তীর্থকঙ্কর মৈত্রের কবিতা

তীর্থকঙ্কর মৈত্রের কবিতা

এখন আমরা দু’জন একদানা সময়ের পাশে
 
এখন আমাদের হাতে মাত্র অঘ্রাণের একটা পূর্ণ বিকেল
আর পালং পাতার মতো তাজা ছোট্ট একটা রাত।
 
আমরা ইচ্ছে করলে এই রুমালের মতো ছোট্ট সময়টুকু
বেঁধে দিয়ে আসতে পারি,অঘ্রাণের সড়ক পুলের কোন একটা
             ছোট্ট সাদা রেলিঙে,
লুকিয়ে রাখতে পারি মোড়ের ক্লান্ত মাইলস্টোনটার
             ক্রমিক সংখ্যার মধ্যে ।
 
আমরা আপাতত দু’জন কিছুই করছি না…
কৃপণ হয়ে উঠেছি জানলার শিকগুলোর মধ্যে,
আমরা মিতব্যয়ী বোধ করছি শ্বাসপ্রশ্বাস ত্যাগে।
 
তবু এই বিকেলটা একটা খাবার বিলাসী শিশুর হাতে
বিস্কুটের মতো একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে ।
একটা সময় অদৃশ্য শিশুর সাদা দাঁতে সবটুকু শেষ হতে হতে—
ভোরের চায়ের কাপে আলো উপভোগ্য হবার আগেই,
বেহালার কোনো একটা ছোট্ট বাড়ির গ্রিন রঙের মধ্যে
                অনুজ্জ্বল লুকিয়ে পড়বে।
 
এখন আমরা এই একদানা সময়ের পাশে দু’জন
ভয়ঙ্কর কৃপণ হয়ে উঠেছি—জানলার শিকগুলোর মধ্যে !        
                       
 
গ্রামের উমা

 
পাট ভেজা জল করে টলটল–তাতে হাঁস দল চরে—
পাকাঠির ধারে উড়ে খেলা করে, গঙ্গা ফড়িং ফেরে ;
তার নীচে জলে গ্রাম অঞ্চলে পেঁজামেঘ এসে ভেজে।
পাশে তার ঘাসে রোদ এসে হাসে , কিশোরী মেয়েটি সাজে—
আলতার লালে পাদুটি সকালে এঁকে নিয়ে হাতে ওই
শাপলার মালা প’রে এই বেলা , হাঁস ডাকে– চৈ চৈ…
সে ডাকের সাড়া কাঁপিয়ে এ পাড়া দিয়ে যায় হাঁসদল।
মেয়েটির নাম? উমা রাখলাম, বাবা তার নাও গড়ে;
দূরে ওই বিলে সাদা বক তুলে ডানা দুটি তার ওড়ে—
পুকুরের পাড়ে থানকুনি মেড়ে বাঁধা বাছুরেরা চঞ্চল।
অভাবী গ্রামের  বেলা যায় ফের ,দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে
পাকাঠি বেড়ার আড়ালেতে কার জ্বলে ওঠেকুপি ছন্দে।
উমা মেয়েটির খিদে পার ধীর —ঘুমে ঢুলুঢুলু দুটি চোখ;
শরৎ সন্ধ্যায় চাঁদ চুপি চায়  মেয়েটি ও সুখী হোক!
মা হারা মেয়ে ,পড়ে তার গায়ে  তাইকি চন্দ্রালোক ?

 
রঙিন নৌকো প’ড়ে
 
কুড়াতে এসেছি  নুড়ি, কাটা ঘুড়ি প’ড়ে দেখি
সমুদ্রের তীরে , জল ছুঁয়ে, ঢেউ তাকে ছুঁয়ে যায়,
বালি মাখে—রঙিন ঝিনুক এসে জড়ো হয়ে পাশে —
 
একি দৃশ্য বলো? তবু সূর্যোদয় হয় দূরে—
জলের থেকে সে রোজ, আবীর ছড়ায় নীল জলে।
জেলের কিশোরী মেয়ে, কেন যে এখানে আসে!
কথা বলে সমুদ্রের সাথে… তীরের বালির ওপর
রঙিন নৌকো প’ড়ে ; তার ছায়া সমুদ্রের তীরে ;
কচ্ছপ শিশুরা হেঁটে, ঘুড়িটিকে রেখে নামে জলে—
এও কি  যুদ্ধ তবে এক?  কাটা ঘুড়ি জলে ভেজে…
জেলের কিশোরী মেয়ে, কেন যে এখানে আসে !
 
 
ফিরে যদি দেখি আমি

( উৎসর্গঃ বাংলাদেশকে)
 

ফিরে যদি দেখি আমি তুমি আর নেই তেমন রূপসী !
চোখের কাজল ধুয়ে বোলই-এর বন গেছে ম’রে।  
তোমার চিবুক ভরা ঘুঘুর ডাকের মতো উঁহু-উঁহু ব্যথা !
ভেড়েনা মুখের পাশে বাহারি তেমন নাও ‘পবন-সওয়ারি’! 
 
যদি দেখি ঘাটে একা নামোনা বাসন হাতে ইতি-উতি চেয়ে; 
কাকের চতুর চোখ মাছের কাঁটার এঁটো ঘেঁটে না তেমন !  
তোমার পায়ের পাতার আলতার দাগটুকু মুছে  
খরায় ফেটেছে জমি, মানুষের হাটে গিয়েছো বিকিয়ে !
তুমি আর নেই মাঠে, নদীর দু’কুল ম’রে কমেছে নাব্যতা;
অকাল বয়স দাগ,তোমাকে ভেঙেছে এসে নতুন সভ্যতা !  
 
ফিরে যদি দেখি তুমি আর নেই তেমন আলাপি; 
তোমার শাড়ির খুঁটে গিঁট দিয়ে, মনে রেখে করোনা তামাশা।
বুনো পায়রা দলে তোমার ঠিকানা আজ,তুমি নেই !
বছর বিয়ানো গাই বেচেছো কালের হাতে,খোয়া গেছে 
                   ঝকঝকে কাঁসা !
 
 
 
জুলজুলে রঙিন পরদাটি

 
ফের কোথাও ঘন্টা বেজে ওঠে—
                  কোথাও যেন পড়ে যায় ছুটি…
 
কারা সদলবলে পথে নামে —
দুপুরে কোথাও যেন ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুটতে থাকে রঙিন সাইকেল—
পরিত্যক্ত বাংলায়, জলের বোতল নামে,
             ঘাসের ওপর কারা খুলে রাখে টুপি।  
লেবু আর সোডায় ঠাসাঠাসি ঠান্ডা পানীয়;
                  ফোঁস-ফোঁস করে যায় সারাদিন…  
                      ছিপি ও ফেনার দলা ছিটকে যায়—
কোথাও বাড়ি পড়ে তাঁবুর খুঁটিতে—
                          কৃশঘোড়া ভাঙে পথ…  
পাহাড়ি গন্ধ নিয়ে মিনিস্কার্ট
                          স্কোয়াসের মতো ঢেলে পড়ে।
ছুটি হয় নির্ঘাত —কোথাও কোথাও !  
কারা তাকে ধরে নিয়ে রঙিন জামায়
ফিরে আসে চৈত্রের শহরে—আর
ফেরি করে নানা সুরে দুপুরের জানলায়—
 
এমন ছুটির গন্ধে পরদার মৃত সব আড়ালেরা বেরিয়ে আসে,
দ্বিতলের সাদা-সাদা রেলিঙে,ছটফট করে যায়
                          রঙিন ক্লিপে আঁটা ছোট্ট রুমাল;
আলোছায়া-আলোছায়া—
                 শব্দহীন কাচের মতো স্বচ্ছ তরঙ্গ এক
                 ভেঙে দেয় নতুন পালক-ওঠা দেবদারু বন।
কোথাও ঘন্টা বেজে যায়— কোথাও না কোথাও পড়ে যায় ছুটি—
                   কক্ পিটে কাঁপতে থাকে
                   বিদেশি বিমানের জুলজুলে রঙিন পরদাটি…