়ো বটগাছের ছায়ায় বসে পড়লেন। সেখান থেকে বিরজুকুমারের বাড়ি দিব্যি দেখা যাচ্ছিল। সাংবাদিক জীবনে রাজিবুলকে কখনো এমন উগ্রচণ্ডী মানুষের মুখোমুখি হতে হয় নি। যেন শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবাদের সমুদ্র নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছেন। ভাবলেন, নিশ্চয় একটু পরে প্রশাসন আসবে বিরজুর বাড়িতে, তখন না হয়—।
শীতলছায়ায় বসে থাকা প্রাক্তন শিক্ষক রাজিবুলের স্মৃতিপটে শিক্ষাবিজ্ঞানের একটা জ্বলন্ত ইতিহাস ছবি হয়ে ভেসে উঠছে। অভাব যে শুধু দুর্যোগকে মনে করিয়ে দেয়, তা নয়, সুসময়ের নানা সদর্থক দিককেও সামনে এনে হাজির করে।
সেদিন সন্ধের শুরুতে কী বিশ্রি গুমোট গরম। শরীরে হাসপাস অবস্থা। তবুও ডেভিড হেয়ার পড়ার টেবিলে বসে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের উপর নানা দার্শনিক তত্ত্বে ডুবে আছেন। কেবল মনে হতে থাকল, এতদিনকার শিক্ষকজীবনে তাঁর অবস্থা সাগরের তীরে নুড়ি কুড়োনোর চেয়ে বেশি কিছু নয়। জ্ঞান সঞ্চয়ের পরিধি নিয়ে সব পণ্ডিতের ধারণা এমনিই। বাহিরে তখন সদর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রয়েছে ডেভিডের প্রিয় ছাত্র চন্দ্রকান্ত। হেয়ার তাকে চন্দর বলে ডাকতেন। দরজার গায়ে আঙুলের টোকা দিয়ে চন্দরের প্রশ্ন, স্যার আছেন?
ডেভিড হেয়ার পাঠের গভীরে গিয়ে এত মগ্ন হয়ে পড়েছেন যে প্রিয় ছাত্রের কথা শুনতেই পেলেন না। আবার চন্দর সদর গেটে আঙুলের টোকা দিল। গভীর তন্ময়তা থেকে কঠোর বাস্তবে ফিরলেন ডেভিড। দরজা খুলে দিয়ে প্রিয় ছাত্র চন্দ্রকান্তকে দেখে বেশ অবাক হলেন। ছেলেটার সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে তাঁর। চন্দর জানত যে সন্ধে থেকে দশটা পর্যন্ত তাঁকে নানা বিষয় নিয়ে পড়াশোনায় ডুবে থাকতে হয়। তাই একটু অবাক হয়ে বললেন, তুমি এ সময়ে?
না এসে উপায় ছিলনা স্যার।
তা না হয় মানলাম কিন্তু কালবোশেখির সময়, আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। যে কোনো সময় ঝড়-বৃষ্টি নামতে পারে, এসব নিয়ে ভাবতে পারলে না কেন?
ছাতা নিয়ে এসেছি স্যার।
কালবোশেখির ঝড়ে ছাতা কতটা কাজে লাগবে?
চন্দ্রকান্ত চুপ করে থাকল। ডেভিড হেয়ার সস্নেহে চন্দরের কাঁধে হাত রেখে রিডিং-রুমের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বললেন, বসো বাবা। তারপর বলো, কেন আমার কাছে এসেছ?
স্যার, সন্ধের আগে একটা গল্প পড়া শেষ করেছি। শেষ অংশে লেখা আছে, শিক্ষক পিতৃতুল্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও চেয়ে বেশি। ভেবে এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাই নি স্যার। আবার এটাকে লেখকের নিছক বিবৃতি হিসেবেও ভাবতে পারি নি। নিশ্চয় ভিতরে একটা বড়ো অর্থ রয়েছে, কিন্তু সেটা কী? বাধ্য হয়ে আপনার কাছে ছুটে আসতে হয়েছে। এ নিয়ে আমার মধ্যে যে প্রশ্নের ডালি জেগে উঠেছে, তাও খুব বিচিত্র। জন্মসূত্রে কেউ নন, তাহলে কী অর্থে তাঁকে পিতৃতুল্য বলা হবে? শিক্ষক কী কখনো জন্মদাতা পিতার চেয়ে বড়ো হতে পারেন? শিক্ষকের জীবনে সেই সুযোগ আছে কী? পৃথিবীর প্রথম আলো দেখার সুযোগ আমরা লাভ করি বাবা-মায়ের কারণে। তার পরেও কেন যে লেখক শিক্ষককে জন্মদাতা পিতার তুলনায় ছোটো ভাবতে পারলেন না, তা আমার মাথায় ঢোকে নি।
এভাবে ব্যাখ্যা হয় না চন্দর। মনোবিজ্ঞানের প্রশ্নকে মনোবিজ্ঞানের আলো দিয়েই বিচার করতে হবে। এখন বলো, আমি যে তোমার কাঁধে হাত রেখে বসে আছি, তাতে তোমার কী মনে হচ্ছে?
স্যার, খুব সুখ অনুভব করতে পারছি।
কেন তা বলবে?
আপনার হাতের কোমল স্পর্শ আমার শরীরে স্নেহের মত্ততা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ডেভিড হাসলেন। ডান হাত দিয়ে চন্দরকে একটু নাড়া দিয়ে বললেন, শোনো ডিয়ার চাইল্ড, এ মত্ততা গভীর হলে তা বাপের অধিকাররের সমতুল্য হয়ে ওঠে। কখনো কখনো তা জন্মদাতা বাপের চেয়েও বড়ো হয়ে দেখা দেয়। একজন শিক্ষক নিজের ছাত্রকে গড়ে তুলতে নিজের স্বপ্ন নিয়ে যেভাবে মগ্ন থাকেন, তা হয়তো সেই ছাত্রের বাবার জীবনেও নেই। এক্ষেত্রে জীবন গড়ার কারিগরের দাবি পিতার চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে ওঠে। আসলে একজন খাঁটি শিক্ষকের মনন ও ইচ্ছা পিতৃত্বের সব অধিকার নিয়েই গড়ে ওঠে।
চন্দর দুচোখ গোল করে চেয়ে থাকল ডেভিড হেয়ারের দিকে। মনের প্রতিভাসে শিক্ষকের পিতৃত্বের অধিকার নিয়ে নতুন যে স্থান ধরা পড়ল তা যেন তখনও শরতের আকাশে ভেসে যাওয়া রঙবেরঙের ছবি। আপ্লুত চন্দর শুধু বলল, তাহলে আসছি স্যার।
সাবধানে যেও বাবা, আকাশে যা মেঘ করেছে।
ঠিক যেতে পারব স্যার।
আমি যে তোমাকে বাবা বলে সম্বোধন করলুম, তা নিয়ে কিছু বলবে না?
স্যার, ওইটাই পিতৃত্ব। জেনে ধন্য হলাম।
সঙ্গে টর্চ এনেছ কী?
চন্দর মাথা নাড়ল।
তাহলে যাও বাবা, ভালো থেকো। আবার জানার প্রয়োজনে যে কোনো সময় চলে আসতে পারো।
আকাশে মেঘের ঘটঘটা বাড়ছে। অন্য দিনের তুলনায় অন্ধকারের ঘনত্ব একটু বেশি, বোধ হয় মেঘলা আকাশের কারণে। চন্দ্রকান্তের গভীর জীবনতৃষ্ণা নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে ডেভিড হেয়ার ভাবতে শুরু করলেন। জানার আগ্রহ প্রবল হয়েছিল বলেই তার পক্ষে সন্ধের পরে এতটা পথ পার হয়ে আসতে পারা সম্ভব হয়েছে। মনে মনে খুব উৎফুল্ল না হয়ে পারলেন না। শিক্ষকজীবনের শ্রেষ্টত্ব প্রিয় ছাত্রের কায়াতে, মায়াতে এবং বোধের গভীরে রোজ রোজ বড়ো হয়ে ওঠে। চন্দর তাঁর জীবনে তেমনি এক ছাত্র হয়ে উঠতে পেরেছে।
পড়ার টেবিলে বসে চিন্তার অচিনপুরে থাকতে থাকতে নিজেকে কেমন যেন হারিয়ে ফেললেন। ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সন্তানলাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন নি। তাই কী চন্দরকে দেখে তাঁকে এভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে হয়? চন্দরও যেন তাঁকে ছোঁয়ার জন্যে একটানা চেষ্টা করে চলেছে। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের সম্পর্কের প্রতিটা পদক্ষেপ নিয়ে জানার অফুরন্ত কৌতুহল রয়েছে ছেলেটার মধ্যে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। ডেভিডের ভিতরের ভাবনা ক্রমেই গভীরতর হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে আরেকটা নতুন দুর্ভাবনার ছায়া তাঁর মাথার উপরে ভারী হয়ে বসতে শুরু করল।
কালবোশেখির দমকা হাওয়া খোলা জানালা ভেদ করে ঘরের ভিতরে ঢুকছে। টেবিলের উপরে থাকা কয়েকটা খাতা উড়িয়ে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেন ডেভিড। একটাই ভাবনা মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। সময় বলছে, চন্দর এখনও বাড়িতে পৌঁছতে পারে নি। এত দুর্যোগের মধ্যে ছেলেটা কোনো বিপদে পড়ে যায় নি তো? কম্পিত হতে হতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের মেঝেতে কয়েকবার পায়চারি সেরে নিলেন। মনের অস্থিরতা সামুদ্রিক হয়ে উঠছে। ছাতা আর টর্চ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ছাত্রের জন্যে শিক্ষকের পদক্ষেপটুকু নিছক প্রয়োজনের নয়, যুগ যুগান্তর ধরে তা মননের একান্ত পুরনো দৃষ্টান্ত। ডেভিড হেয়ার সেই উপমায় ঢুকে পড়লেন মাত্র।
বাড়ির বাইরে এসে রাস্তায় নেমেই বুঝলেন, ঝড়ের তাণ্ডব কত বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে। গাছের ডালে ডালে উতলা বাতাসের মত্ততা। হাতের ছাতা বার বার উল্টে যাবার উপক্রম হচ্ছে। জোর করেও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ডেভিডের মনের শঙ্কা তর তর করে বেড়ে চলল। চন্দরের বয়স ১৮র বেশি নয়। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। শেষ পর্যন্ত বড়ো কোনো বিপদে পড়ে গেল নাতো?
সামনে হেঁটে চললেন ডেভিড। বুকের গভীরে চন্দরকে নিয়ে নতুন ত্রাস শুরু হয়ে গেছে। মিনিট পাঁচেক যেতেই হাতের ছাতাটা সত্যি সত্যি উল্টে গেল। প্রবল ঝড়ের গতিবেগের কাছে হার মানল বলা চলে। বৃষ্টির বেগও বাড়ছে। তবু থামলেন না ডেভিড। অন্তরের ঝড় সামলানোর জন্যে বাইরের ঝড় উপেক্ষা করার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ডেভিড সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে হেঁটে চলেছেন সামনে। চন্দরের ভাবনা তাঁকে চুম্বকের মতো টানছে। মাঝে মাঝে টর্চ মেরে পথ দেখে নিচ্ছেন। শিক্ষকের পিতৃত্বলাভ নিয়ে চন্দরের কৌতুহল ও রোমন্থন তখনও তাঁর মনের মণিকোঠায় ভেসে ছিল।
আরও কয়েক মিনিট পরে যেতে যেতে দেখলেন, একটা বড়ো গাছ রাস্তার উপর শুয়ে পড়েছে যার ঝোপ ঝোপ ডালপালাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। ডেভিডের বুকের গভীরে ছ্যাকছ্যাক শব্দদোল শুরু হল। এর তলা দিয়ে তো চন্দরকে যেতে হয়েছে, কোনো বিপদ হয় নি তো? সবুজ পাতায় ঘেরা ডালপালার ভিতরে টর্চ মেরে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন। মুখে বার বার বলছেন, ডিয়ার চন্দর, আর ইউ হিয়ার? ইউ, মাই বয়।
স্মৃতির দৌড়ে প্রায় হাঁপিয়ে উঠলেন ডেভিড। তারপর ভাবলেন, বিপদ হলে তো টর্চের আলোয় দেখা যেত। মনে মনে চন্দরের বিপদমুক্তি নিয়ে কেমন যেন নিশ্চিত হয়ে গেলেন। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বার বার। অকস্মাৎ আলোর বিস্তার ঘটছে রাতের কালো রূপের মধ্যে। তাতেই ডেভিডের পথ চলতে কিছুটা সুবিধা হচ্ছে। মাঝে মাঝে টর্চ মেরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললেন। আরও মিনিট দশেক পরে আবার দেখতে পেলেন, আরেকটা প্রকাণ্ড গাছ রাস্তার উপর শুয়ে পড়েছে। নতুন ভয়ের রেশ ডেভিডের বুকের গভীরে দোল খেতে লাগল। ঢেঁকি পড়ার শব্দদোল তার ভিতরে গুতোগুতি শুরু করে দিয়েছে। টর্চ মেরে খুঁজতে শুরু করলেন ডেভিড। প্রতিটা পাতাবহুল ঝোপের আড়ালে ডেভিডের বুকের ভিতরের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। নিজেই ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গিয়েছেন। শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কাঁপুনি শুরু হয়েছে। তবুও তন্ন তন্ন অন্বেষণে ব্যস্ত। হৃদয়ের অঞ্জলী এমনিই। মুখে বার বার বলছেন, ডিয়ার চন্দর, আর ইউ হিয়ার? ইউ, মাই বয়।
কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না। প্রশ্ন মারাত্মক ভয়ের হয়ে ওঠে যখন তা হাজার আকুতিতে নিরুত্তর থেকে যায়। ভাদ্রের ভরা বৃষ্টির মতো। ডেভিডের ভিতরটা চরম আতঙ্কে ভরপুর হয়ে উঠল। এখানেও নেই? তাহলে? অন্য কোনো বিপদ হয় নি তো? বার বার বিদ্যুৎ ছলকের সঙ্গে আকাশ কাঁপিয়ে বেশ কয়েকবার বজ্রপাত পড়েছে। ডেভিডের বুক কেঁপে উঠল। টর্চ মেরে সমগ্র পথটা তো সেভাবে দেখা সম্ভব হয় নি।
একটু ভিন্ন চিন্তায় এবার বিচলিত হলেন। চন্দরের বাড়িতে যেতে ইতিমধ্যে তিন ভাগ পথ অতিক্রম করে আসতে পেরেছেন তিনি। পৌঁছতে আর মাত্র মিনিট দশেক লাগবে। আগে থেকেই রাস্তার পরিমাপ জানা ছিল ডেভিডের। একান্ত আমন্ত্রণে একবার চন্দরের বাড়িতে যেতে হয়েছিল। সেই স্মৃতি তখনও ভেসে ছিল ডেভিডের মধ্যে। মনে মনে খুশি হলেন এই ভেবে যে আরেকটু গেলেই চন্দরের খোঁজ পেয়ে যাবেন। রাস্তার পাশেই বাড়ি। হন হন পায়ে এগিয়ে চললেন। অন্তরের তাগিদ চলার গতিকে দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। গিয়ে দেখলেন ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করা। ডেভিড দরজার গায়ে আঙুলের টোকা দিয়ে ডাকলেন, ইজ চন্দর ইন?
এত ঝড়বৃষ্টি ঠেলে আবার কে এলেন? প্রশ্ন চন্দরের। সবে তো বাড়িতে ফিরতে পেরেছে সে।
সদর দরজা খুলে দিয়েই চন্দর চমকে না উঠে পারল না। —স্যার আপনি! এত ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে? ভিতে তো সপসপে হয়ে গিয়েছেন। হাতে করে একটা ছাতা আনতে পারলেন না? ভিতরে আসুন। জামা-প্যান্ট পাল্টে নিন। বিশ্রাম করুন। মাকে এক্ষুণি চা করে দিতে বলছি। এত দুর্যোগ ঠেলে আসার কী দরকার ছিল?
কোনো উত্তর দিলেন না ডেভিড হেয়ার। নিজের উপলব্ধির কথা চন্দরকে বুঝিয়েও বললেন না। তখনও দুর্যোগ এতটুকু কমে নি। ডেভিড বললেন, আসছি রে চন্দর, ভালো থাকিস।
চন্দরের তাৎক্ষণিক প্রশ্ন, স্যার, কীজন্য এলেন বললেন না তো?
বটগাছের ছায়ায় থাকতে থাকতে রাজিবুলের রোমন্থনের ঢেউ হঠাৎ থমকে গেল পুলিশ ভ্যানের সুতীব্র হর্ণের শব্দে। জনা পঁচিশ পুলিসের স্কোয়াড নিয়ে স্বয়ং ওসি চলে এসেছেন বিরজুকুমার তোগাড়িয়ার বাড়ির সামনে। বন্ধ সদর দরজার গায়ে আঙুলের টোকা দিয়ে ডাকলেন, ইজ বিরজুকুমার ইন?
গাছের নরম ছায়া ত্যাগ করে পায়ে পায়ে পুলিস ভ্যানের দিকে এগিয়ে চললেন সাংবাদিক রাজিবুল। ততক্ষণে ওসির তাৎক্ষণিক হাঁকডাক শুরু হয়ে গেছে। —ওকে ঘাড় ধরে পুলিস ভ্যানে তোলো। পাষণ্ড কোথাকার। শুধু শরীর নিয়ে কী…