সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

প্রাচীন ব্যাকরণবিদ পাণিনির ব্যাখ্যায় সহিত থেকে সাহিত্য শব্দটি এসেছে কিংবা শব্দের সহিত অর্থের মিলনে অথবা সাহিত্যিকের ভাবনার সাথে পাঠকের অনুভূতির মিলনে সাহিত্য সৃষ্টি হয়…
যে ভাবেই সাহিত্য সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, আমি মনে করি সাহিত্যে অভিজ্ঞতাকে নি:সন্দেহে নান্দনিক শিল্পে লিখিত রূপ দিয়ে থাকেন একজন সাহিত্যিক। যেখানে থাকে গভীর চিন্তাশক্তি, বিষয় ও ভাষা। যদিও আমরা পড়েছি কেউ কেউ মনে করেন ‘পুরোনো আমলে পুরুষরাই সাহিত্য রচনা করতেন এবং নিজস্ব কল্পনায় নারী চরিত্র রচনা করতেন’। সাহিত্য হতো পুরুষপ্রধান চরিত্রের। এই ধ্যান-ধারণা সেই কবেই গত হয়েছে। মলাটের অন্ধকার প্রাচীর ভেঙে পৃথিবীতে উন্মোচিত হয়েছে (নারী, পুরুষ) সাহিত্যিকের অনন্য সর্বজনীন সাহিত্য। আর সর্বজনীন সাহিত্য সকল সময়ই পৃথিবীর সকল মানুষের। একজন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যে মানুষের প্রেম, জয়,পরাজয়, হাসি- আনন্দ,দু:খ,যাতনা, মন-জীবন নিয়ে লিখলেও ; লেখার প্রকাশভঙ্গি এবং তাদের সাধনা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্য, সুন্দরকে সাহসিকতার সাথে শৈল্পিক রূপ দানে যে সাহিত্য সৃষ্টি করেন ; সে সাহিত্যের জন্য হন অমর। সে সাহিত্যকর্ম এনে দেয় খ্যাতি। তাদের সাহিত্যে থাকে পাঠকের ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত করার মন্ত্র। বাংলা ভাষায় এরকম সাহিত্য রচিত হয়েছে অনেক।

আমরা সবাই জানি এবং বলতে শুনি— অর্থ কিংবা পুরস্কার সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড নয়। সত্য। কিন্তু আমি মনে করি, একটি পুরস্কার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতিকে বহুজাতিক সাহিত্য দরবারে পরিচিত করে তুলতে বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে। রাখে। উদাহরণ স্বরূপ, নোবেল কমিটি সাহিত্যে ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কারটি ঘোষণা করার পর হেডলাইনসগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল ‘আমেরিকার কবি,প্রাবন্ধিক’ লুইস গ্লোক( Louise Gluck) এবারের নোবেল পুরস্কার পেলেন। এরপরই এই কবির কবিতার অনুবাদ সহ গুগুল পাড়া ব্যস্ত হয়ে উঠল। এর আগেও এই কবি অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন। অনেক লেখক,পাঠক ছিলেন যারা এই কবির নামই শুনেননি এর পূর্বে। আর যারা এই কবিকে আগেই পড়েছিলেন তাদের কাছে এই প্রাইজের পরই আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন তিনি। উঠবেন না কেন ? আমাদের কাছেও সেই শতবছর পূর্বের নোবেল আজও জ্বলজ্বল করে উঠে। যদিও শতবছরে আমাদের সাহিত্যেও পাঠভঙ্গি, স্বাদের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। রচিত হয়েছে, হচ্ছেও অনেক উন্নত সাহিত্য। আমি বিশ্বাস করি আমাদের বাংলা ভাষায় রচিত রয়েছে, রচিত হচ্ছে বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নেয়ার মতো প্রচুর সাহিত্য। কিন্তু আমরা আমাদের সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্য বাজারে পৌঁছাতে পারছি না। কিন্তু কেন ? এ জন্য-তো আমাদের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান।

গ্যেটে বিশ্বসাহিত্যের কথা বলেছিলেন সেই ১৮শতকের দিকে। সেই বিশ্বসাহিত্য বাজারে আমাদের সাহিত্য পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন উন্নত ইংরেজি অনুবাদ। বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্য হতে পারে যদি তা উন্নত ইংরেজি ট্রান্সলেট বা সরাসরি ইংরেজিতে রচিত হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার পেয়েছেন ইংরেজি অনুবাদে। তাই বিশ্ববাজারে যে সাহিত্য চলে তা-ই বিশ্বসাহিত্য। আর তখন পুরস্কার না পেলেও অন্তত বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য সংস্কৃতি। সাহিত্যের মানদণ্ডে আমাদের সাহিত্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে পৃথিবীর সাহিত্য বাজারে। যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবুও আমাদের সংশ্লিষ্টরা বা প্রতিষ্ঠান যদি বাংলাভাষায় রচিত প্রকৃত সাহিত্যের উন্নতমানের ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্বসাহিত্য বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, তাহলে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির পরিচিতি আবারও আরও ব্যাপক হয়ে ওঠবে নি:সন্দেহে। এটা এখন সময়ের দাবী।

পরিশেষে আবারও বলি , কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখলেই যেভাবে লেখা হয়ে ওঠে না— তেমনি লেখা পড়লেই পাঠক হওয়া যায় না। একটি লেখা লেখতে যেমনি লেখক/ সাহিত্যিককে নিজস্ব অনেক স্তর পার করতে হয়— তেমনি একজন পাঠকও সে লেখায় প্রবেশ করার জন্য বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে যেতে হয়। আর এভাবে যখন পাঠক দাঁড়িয়ে যায় লেখার মাঠে— তখনই তৈরি হয় পাঠক এবং লেখকের মধ্যে বোধনের সেতু। আর লেখাগুলো হয়ে উঠে অনুভূতির এক মহাশক্তি।
বাংলাসাহিত্য হোক আরও বিশ্বময়, এই প্রত্যাশা রইলো।

ড্যাশ— ০২, অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা, সৃজনশীল লেখকদের সৃষ্টি কর্ম নিয়ে প্রকাশিত হলো। আশা করি পাঠক, লেখক লেখাগুলো থেকে নির্যাস পান করে তৃপ্ত হবেন। লেখক, পাঠক সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা।

এ কে এম আব্দুল্লাহ
সম্পাদক, ড্যাশ—