প্রবন্ধঃ শিশুপাঠ্যে বিদ্যাসাগর

শিশুপাঠ্যে বিদ্যাসাগর
রেখা রায়
১৮৫৫ সালের মে মাসে অতিরিক্ত বিদ্যালয়-পরিদর্শক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেখলেন যে… আমাদের বাংলাতে শিশুপাঠ্য বইয়ের বড় অভাব। তাহলে শিশুরা কী পড়াশুনো করত না তখন ? অবশ্যই করত। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায় যে…তখন রাধাকান্ত দেবের বাঙ্গালা শিক্ষা গ্রন্থ, স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত বর্ণমালা প্রথম ভাগ ও বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ, ক্ষেত্রমোহন দত্ত রচিত তিন ভাগে শিশু সেবধি, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা ছিল। কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক থেকে এগুলো তেমন নয়।
তিনি আরো জানাচ্ছেন যে… প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর একদা সিদ্ধান্ত নিলেন যে দুজনে ইংরেজি ও বাংলা বর্ণশিক্ষার প্রাথমিক বই লিখবেন। সেইমত প্যারীচরণ লিখলেন First Book of Reading for Native Children এবং ঈশ্বরচন্দ্র লিখলেন বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ।
বিহারীলাল সরকার জানাচ্ছেন যে…বিদ্যাসাগর মফঃস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যেতেন পাল্কিতে চেপে।(এখানে জানিয়ে রাখি…তখন পাল্কি আর গরুর গাড়ি ছাড়া অন্য যানবাহন ছিল না।) একদা পাল্কিতে যেতে যেতেই তিনি বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে প্রথম ভাগ এবং জুনে দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। প্রথমেই যে বইটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এমন নয়।
পরে কেমন আদরণীয় হয়েছিল তা আমাকে আজ আর বলতে হবে না। সুধী পাঠকবৃন্দ অবশ্যই বুঝতে পারছেন। রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠও তেমন গ্রহণীয় হয় নি। প্যারীচরণের বইটি আজকের বিশ্বায়নের যুগে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে অনেক আগেই।
এখন প্রশ্ন হল…ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণপরিচয় এত জনপ্রিয় কেন ? কী বিশেষত্ব আছে চটি বই দুটির?
এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আমি যা বলব তা হল…
আজকে শিক্ষাবিজ্ঞান বলছে…শিশুকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তার পরিচিত পরিবেশ ও পরিচিত বিষয় থেকে অপরিচিতের দিকে যাত্রা করতে হবে। নইলে সে শিক্ষনীয় বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হবে না। ঈশ্বরচন্দ্র বহু বছর আগে সেটাই করেছেন।
বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে স্বরবর্ণ পরিচয়, ব্যঞ্জনবর্ণ পরিচয়, তাদের পরীক্ষা, তার শব্দগঠনও বাক্যগঠন এবং অনুচ্ছেদ আকারে ২১ টি পাঠ আছে। বর্ণক্রম মনে রাখতে শিশুদের বললেন…অ-তে অজগর, আ-তে আনারস, ই-তে ইঁদুর, ক-এ কোকিল…ইত্যাদি। শিশু তার পরিচিত পরিবেশ পেল প্রথমেই। বর্ণ চেনার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ পরিচিতি ঘটছে, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ঘটছে তার।
তারপর শিশু বর্ণযোজনা শিখছে ছোট ছোট শব্দের মধ্যদিয়ে। যেমন…অজ, আম, কই, মই ইত্যাদি। একটা ছন্দও অনুসৃত হয়ে চলেছে। আ-কার যোগ, ই-কার যোগ, সংক্ষিপ্ত বাক্য, ছোট ছোট নীতিকথা, শেষে সহজ সরল ভাষায় একটু বড় গল্প এবং এই সঙ্গে নীতিবোধ জন্ম নিচ্ছে তার মধ্যে। ধাপে ধাপে বড় বাক্য শিখছে শিশু। শিশুদের বলছেন…”পড়িবার সময় গোল করিলে, ভাল পড়া হয় না; কেহ শুনিতে পায় না।”
“যদি তুমি কাহাকেও গালি দাও, আমি সকলকে বলিয়া দিব, কেহ তোমার সহিত কথা কহিবে না।”
১৯ পাঠে বলছেন…”গোপাল বড় সুবোধ। তার বাপ মা যখন যা বলেন, সে তাই করে। যা পায় তাই খায়, যা পায় তাই পরে, ভাল খাব, ভাল পরব বলিয়া উৎপাত করে না।” ইত্যাদি।
তারপর রাখালের কথা আছে। সে সুবোধ নয়। তাই “রাখালকে কেহ ভালবাসে না। কোনও বালকেরই রাখালের মত হওয়া উচিত নয়। যে রাখালের মত হইবে, সে লেখা পড়া শিখিতে পারিবে না।”
এখানে লক্ষ্যনীয় এই যে…কোথাও দৈহিক শাস্তির কথা বলা নেই। আজ বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পরে আমরাও তো একই কথা বলছি। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া হয় না। গাধা আরো গাধাই হয়। বরং স্নেহ ভালোবাসায় অমানুষকে মানুষ করা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র শিশু মনস্তত্ত্ব বুঝতেন বলেই এমন কথা বলতে পেরেছেন। ২১ পাঠে ১…১০ পর্যন্ত অঙ্ক সংখ্যায় ও কথায় আছে।
উদ্ধৃতিতে যতি চিহ্নের ব্যবহার লক্ষ্য করার মত। বাংলা সাহিত্যে যতি চিহ্নের ব্যবহার তাঁরই অনবদ্য অবদান।
তাছাড়া, বর্ণ পরিচয়ে রচিত মৌলিক গল্পের মাধ্যমে তিনি শিশু সাহিত্যের সূচনাও করলেন।
আর একটি জিনিস লক্ষ্যনীয় … কোথাও ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে নীতিবোধ শেখাতে চান নি তিনি। সচ্চরিত্রগঠন, মিথ্যেকথা না বলা, পড়াশুনোতে মনোযোগী হওয়া ইত্যাদি শেখালেন গল্পের মাধ্যমে।
বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণ : ৯ ই মে ২০১০-এর বর্ণ পরিচয় দ্বিতীয় ভাগ-এর প্রথমে দেখছি শিক্ষক মহাশয়দের শেখালেন…”বালকদিগের সংযুক্তবর্ণপরিচয় এই পুস্তকের উদ্দেশ্য। সংযুক্তবর্ণের উদাহরণস্থলে যে সকল শব্দ আছে, শিক্ষকমহাশয়েরা বালকদিগকে উহাদের বর্ণবিভাগ মাত্র শিখাইবেন, অর্থ শিখাইবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইবেন না। বর্ণবিভাগের সঙ্গে অর্থ শিখাইতে গেলে, গুরু, শিষ্য, উভয় পক্ষেরই বিলক্ষণ কষ্ট হইবেক এবং শিক্ষাবিষয়েও আনুষঙ্গিক অনেক দোষ ঘটিবেক।” আরো কিছুটা আছে। উদাহরণ স্বরূপ কিছুটা দিলাম।
এই বিষয়ে বলার কথা এই…ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষক -শিক্ষণের বিষয়টিও ভালো বুঝতেন। এই বিষয়ে তাঁকে পথিকৃৎ বলা যায়।
বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে কিছুটা যুক্তাক্ষর এবং তারপরে সাধারণ কিছু কিছু বাক্যে কিছু কথা বলে শিশুর মনে এখানেও নীতিবোধ জাগালেন। এতে যুক্তাক্ষর শেখার কাঠিন্য কিছুটা সহজবোধ্য হবে। সমস্ত বইটি এভাবে রচিত হয়েছে। যাদব, নবীন, মাধব,সুরেন্দ্র তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি।
তাঁর “চুরি করা কদাচ উচিত নয়” গল্পটি কি শুধুই শিশুদের জন্য? অভিভাবকদের শিক্ষার জন্যও খুব প্রয়োজনীয় নয় কী ? শিশুর মুখের ভাষাকে সাহিত্যে ব্যবহার করে তার মানসিক চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি।
ঈশ্বরচন্দ্রের শিশুপাঠ্য পুস্তকগুলি এমন বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর রচিত যে দেশ কাল ও সমাজ শিশুর কাছে সহজেই ধরা দেয়। তাঁর “বোধোদয়” একটি তথ্যকোষ। দুরূহ শব্দের অর্থ, কৃষিকর্ম, শিল্প-বানিজ্য-সমাজ, উদ্ভিদ, মানব জাতি, ভাষা ইত্যাদির পরিচয় যেমন আছে, তেমনি পদার্থ,ঈশ্বর,কাল, নদী, সমুদ্র, জল, ক্রয়-বিক্রয়মূল্য ইত্যাদি সম্পর্কে শিশুর ধারণা যাতে সহজে হয়, তেমন করেই লিখেছেন। তাঁর এই ধরণের লিখনশৈলী অন্য কারুর মধ্যে খুব বেশি দেখা যায় না। শিশুর মনে প্রকৃতিপ্রেম ও পরিবেশ চেতনা জাগিয়ে তুলতে কেমন সহজে লিখলেন…কাক ডাকিতেছে। গরু চরিতেছে। জল পড়িতেছে। পাতা নড়িতেছে। ফুল ঝুলিতেছে… ইত্যাদি। নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর পাঠ্যপুস্তক বাংলার শিক্ষা-সাহিত্যে এক কালজয়ী সৃষ্টি। শব্দ শিক্ষা এবং ভাষা শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে চরিত্রগঠনের শিক্ষা দেয়া যায়…এমনটি কেউ কখনো ভাবতে পেরেছে?
বাংলাভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে যত বই রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শিশু মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী রচিত বই হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয়।
“বর্ণপরিচয়” বাংলা গল্প সাহিত্যের আকরও। সে যুগে শিশু শিক্ষার বই ছিল অত্যন্ত নীরস এবং দুর্বোধ্য। তিনি প্রথমে বর্ণমালার সংস্কার সাধন করলেন। দীর্ঘ ঋ-কার ও দীর্ঘ ৯-কার পরিহার করলেন। অনুস্বার ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে তুলে ব্যঞ্জনবর্ণে আনলেন। যুক্তবর্ণ তৈরি করলেন। “বর্ণ পরিচয়” দ্বিতীয়ভাগে দশটি পর্যায়ে য-ফলা, র-ফলা, ল-ফলা, ব-ফলা, ন-ফলা, ম-ফলা, রেফ এবং দুই অক্ষরের মিশ্র সংযোগে ও তিন অক্ষরের মিশ্র সংযোগের উদাহরণ দিয়েছেন। মধুসূদনের ভাষায় ” heart of Bengali mother” ঈশ্বরচন্দ্রের ছিল। তিনি সেই বাঙালী মায়ের স্নেহ, মমতা ও সহানুভূতি দিয়ে “বর্ণপরিচয়” রচনা করেছেন। ছবি, সুর এবং গল্প…এ তিনের সংযোগে বর্ণ পরিচয় অনবদ্য। কথা দিয়ে ছবি, শব্দ সংযোগে সুর এবং নিতান্ত ছোটখাট বিষয় নিয়ে পরিবেশ-গল্প।
তাঁর জল পড়িতেছে , পাতা নড়িতেছে পদবন্ধের ছন্দ ও রূপ শিশু রবীন্দ্রনাথকেও সমগ্র জীবন চেতনায় জল পড়া ও পাতা নড়ার শিক্ষা দিয়েছিল।