প্রবন্ধঃ ডক্টর মাসুদ আহমেদ

প্রবন্ধঃ ডক্টর মাসুদ আহমেদ

ডক্টর মাসুদ আহমেদ
সালেহা চৌধুরী

লন্ডনের অনুষ্ঠানে, সাহিত্যসভায়, বই সমালোচনায়, বিশেষ দিনে পুস্তক বা ম্যাগাজিন প্রকাশনায় যে মানুষটি দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন তিনি ডক্টর মাসুদ আহমেদ। আমাদের মাসুদ ভাই। কবিতা, নাটক, ছোটগল্প, উপনাস সবখানে তিনি। অনেক অনুষ্ঠানে আমরা দুজনে একসঙ্গে গেছি। পাশাপাশি বসেছি। কথা বলেছি। ভাবতেও বিশ্বাস হয় না তিনি চলে গেছেন। সব মৃত্যুই অকাল মৃত্যু। এবং তাঁর মৃত্যু অবশ্যই অকাল মৃত্যু। ব্রিটেন প্রবাসীদের হ্রদয়ে তাঁর চলে যাবার কারণে এক বিশাল শূন্যতা। অন্তত আমার হৃদয়েতো বটেই।

কবে কোনদিন প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল মনে নেই। তবে মনে আছে প্রথম আলাপেই তাঁকে ভালো লেগেছিল। তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন তাঁর ছোট গল্পের বই ‘চন্দ্রবিন্দু’। গল্পগুলো আমাদের মত মানুষ যারা এদেশে বাস করছেন তাদের নিয়ে লেখা। এ গুলো এখানকার একটি পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হয় এবং তখনি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। পরে সেটি বই হয়। আমরা একবার একটি সংগঠন করেছিলাম। মজা করে তার নাম দিয়েছিলাম ‘আমরা এগারো জন।’ মাসে একবার আমরা এই এগারোজনের কোন একজনের বাড়িতে আসর জমাতাম। গল্পপাঠ, কবিতাপাঠ ও প্রচুর সমালোচনা, প্রচুর খাওয়া দাওয়া। চমৎকার ছিল সে আসর। আমি, মাসুদ আহমেদ, হাসি ভাবী, ডলি ইসলাম, কুদরাতুল ইসলাম, সাগর চৌধুরী, উর্মি রহমান, মাঝে মাঝে গাফফার চৌধুরী, আনোয়ারা সৈয়দ হক, এমনি কয়েকজন মিলে সে আসর বসতো। বেশ কয়েকটি আসরের পর সে অনুষ্ঠান নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বেশির ভাগ আসর বসতো মাসুদ ভাইএর বাড়িতে। খাবারের আয়োজনে তিনি ছিলেন অকৃপন। লেখা পড়া, সমালোচনা, গল্পের পর বাড়ি ফিরতে বেশ লাগতো। এই আসরে পরিকল্পনা মাসুদ ভাইয়ের।

ঢাকা থেকে নিয়মিত বই প্রকাশ করতেন তিনি। ঝকঝকে মলাটে তাঁর নিজের তত্বাবধানে বইগুলো খুবই চমৎকার হতো। আমরা কপি পেতাম। আমার বই হলে মাসুদ ভাইকে না পাঠিয়ে শান্তি পেতাম না। তিনি পড়বেন এবং তিনি কি বলবেন সেটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি ছিল না। তিনি সুন্দর করে সমালোচনা করতেন। একবার বলেছিলেন তুমি নামক শব্দটি খুব ব্যবহার কর। যেমন বিশাল নামক যুবক। আমি এরপর থেকে নামক আর ব্যবহার করতাম না। এমনি ছোটখাটো কথা তিনি বলতেন। আর প্রশংসা? সেটা তো ছিল। একদিন তিনি বলেছিলেন,সালেহা তুমি কি এমন তেমন গাড়ি? তুমি হলে সাহিত্যের ‘মার্সিডেজ’ বেঞ্চ। তাই তোমাকে খুঁটিয়ে দেখি। বেশ একটু বড় ভাইএর মত ব্যাপার ছিল তার ভেতরে। যদিও তিনি খুব বেশি বড় ছিলেন না। আমি আর মাসুদ ভাই একই সময়ে ‘বাংলা একাডেমী প্রবাসী লেখক পুরস্কার’ পেয়েছিলাম।

মাসুদ ভাইএর এখানে ওখানে অনেকগুলো বাড়ি ছিল। একদিন তাঁকে বললাম, আপনার ফ্রান্সের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবেন? তিনি বললেন কেন নয়? এক শুভদিনে আমি, মাসুদ ভাই আর হাসিভাবী তাঁর ফ্রান্সের ফেসিন নামের একটি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মাসুদভাই তখন বার্মিংহামে। সেখান থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নেন। লন্ডন টু ফ্রান্সের ফেসিং দীর্ঘপথ তিনি একা ড্রাইভ করেন। পাশে বসে ছিলেন ভাবী। যখন আমরা ফেসিং পৌঁছালাম গভীর রাত। সে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলে পরদিন দেখি— ওরে বাবা এযে বিশাল এক তিনতলা বাড়ি। কোনো কুটির বা কটেজ নয়। ওখানে নানা জায়গা দেখিয়ে দুপুরে ভাবীর হাতের মাছের ঝোল আর ভাত। বুঝতে পারলাম ভাবী একজন অসাধারণ রাঁধুনী কেবল মাসুদ ভাইএর মত তিনিও একজন জি পি নন। খাওয়ার পর গল্প পড়ে শোনানো। আমি জি.পিদের নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। ‘জীবনের স্বাদ’। দুজনেই উপভোগ করলেন। সে বেড়ানো বা ফ্রান্স দেখার কথা আমি কখনোই ভুলবো না। এরপর মাসুদভাই গাড়িতে করে আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছিলেন বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। এই ঘটনা একটি অবিস্মরনীয় স্মৃতি। ফ্রান্সের একটি গ্রামে থাকতে পেরে ভালো লাগলো। তিনি ওখানে কবিতা লিখেছিলেন, আমিও তাই। পরে তিনি পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখান।

মাসুদ ভাইএর একটি চমৎকার বই আছে ‘ঢাকা লন্ডন প্যারিস’। বইটি তাঁর অন্যান্য বইএর মত উপভোগ্য। তিনি যখন গল্প লিখতেন একেক সময় মনে হতো তিনি নিজেই সেই গল্পের চরিত্র। তাঁর বারো’শ পাতার বড় উপন্যাস ‘অন্য একজন’ও মন দিয়ে পড়েছি। সেখানে তাঁকে খুঁজে পেয়েছি। ঝরঝরে ঢাকার পটভূমিতে লেখা নানা তথ্য। সেখানে তিনি অবশ্যই আছেন এবং হাসি ভাবী।

তরুণদের উৎসাহ, উপদেশ, আর্থিক সাহায্য, কাজ দিয়ে সাহায্য, এইসবে এবং ব্রিটেনের সাহিত্য জগতকে সচল রাখতে প্রানপন করেছিলেন। একটি সাহিত্য পত্রিকাও বের করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন চালাতে পারেন নি। ব্রিটেনে দীর্ঘদিন একটি পত্রিকা কেউ ধরে রাখতে পারে না। এই হলো আমাদের ট্রাজেডি। যেমন এখন লন্ডনে বাংলা বইএর দোকান একটিও নেই। এও আমাদের মস্ত দূর্ভাগ্য। দেখলাম নিউইয়র্কের মুক্তধারা কি চমৎকার করে দোকান বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রতি বৎসর সাহিত্য উৎসব করছেন। লন্ডনে সেটা হলো না কেন? লন্ডন নাকি তৃতীয় বাংলা? কেন কেউ এগিয়ে এলেন না দোকানটিকে বাঁচিয়ে রাখতে?

আমি মাসুদ আহমেদের কবিতার ভক্ত। ফেসিনে দেখেছি কি ভাবে তিনি তাল ঢুকে কবিতার ছন্দ ও কবিতা নির্মান করেন। একটি কবিতার কয়েকটি লাইন ‘তবু তীব্র দুঃখবোধ কবিতার পয়ারের মাত্রাবৃত্ত সম/ আমার দু পায়ে বাঁধা, ভৎসনার চোখ/ সে আমায় কাছে ডেকে বলে/ জীবনের যাতনায় নিহত তুমি/ শোন প্রিয়তম/ স্বর্ন শুদ্ধ হয়না কখনো যদি সে না পোড়ে দুঃখের অনলে/ দুঃখ সে যে ধুরন্ধরা পিনোন্নত পয়োধরা চতুরা রমনী/ তাকে কি করে দূরে রাখি বল/ সে আমার নয়নের মনি।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর নিজের কণ্ঠে নিজের কবিতা শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। তেমন মুগ্ধ হয়ে শুনেছে তাঁর কথা। তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা। সাহিত্য নিয়ে যখন কথা বলতেন তা শুনতে ভালো লাগতো। ভাবা যায় না লন্ডনের কোন সাহিত্যর অনুষ্ঠানে এখন আর তিনি আসবেন না। চমৎকার মজা করে কথা বলবেন না। যে কয়জন মানুষ এখানকার সাহিত্য ¯্রােত অব্যহত রেখেছিলেন উনি সেই গুটি কয় মানুষের একজন।

মাসুদ আহমেদের চমৎকার হাস্যরস বা সেন্স অফ হিউমার ছিল। ভাবীর একবার পায়ের অপারেশন হয়। তিনি দুই হাতে সেবা করতেন। ভাবীকে সুস্থ করে তুলতে তিনি দিনের শ্রম রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়েছিলেন। আসলে ওঁরা দুজনে ছিলেন মানিকজোড়। তখন যদি আমি তাঁকে ফোন করতাম তিনি বলতেন,পরে কথা বলবো। এখন তোমার ভাবীর পায়ে তেল মালিশ করছি। ভাবীর কথা মনে হয়। কি দুঃসহ জীবন যাপন করছেন। আল্লাহ তাঁকে বেঁচে থাকবার শক্তি দিক।

আমরা অনেকেই হয়তো জানি না তিনি চমৎকার গান লিখতেন। আমাকে বলেছিলেন সে কথা। সুরজ্ঞান আর ছন্দ জ্ঞান ছিল অসাধারণ।

দুই ছেলে সাগর আর সৈকত দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। কোন এক অনুষ্ঠানে সৈকত ওর নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছিল। কবিতাটির কথা এখনো মনে আছে। অটাম কেম উইদাউট ওয়ার্নিং।

যারা চলে যান স্বভাবতই আমরা তাঁর প্রশংসা করি। কিন্তু এখানে যা লিখেছি সব সত্যি এবং বানানো একটিও কথা নয়। চন্দ্রবিন্দু দিয়ে শুরু করে বারশো পাতার উপন্যাস! কেবলই মনে করিয়ে দেয় সাহিত্য অনুরাগী একজন ডাক্তার তাঁর মূল্যবান সময়ের ভেতরে কি ভাবে এই চর্চা অব্যহত রাখেন।

ব্রিটেনের নাটকের জগতে তাঁর অবদান অনেক। তিনি প্রচুর নাটক লিখেছেন এবং সেগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে। সকলে উপভোগ করেছে। আমিও কয়েকটি দেখেছি। ঢাকার টেলিভিশন তাঁর নাটক দর্শকের সমাদর পেয়েছে। পুরস্কার একটি নয় আসলে তিনি অনেক পুরস্কার পেতে পারেন। জনমত তাঁকে ‘স্বর্নপদক’ দিয়ে একটি ভালো কাজ করেছেন।

বোধকরি তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমি একটি নাটক লিখি। এজাজ মোহাম্মদ নামের একজন তরুণ আমার কাছে একটি নাটক চেয়েছিলেন। একদিন নাটক শেষ হলো। নাটকটির নাম ‘এক+এক= দুই’। এজাজ মোহাম্মদ সে নাটক কার্লটন থিয়েটারে মঞ্চস্থ করেন। নায়ক এজাজ মোহাম্মদ, নায়িকা উর্মি মাজহার। দুই চরিত্রের পোর্টেবল নাটক। এজাজের ইচ্ছা ছিল এই নাটক নিয়ে ও এখানে যাবে, মঞ্চস্থ করবে। পরে ও দেশ ছেড়ে চলে যায়। আমার নাটক লেখার ইতি এরপর। মাসুদ ভাই ভাবী সহ বার্মিংহাম থেকে সে নাটক দেখতে আসেন এবং আসতে বলেন তাঁর কিছু ডাক্তার বন্ধুদের। নাটক শেষ হলে বলেন— আমারতো এতক্ষণ মনে হয়েছে আমি একটি টেলিফিল্ম দেখছি। উনি এইভাবেই আমাকে উৎসাহ দিতেন। আমার মনে হয় আমি একা না উনি আরো অনেককে এইভাবে উৎসাহ দিয়েছেন।

মাসুদ ভাই কাল রাতে আপনার কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখ বার বার ভিজে উঠছিল। মনে আছে শেষবার যখন ফোন করেছিলাম আপনি কমপিউটারে কি যেন লিখছিলেন। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, কি লিখছেন? আপনি কতগুলো ছোট কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে একটি এমন ছিল, কান পেতে নানা ভাবে ইতি উতি শোনা যায়/ মাসুদের জানাজায় লোকজন আসে নাই। আমি বলেছিলাম ছি এসব লিখছেন কেন? তখনো আমি জানতাম না আপনি ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। এবং লোরকার মত বুঝতে পারছেন মৃত্যু খুব কাছে। এবং আপনিও প্রস্তুত তাঁকে ধরা দিতে।

আমি আপনাকে মিস করি। ফোনের ওপারে আর কেউ বলবে না— কি লিখছো এখন? লেখা ছেড়ো না। লিখে যাও সালেহা।